জিতলেও মানুষের নেতা হয়ে উঠতে পারবেন মোদি?
Narendra Modi Muslim Vote: ২০১৯ সালের আগে মোদিকে 'দলিত অচ্ছুৎ মানুষদের' পা ধুইয়ে দিতেও দেখা গেছে। সমুদ্র সৈকত থেকে আবর্জনা তুলতেও দেখা গেছে।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে সবচেয়ে বড় চমক দিয়েছেন, দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ 'অভিনেতা' নরেন্দ্র মোদি। সাত দফা নির্বাচনের প্রচারের প্রথম দিন থেকে সারাক্ষণ হিন্দু মুসলমান বিভাজনের রাজনীতি করে এসে, প্রধানমন্ত্রী হঠাৎ ঘোষণা করলেন, তিনি নাকি কোনওদিনই বিভাজনমূলক কথা বলেননি। সময়টা ডিজিটাল। প্রতি নেতা থেকে অভিনেতা, এই নির্বাচনে কোথায় কোথায় কী কী বলছেন, তা সবাই দেখতেও পাচ্ছে এবং সংরক্ষণ করেও রাখছেন। তাই যতই মোদি অস্বীকার করুন যে তিনি হিন্দু মুসলমানের বিভাজনের রাজনীতি করেননি, মানুষ তাঁর কথাকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবছে না। তবে কিছু কিছু সংবাদমাধ্যমের সাংবাদিক, যারা মোদির ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন, তারা প্রশ্নও করছেন না নরেন্দ্র মোদি রাজস্থানে নির্বাচনী প্রচারে ঠিক কাদের উদ্দেশ্যে 'ঘুসপেটিয়া' শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। কাদের লক্ষ্য করে বলেছিলেন, যাঁদের বেশি সন্তান হয়, তাঁদের মধ্যে হিন্দু মহিলাদের গলার মঙ্গলসূত্র বিলিয়ে দেবে কংগ্রেস?
শুধু এই নির্বাচনের প্রচারে নির্বাচন কমিশনের চোখে ঠুলি পরে থাকার সুযোগ নিয়ে নয়, গত দশ বছরে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী নানাভাবেই দেশের রাজনীতিকে কলুষিত করেছেন। কিছু উদাহরণ এই সময়ে পাঠকদের ফের মনে করানো উচিত। ২০১৭ সালের ২০ মে, উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের প্রাক্কালে, মোদি বলেছিলেন, যদি গ্রামে একটি কবরস্থান তৈরি করা হয়, তাহলে যেন পাশাপাশি একটি শ্মশানও তৈরি করা হয়। যদি রমজানের সময়ে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়, তাহলে কেন দীপাবলিতে একইরকমভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে না? একজন প্রধানমন্ত্রী যখন এই ধরনের বাক্য বলেন, এই ধরনের শব্দ প্রয়োগ করেন, তখন কি তা হিন্দু-মুসলমানের বৈরিতাকেই উস্কানি দেয় না? অনেকে এই শব্দবন্ধ শুনে ভাবতে পারেন, এইটাই তো আসল ধর্মনিরপেক্ষতা। কোনও ধর্মকেই আলাদা করে তোষণ করা নয়। তাহলে প্রধানমন্ত্রীর আরও কয়েকটি বক্তব্য শোনা জরুরি, যা শুনলে মনে হবে, দেশের সবার প্রধানমন্ত্রী তিনি নন। তিনি শুধু সংখ্যাগুরুর প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিজেপির নেতা।
আরও পড়ুন- ৩০০ আসনও জুটবে না বিজেপির! অঙ্ক কষে যে সত্য প্রকাশ করলেন যোগেন্দ্র যাদব
২০১৯ সালে নাগরিকত্ব আইন সংসদে পাশ হওয়ার পরে, ঝাড়খণ্ডের দুমকায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, যাঁরা এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরোধিতা করছেন, তাঁদের পোশাক দেখে চেনা যাচ্ছে, তাঁরা কোন সম্প্রদায়ের মানুষ। সারা দেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ একযোগে তাঁর এই বক্তব্যের
সমালোচনা করেছিলেন। তাতেও অবশ্য তিনি তাঁর বক্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছেন বলে জানা যায়নি। এবছরের নির্বাচনের প্রচারে তো নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ সমস্ত সীমা অতিক্রম করে গেছেন। একবার বলেছেন, কংগ্রেসের ইস্তেহারের সঙ্গে নাকি মুসলিম লীগের ইস্তেহারের সাদৃশ্য আছে। কখনও আবার বলেছেন কংগ্রেস হিন্দু মানুষদের মোষ কেড়ে নিয়ে যাঁদের বেশি সন্তান, তাঁদের মধ্যে বিলিয়ে দেবে। এই সমস্ত কথার মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ভরপুর নয় কি?
১৯১৬ সালের জানুয়ারি মাসে সুরাটে একটি জনসভায় মহাত্মা গান্ধি বলেছিলেন, হিন্দু এবং মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের জন্য সমানভাবে নিজের সবটুকু উজাড় করে দেবেন বলেই তিনি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরেছেন। সেই জন্যই তিনি জাতির নেতা হয়ে উঠেছিলেন। এই ঘৃণার কারবারিরা সেদিন থেকেই তাঁকে লক্ষ্য বানিয়েছিল। নরেন্দ্র মোদি তৃতীয়বারের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলেও কোনওদিনই জাতির নেতা হয়ে উঠতে পারবেন না, কারণ তিনি সবার প্রধানমন্ত্রীই হয়ে উঠতে পারেননি। ২০০২ সালে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন, তাঁর যে মুসলমান বিদ্বেষ ছিল, তা এতটুকুও কমেনি, উল্টে তাঁর এই মুসলমান বিদ্বেষ এখন আরও শিকড় ছড়িয়েছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তিরা সারা দেশে জলবাতাস পেয়ে আরও কিলবিলিয়ে বেড়ে উঠেছে। ঘৃণা ও বিদ্বেষ কখনই নীচ থেকে ওপরে ওঠে না, বরং ওপর থেকে নীচেই তা প্রবাহমান। নরেন্দ্র মোদি গত দশ বছরে সেই দিকেই দেশকে নিয়ে গেছেন।
ভারতের ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, দেশের মুসলমান মানুষজনের বেশিরভাগই দারিদ্রসীমার নীচে বসবাস করেন। সাচার কমিটির রিপোর্ট এবং পরবর্তীতে অধ্যাপক অমর্ত্য সেনের প্রতীচী ট্রাস্টের উদ্যোগে যে সমীক্ষা করা হয়েছিল, তাতে দেখা গিয়েছিল, বেশিরভাগ মুসলমান মানুষজনেরই কোনও স্থায়ী চাকরি নেই। সরকারি চাকরিতেও তাঁদের সংখ্যা খুবই সীমিত। সেই কারণেই তাঁরা গরিব। সেই তথ্য সংশ্লেষ করলে দেখা যাবে, এখনও অবধি মাত্র ৪.৯ শতাংশ মুসলমান মানুষ সরকারি চাকুরিজীবি এবং ভারতের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সংস্থা অর্থাৎ পুলিশ ইত্যাদিতে তাঁদের অংশ মাত্র ৩.২ শতাংশ। ২০১৯-২০ সালের তথ্য অনুযায়ী, যেখানে ২৩.৩ শতাংশ অমুসলমান মানুষের বেতনভুক্ত চাকরি আছে, সেখানে শহুরে মুসলমান মানুষদের মাত্র ১৫.৬ শতাংশ মানুষ বেতনভুক্ত চাকরি করেন।
নরেন্দ্র মোদির নতুন সাক্ষাৎকারে আরও একটি জরুরি বিষয় ছিল। তা নিয়ে চলচ্চিত্রকার এবং সাংবাদিক আলিশান জাফরি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছেন প্রখ্যাত সাংবাদিক করণ থাপারের কাছে। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, তিনি মুসলমান মানুষদের ভেবে কথাগুলো বলেননি। তিনি গরিব মানুষদের কথা ভেবে বলেছিলেন। কংগ্রেস ধনী মহিলাদের থেকে মঙ্গলসূত্র ছিনিয়ে নিয়ে বিলিয়ে দেবে ক্ষমতায় এলে। গরিব মানুষদেরই বেশি সন্তান, তিনি তা ভেবেই ওই কথা বলেছিলেন, কখনই হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের ধারণা তৈরির জন্য এই বক্তব্য রাখেননি। তারপরেও একজন গরিব মুসলমান মানুষকে যদি রোজ দেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার থেকে বলা হয়, ‘দেখো, তুমি গরিব কিন্তু তোমায় তোষণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে’ তাহলে তাঁর অনুভূতি কেমন হতে পারে?
আরও পড়ুন- ‘মুসলিম বন্ধুদের মধ্যেই বড় হয়েছি!’ মনোনয়ন জমা দিয়েই কেন পাল্টি মোদির?
আরব দেশগুলো মোটেও ধর্মনিরপেক্ষ নয় কিন্তু সেখানে সংখ্যালঘুদের কি পিটিয়ে মারা হয়? সেখানে হিন্দুদের ফ্রিজে কী আছে তা কি দেখা হয়? খাতায় কলমে ভারত ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া সত্ত্বেও এখানকার মুসলমান সংখ্যালঘুদের যেভাবে রোজ সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মদতে অপমানিত হতে হয়, তাতে একটি সম্রপদায়ের বাঁচা কি দুর্বিষহ হয়ে যায় না? একজন মানুষকে পিটিয়ে মারার ভিডিও যদি তাঁর পরিবারের মানুষদের কাছে পৌঁছয়, তাহলে তাঁদের কেমন লাগতে পারে?
প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিকতম সাক্ষাৎকার দেখে যদি কেউ ভাবেন, তিনি পাল্টে যাচ্ছেন তাহলে তিনি মূর্খের স্বর্গে বাস করেন। ক্ষমতার জন্য তিনি সবই করতে পারেন। তিনি কেঁদেও ফেলতে পারেন সর্বসমক্ষে। ২০১৯ সালের আগে তাঁকে 'দলিত অচ্ছুৎ মানুষদের' পা ধুইয়ে দিতেও দেখা গেছে। সমুদ্র সৈকত থেকে আবর্জনা তুলতেও দেখা গেছে।
ওই সাক্ষাৎকারের ২৪ ঘণ্টা কাটতে না কাটতেই, মোদি আবারও নির্বাচনী প্রচারে ‘ভোট জিহাদ’ শব্দবন্ধ প্রয়োগ করেছেন। এমনকী দক্ষিণ ভারত এবং উত্তর ভারতের মধ্যেও বিভাজন তৈরির চেষ্টা করেছেন। আসলে তিনি তাঁর সুবিধামতো অবস্থান গ্রহণ করতে পারেন সহজেই। ২০১৪ সালের আগে অনেকেই তাঁকে হয়তো চিনতে পারেননি কিন্তু এখন চিনতে পারলেও তিনি এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছেন যে তাঁর দিকে আঙুল অবধি তোলা যাচ্ছে না। ‘বিড়াল
তপস্বী’ আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে কোনওদিন যদি দেখা যায়, ক্ষমতায় থাকার জন্য তিনি মসজিদে কিংবা মাজারে যাচ্ছেন, তাহলে কি তাঁর আগের ঘৃণা ভাষণ ভুলে যাব আমরা? তাঁর বক্তব্যের কারণে সমাজে যে ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়িয়েছে, সেই কারণেই যে আখলাখ, আফরাজুল, পেহেলু খানদের পিটিয়ে মারা হয়নি, তার নিশ্চয়তা কি দিতে পারবেন প্রধান সেবক?