প্রতিবাদের কলকাতা! উৎসবের রংকে ফিকে করে শহর মাতল দ্রোহের কার্নিভালেই

Junior Doctors Human Chain: মানুষ নেমেছেন রাজপথে। অধিকার বুঝে নেওয়ার দাবিকে যে উৎসবের মোড়কে দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়, তা ফের একবার প্রমাণ করে দিয়েছে মঙ্গলবার দ্রোহের কলকাতা।

একদিকে যখন প্রতিবছরের মতো মুখ্যমন্ত্রী ব্যস্ত রেড রোডে দুর্গা পুজোর কার্নিভালে, সেখানে আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদে শহর মাতল দ্রোহের কার্নিভালে। আরজি কর কাণ্ডের দু'মাস কাটলেও প্রতিবাদ-আন্দোলনের ঝাঁঝ বিন্দুমাত্র কমেনি। বরং তা বেড়েছে কয়েকগুণ। সুবিচার ও নির্দিষ্ট কিছু দাবি নিয়ে ধর্মতলায় অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন জুনিয়র চিকিৎসকেরা। চিকিৎসকদের সেই অনশন মঞ্চে ভিড় করেছেন সাধারণ মানুষ। তাঁদের লড়াইকে নিজের করে নিয়েছেন তারা। সেই আমরণ অনশনের প্রতি সংহতি জানিয়েই দ্রোহের কার্নিভালের ডাক দেয় জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অফ ডক্টর্স।

একই দিনে পুজোর কার্নিভাল আর দ্রোহের কার্নিভাল। পরস্পরবিরোধী এই দুই আয়োজনের মধ্যে বিরোধ খানিকটা স্বাভাবিকই ছিল। যে কারণে এই দ্রোহের কার্নিভালের জন্য প্রাথমিক ভাবে অনুমতি দেয়নি পুলিশ। এমনকী রানি রাসমণি রোড সংলগ্ন একাধিক জায়গায় জারি করা হয় ১৬৩ ধারা। সেই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে মঙ্গলবারই হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল জয়েন্ট প্লাটফর্ম অফ ডক্টর্‌স। দ্রুত শুনানির আর্জি তো মঞ্জুর হয়ই, পাশাপাশি সেই দ্রোহের কার্নিভাল করার অনুমতিও দেয় হাইকোর্ট। ফলে জুনিয়র ডাক্তারদের এই প্রতিবাদ মিছিলে পুলিশি ওজর মোটেই ধোপে টেকেনি।

আরও পড়ুন: আরজি কর কাণ্ডে আদালতে নিজের বক্তব্য জানাতে পারবে ধৃত সঞ্জয়? কী বলছে ভারতের আইন?

দ্রোহের কার্নিভাল নিয়ে প্রস্তুতি আগে থেকেই ছিল তুঙ্গে। মহিষাাবাথান থেকে এসেছেন ঢাকিরা। সামনে ব্যানারে লেখা স্লোগান, ‘বিচার যখন প্রহসন, লড়াই তখন আমরণ’। তেমন ভাবেই দ্রোহের কার্নিভালকে ঘিরে পুলিশি তৎপরতাও ছিল চোখে পড়ার মতো। রেড রোডের মতোই ধর্মতলার মোড় থেকে শুরু করে রানি রাসমণি রোড পর্যন্ত একাধিক জায়গায় মোতায়েন করা হয়েছিল পুলিশ। গোটা এলাকায় ছিল নিরাপত্তার কড়াকড়ি। রেড রোড এবং রানি রাসমণি রোডের একটি করে লেন ঘিরে ফেলা হয়েছিল ব্যারিকেড দিয়ে। রানি রাসমণি রোড ধরে ধর্মতলা থেকে নেতাজি মূর্তির দিকে ডান পাশের লেনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে সারি সারি বাসকে। বাসচালকদের দাবি, পুলিশ বাসগুলি এগোতে দিচ্ছিল না। নেতাজি মূর্তির ঠিক সামনেই বসানো হয় প্রায় ৯ ফুটের ব্যারিকেড। এর আগে জুনিয়র ডাক্তারদের লালবাজার অভিযানের সময়েও এই ধরনের ব্যারিকেড বসানো হয়েছিল। এক মানুষ সমান উঁচু ব্যারিকডগুলিকে গার্ডরেলের সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা হয়। কোথাও কোথাও বাঁশের কাঠামো বেঁধেও তৈরি করা হয়েছিল ব্যারিকেড। তবে হাইকোর্টের তরফে দ্রোহের মিছিলের অনুমতি মেলার পরে মাঠে মারা যায় পুলিশের কড়াকড়ি। রানি রাসমনি অ্যাভিনিউয়ে খুলে ফেলা হয় ব্যারিকেড! হাইকোর্টের নির্দেশের পর খুলে দেওয়া হয় ব্যারিকেডের শিকলও।

কার্যত মঙ্গলবার সময়ের আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল দ্রোহের কার্নিভাল। লৌহকপাট সরতেই উচ্ছ্বাস শুরু রানি রাসমণি রোডে। হুড়মুড়িয়ে ঢুকছে জনস্রোত। ঢাক বাজছে। সেই ঢাকের তালে তালে নাচতে থাকে জনতা। দ্রোহের কার্নিভাল রুখতে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল সারি সারি বাস। ব্যারিকেড ওঠার পর সরতে থাকে বাসগুলিও। সাড়ে চারটে বাজার অনেক আগেই রানি রাসমণি রোডে বাড়ছে মানুষের ভিড়। স্লোগানে, গানে, নাচে মুখর হয়ে ওঠে কলকাতার রাজপথ। গাওয়া হয় শিকল ভাঙার গান। প্রতিবাদের মিছিলে সামিল হতে থাকেন বহু মানুষ। স্লোগান ওঠে— ‘‘শাসক থাকবে কত ক্ষণ? শাসক যাবে বিসর্জন।’’

 

মঙ্গলবার চিকিৎসকদের তরফে কলকাতা হাইকোর্টে রাজ্যের নির্দেশের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন বিশিষ্ট আইনজীবী তথা বামনেতা বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। আর হাইকোর্টে জয়ের পর তিনি খোদ যোগ দেন দ্রোহ কার্নিভালে। তিনিই প্রস্তাব দিয়েছিলেন, বাকি ব্যারিকেড খুলে নেওয়া হলেও রানি রাসমনি রোড থেকে রেড রোডের দিকের ব্যারিকেডটি না খোলার। যাতে বাইরে থেকে কেউ এসে ঝামেলা না করতে পারে। দ্রোহের কার্নিভালে এদিন ছিল চোখে পড়ার মতো মানুষের ভিড়। কেউ জ্বালিয়েছেন মোবাইলের ফ্ল্যাশলাইট। কেউ আবার উড়িয়েছেন কালো বেলুন। সহযোদ্ধা, সহ-নাগরিকদের হাতে হাত রেখে মানুষ গড়েছিলেন জনগণের ব্যারিকেড। ধর্মতলার অনশন মঞ্চ থেকে আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তার দেবাশিস হালদার জানিয়েছিলেন, চারদিক থেকে ডোরিনায় এসে জুড়বে মানববন্ধন। ডোরিনা ক্রসিংয়ে চারটি রাস্তা বরাবর চারটি মানববন্ধন হবে। সেই মতোই তৈরি হয়েছিল মানববন্ধন। সন্ধে নামার পরেও দ্রোহের মিছিলে মানুষের ভিড় কমেনি। বরং দলে দলে মানুষ এসে যোগ দিয়েছেন সেখানে।

একদিকে যখন মুখ্যমন্ত্রী রেড রোডে ডান্ডিয়া খেলায় ব্য়স্ত, সরকারি বর্নাঢ্য অনুষ্ঠানে নানাবিধ অনুষ্ঠান করে চলেছে তারকা-রাজনীতিকরা, সেখানে আলাদা ধরনেরই উৎসবের সাক্ষী রইল রানি রাসমণি রোড। সেখানে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ কার্যত ছিল অবাক করার মতোই। তবে ধর্মতলায় জুনিয়র ডাক্তারদের ডাকে মানববন্ধনের মধ্যে পৌঁছতেই বিক্ষোভের মুখে পড়ল রাজ্যের মন্ত্রী তথা শ্রীভূমি স্পোর্টিং ক্লাবকর্তা সুজিত বসুর গাড়ি। কার্নিভালে প্রতিমা প্রদর্শন সেরে শ্রীভূমির দিকে ফিরছিল লরি, পিছনেই ছিল সুজিক বসুর গাড়ি। সুজিতকে গাড়িতে দেখেই ক্ষোভ উগরে দিলেন মানববন্ধনে দাঁড়ানো জনতা। কসঙ্গে কয়েকশো লোককে ধেয়ে যেতে দেখা যায় গাড়ির দিকে। সুজিতের অভিযোগ, তাঁর গাড়িতে বোতলও ছোড়া হয়েছে। ওই ঘটনা নিয়ে ধুন্ধুমার পরিস্থিতি তৈরি হয় ধর্মতলা মোড়ে। তবে সুজিতের গাড়ি থামেনি। সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ ধরে গাড়ি নিয়ে সোজা এগিয়ে যেতে থাকেন তিনি। চলন্ত গাড়িরই পিছনের অংশে চড়-থাপ্পড় মারেন কেউ কেউ।

আরও পড়ুন:সিভিক ভলিন্টিয়ার নিয়ে ফের প্রশ্নের মুখে রাজ্য, আরজি কর-শুনানিতে যে যে নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট

সুজিত বলেন, ‘‘গণতান্ত্রিক ভাবে আন্দোলন করার অধিকার সকলের রয়েছে। কিন্তু এটা কী ধরনের অসভ্যতা! গাড়িতে আক্রমণ করবে?’’ সুজিত আরও বলেন, ‘‘ওদের থেকে আমাদের পুজোর লোক অনেক বেশি ছিল। ওখানে যদি পাল্টা হত, তা হলে কি ভাল হত! আমি চাইনি পুজোর মধ্যে ঘটনাটা বাড়তে দিতে।’’ যদিও আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, মানববন্ধন হচ্ছে দেখেও মানুষের প্রায় ঘাড়ের উপর দিয়ে যাচ্ছিল সুজিতের গাড়ি। তার জন্যই জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সুজিত চলে যাওয়ার খানিক ক্ষণ পরে সেখানে কলকাতা পুলিশের ডিসি (সেন্ট্রাল) ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়কে ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখান আন্দোলনকারীরা। ‘গো ব্যাক’ স্লোগান ওঠে সমবেত জনতার মধ্যে থেকে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে, প্রশাসনের বিরুদ্ধে সার্বিক ক্ষোভই বিভিন্ন ভাবে আছড়ে পড়েছে রানি রাসমণি থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত। ডাক্তারদের অনশন থেকে শুরু করে আরজি কর সংক্রান্ত মানুষের ক্ষোভ প্রশমনে ব্যর্থ রাজ্য সরকার। বরং তাতে আমল না দিয়েই মুখ্যমন্ত্রী-সহ গোটা সরকার মেতেছে দুর্গাপুজোর কার্নিভালে। কোনও কোনও আন্দোলনকারীর দাবি, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর এদিন যোগ দেওয়া উচিত ছিল এই দ্রোহের কার্নিভালে। তবে তেমনটা হয়নি আদতে। তবে মানুষ নেমেছেন রাজপথে। অধিকার বুঝে নেওয়ার দাবিকে যে উৎসবের মোড়কে দমিয়ে রাখা সম্ভব নয়, তা ফের একবার প্রমাণ করে দিয়েছে মঙ্গলবার দ্রোহের কলকাতা।

More Articles