জেলে বসেই সিদ্দিকিকে খুনের চক্রান্ত! কে এই লরেন্স বিশ্নোই?
Gangster Lawrence Bishnoi: জেলবন্দি অবস্থাতেও কীভাবে একজন গ্যাংস্টারের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বাড়ছে? কেন বাইরের জগতের সাথে তার যোগাযোগ বন্ধ করা যাচ্ছে না? উঠছে প্রশ্ন।
মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা ন্যাশনালিস্ট কংগ্রেস পার্টি (অজিত পাওয়ার গোষ্ঠী)-র মন্ত্রী বাবা সিদ্দিকির খুনের ঘটনায় আরও একবার গ্যাংস্টার লরেন্স বিশ্নোইয়ের নাম উঠে এল। গত শনিবার রাতে মুম্বাইয়ের বান্দ্রাতে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এনসিপি নেতাকে। এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুনের দায় স্বীকার করে পোস্ট করেছে ওই দুষ্কৃতী দলটি। চলতি বছরেই সিদ্দিকি এনসিপি-তে যোগ দিয়েছিলেন। Y ক্যাটাগরির নিরাপত্তাও পেতেন তিনি। অভিনেতা শাহরুখ খান এবং সলমন খানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল বাবা সিদ্দিকির। তাঁর মধ্যস্থতাতেই নাকি দুই অভিনেতার বিবাদ মিটেছিল। এর আগে সলমন খানকে খুনের হুমকি দিয়েছিল লরেন্সের গ্যাং। সলমনকে লক্ষ্য করে গুলিও চালানো হয়। গত তিন বছরে একের পর এক হত্যাকাণ্ডে লরেন্স বিশ্নোইয়ের নাম সামনে এসেছে। দীর্ঘদিন ধরেই গুজরাতের সবরমতি জেলে বন্দি বিশ্নোই। জেলে থাকা সত্ত্বেও বিশ্নোই কীভাবে তার অপরাধের সাম্রাজ্য চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কে এই লরেন্স বিশ্নোই? তার বিরুদ্ধে অভিযোগ কী কী? কী ভাবেই বা তৈরি হল তার এই কুখ্যাত গ্যাং?
১৯৯৩ সালে পঞ্জাবে জন্ম লরেন্স বিশ্নোইয়ের। ২০১১-তে পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে যোগ দেয়। সে সময় সতীনদরজিৎ সিং ওরফে গোল্ডি ব্রারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। তার পর থেকেই ধীরে ধীরে পাল্টে যেতে থাকে বিশ্নোইয়ের জীবন। তখন থেকেই নাকি ছাত্র রাজনীতি ছেড়ে অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ে বিশ্নোই।
আরও পড়ুন: সলমনকে মারার জন্য জুগিয়েছিল অস্ত্র! পুলিশি নজর এড়িয়ে কীভাবে নিজেকে শেষ করল ধৃত অনুজ?
যেভাবে তৈরি হল বিশ্নোই গ্যাং
বিশ্নোই ও ব্রার দু'জনে মিলে গ্যাংটি তৈরি করেছিল। চণ্ডীগড়-সহ পঞ্জাবে তোলাবাজির নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে দেওয়াই তখন মূল উদ্দেশ্য ছিল তাদের। ২০১৩ সালে এক ছাত্রনেতার খুনের ঘটনায় প্রথমবার নাম প্রকাশ্যে আসে বিশ্নোইয়ের। তার গ্যাং ২০২০-২১ সালে শুধুমাত্র তোলাবাজি থেকে তুলেছে কোটি কোটি টাকা। পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, দিল্লি, রাজস্থান ও ঝাড়খণ্ড-সহ অন্তত ১১টি রাজ্যের পুলিশের খাতায় নাম রয়েছে তার ।
ক্রমে বড় হতে থাকে বিশ্নোই ও ব্রারের দলটি। আন্ডারওয়ার্ল্ডেরসঙ্গে হাত মিলিয়ে শুরু হয় আরও অপরাধমূলক কাজকর্ম। তোলাবাজির পাশাপাশি শুরু হয় মাদক পাচার, মদের কালোবাজারি, আগ্নেয়াস্ত্রের চোরাচালান ও অর্থের বিনিময়ে খুন। গোয়েন্দাদের দাবি, সোশ্য়াল মিডিয়া ব্যবহার করে যুবকদের দলে টানত বিশ্নোই দল। মূলত ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও ইউটিউব ব্যাবহার করত তারা। তদন্তে উঠে এসেছে, সেই অ্যাকাউন্টগুলি থেকে বিশ্নোইকে আদালতে নিয়ে যাওয়ার ছবি বার বার পোস্ট করা হয়, এতে অপরাধমনস্ক বহু যুবক তার দলে যোগ দিয়েছে। বিশ্নোইয়ের দল যুবকদের কানাডা পাঠানোর লোভ দেখিয়ে গ্যাংকে বহরে বাড়াতে থাকে। তার পর তাদের দিয়েই তোলাবাজি, খুন করানো হয়। শেষে আর তাদের এখান থেকে ফেরার উপায় থাকে না। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-এর চার্জশিট অনুযায়ী, এই দুষ্কৃতী দলে রয়েছে ৭০০ শুটার। শুধুমাত্র পঞ্জাবেই গ্যাং-এর ৩০০ শুটার রয়েছে বলে দাবি এনআইএ গোয়েন্দাদের।
যে সব ব্যক্তিদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে বিশ্নোই গ্যাং
সিধু মুসেওয়ালা
২০২২ সালে পঞ্জাবের জনপ্রিয় র্যাপার তথা কংগ্রেস নেতা সিধু মুসেওয়ালাকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল বিশ্নোইয়ের দল। এ সময়েও তিহাড় জেলে বন্দি ছিলেন বিশ্নোই। তখনও সোস্যাল মিডিয়ায় বিবৃতি দিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের দায় নিয়েছিল বিশ্নোই গোষ্ঠী। বিশ্নোই গ্যাং-এর সহযোগী ভিকি মিদুখেরার হত্যায় যুক্ত নাকি ছিল মুসেওয়ালা। সে কারণেই তাঁকে খুন করে বিশ্নোই গ্যাং, অভিযোগ এমনটাই।
সুখদেব সিং গোগামেদি
গত বছর দক্ষিণপন্থী নেতা সুখদেব সিং গোগামেদি-কে তাঁর নিজের বাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়। রাষ্ট্রীয় রাজপুত করণী সেনার প্রধান সুখদেব সিং গোগামেদির খুনের পর পরই বিশ্নোই গোষ্ঠীর রোহিত গোদারা নামে এক গ্যাংস্টার এই হত্যার দায় স্বীকার করেছিল। রাজস্থানের বিধানসভা ভোটে কংগ্রেসকে হারিয়ে বিজেপি ক্ষমতা দখলের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই সুখদেবের হত্যার ঘটনা ঘটে।
গিপ্পি গ্রেওয়াল
ওই বছরই আবার কানাডার ভ্যাঙ্কুভারে নামজাদা পঞ্জাবি গায়ক গিপ্পি গ্রেওয়ালের বাড়ির সামনে এসে কয়েক রাউন্ড গুলি চালায় বিশ্নোইয়ের দুষ্কৃতী দল। সোশ্যাল মিডিয়ায় তারা গুলি চালানোর দায় স্বীকার করেছিল। তাদের দাবি ছিল, সলমনের প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিলেন ওই পঞ্জাবি গায়ক। যদিও পরে তিনি জানিয়েছিলেন, শুধুমাত্র দু'বারই অভিনেতার সঙ্গে দেখা হয়েছিল তাঁর।
ফের সলমন খানকে হুমকি
বাবা সিদ্দিকিকে হত্যা করার পর ফের নতুন করে সলমন খানকে হুমকি দিয়েছে বিশ্নোইয়ের দুষ্কৃতী দল। সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে লিখেছে, 'আমাদের কারও সঙ্গে কোনও শত্রুতা নেই। কিন্তু দাউদ ইব্রাহিমের গ্যাং এবং সলমন খানকে সাহায্য করলে কেউ ছাড়া পাবে না। যাঁরা সাহায্য করছেন তারা হিসাব বুঝতে শুরু করুন।' কেন বার বার সলমন ঘনিষ্ঠদের খুনের হুমকি? ১৯৯৮ সালে রাজস্থানের জোধপুরে 'হাম সাথ সাথ হ্যায়' ছবির শুটিং করতে গিয়ে অভিনেতার বিরুদ্ধে কৃষ্ণসার হরিণ শিকারের অভিযোগ উঠেছিল। এই ঘটনা বিশ্নোই সম্প্রদায়কে ক্ষিপ্ত করে তোলে। এরা কৃষ্ণসার হরিণকে পবিত্র বলে মনে করে।
বিশ্নোই গ্যাং-এর টার্গেট লিস্ট
দিল্লির এক ঊর্ধ্বতন পুলিশ আধিকারিক পিটিআইকে বলেছেন, এখন সলমন ছাড়াও বলিউডের বেশ কয়েক জন কুখ্যাত গ্যাংস্টার বিশ্নোই-এর টার্গেট লিস্টে রয়েছেন। সিদ্দিকি খুনে অভিযুক্ত ধর্মরাজ কাশ্যপ এবং গুরমাইল সিংয়ের দাবি, মহারাষ্ট্রের রাজনীতিবিদ তথা বিধায়ক জিশানের (সিদ্দিকির পুত্র) উপরেও হামলার ছক কষছে দুষ্কৃতী দলটি। এ ছাড়াও গ্যাংয়ের টার্গেট তালিকায় রয়েছেন— কৌতুক অভিনেতা মুনাওয়ার ফারুকি, গায়ক সিধু মুসেওয়ালার ম্যানেজার শগণপ্রীত সিং, বিশ্নোই গ্যাং-এর প্রতিদ্বন্দ্বী তথা কুখ্যাত বাম্বিহা গ্যাং-এর সদস্য কৌশল চৌধুরি এবং কৌশলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অমিত ডাগরা।
এনআইএ-র তথ্য
এনআইএ-র গোয়েন্দারা বিশ্নোই-ব্রারের যুগলবন্দীকে মুম্বই বিস্ফোরণের মাস্টারমাইন্ড দাউদ ইব্রাহিম কাসকরের তৈরি 'ডি-কোম্পানির' সাথে তুলনা করেছেন। এখানে বলে রাখা দরকার, নব্বইয়ের দশকে এদের নামেই ভয়ে থাকত বলিউডের তারকারা তো বটেই, এমনকী দেশের নামী শিল্পপতিরাও। এনআইএ দাবি করেছে, খালিস্তানি জঙ্গি হিসাবে পরিচিত হরবিন্দর সিং রিন্ডা বিশ্নোই গ্যাং-এ যারা শুটার রয়েছে, তাদের টার্গেট কিলিং-এর জন্য ব্যবহার করছে। জাতীয় তদন্তকারী সংস্থার চার্জশিটে উল্লেখ রয়েছে, এই গ্যাং পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই-এর থেকেও টাকা নেয়।
কানাডা পুলিশের অভিযোগ
কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিস ট্রুডো হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যার ঘটনায় 'ভারতের সরকারের এজেন্টদের' জড়িত থাকার অভিযোগ করেছিলেন। ভারত এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছিল। ভারত সরকারের তথ্য অনুযায়ী, নিজ্জর খালিস্তান টাইগার ফোর্সের প্রধান ছিলেন। তিনি 'শিখস ফর জাস্টিস'-সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। এই সংগঠন ভারতে নিষিদ্ধ। এখন কানাডা পুলিশ অভিযোগ করছে, বিশ্নোই গ্যাং-এর সদস্যদের দক্ষিণ এশিয়ায় স্বার্থসিদ্ধিতে কাজে লাগাচ্ছে ভারত। দাবি করা হয়েছে, বিশ্নোই গ্যাং-এর সাথে যোগসূত্র রয়েছে ভারতের। অভিযোগ, কানাডাবাসী দক্ষিণ এশিয়াদের বিষয়ে তথ্য জানতে এদের সাহায্য নেয়। যদিও কানাডা সরকার এই অভিযোগগুলোর কোনও প্রমাণ দিতে পারেনি বলে দাবি করেছে ভারত সরকার। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন, এমন গুরুতর অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও তেমন কড়া জবাব মেলেনি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে। রাবিশ কুমার তাঁর ইউটিউব ভিডিও-তে দাবি করেছেন, এই ধরনের অভিযোগ ভারতের পক্ষে ভালো নয়। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, কেন এই অভিযোগের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছে না ভারত?
কেন সিদ্দিকিকে হত্যা?
তিন দশক পর মুম্বইয়ে এমন হাই প্রোফাইল ব্যক্তির হত্যার ঘটনা ঘটল। উত্তর ভারতের ত্রাস বিশ্নোই মুম্বইতে ব্যবসার প্রসার ঘটাতে এই কান্ড ঘটিয়েছেন বলে মনে করছেন একটা বড় অংশ। তাঁদের মতে, অ্যান্টি-সলমন খান, অ্যান্টি-দাউদ, অ্যান্টি-বলিউডের গল্প সাজানো, আসলে বিশ্নোই নিজের ব্যবসা অবাধ করতেই সিদ্দিকিকে হত্যার পথ বেছে নিয়েঠে। প্রশ্ন উঠছে, জেলে বসেই কীভাবে খুনের চক্রান্ত করছে বিশ্নোই?
আরও পড়ুন:৪৮ ঘণ্টায় দশটিরও বেশি উড়ানে বোমা হামলার হুমকি! ভারতীয় আকাশপথে সন্ত্রাসের ছক?
'ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল'-এর মাধ্যমে বিশ্নোই এখনও যাকে ইচ্ছে ফোন করতে পারে। মনে রাখতে হবে, বিনা বিচারে জেলবন্দি অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন ৮৪ বছরের স্ট্যান স্বামী। একটি সিপার নিতে দেওয়া হয়নি স্ট্যান স্বামীকে। অন্যদিকে, হাইপ্রোফাইল গ্যাংস্টার জেলবন্দি অবস্থায় 'ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রোটোকল'-এর মতো সুবিধে পায়। বলে রাখা দরকার, মুম্বই পুলিশকে বিশ্নোইয়ের হেফাজত দেওয়া হচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জানিয়েছে, তাকে গুজরাত থেকে মুম্বই নিয়ে আসা নিরাপত্তার দিক থেকে ঝুঁকির হতে পারে। প্রশ্ন উঠছে, জেলে বন্দি থাকা অবস্থাতেও কীভাবে একজন গ্যাংস্টারের ক্ষমতা উত্তরোত্তর বাড়ছে? কেন বাইরের জগতের সাথে তার যোগাযোগ বন্ধ করা যাচ্ছে না? প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সরকারই কি তাকে সাহায্য করছে তবে? সরকারের সঙ্গে কি তার তেমন কোনও সমঝোতার সম্ভাবনার কথাই উস্কে উঠছে না এই সমস্ত ঘটনার পর? স্বাভাবিক ভাবেই উঠে গিয়েছে সেই প্রশ্নও।