নয়া ভারতে বেড়েছে নারী ও শিশুদের প্রতি অপরাধ, এই কি তবে মোদিজির 'অচ্ছে দিন'?
NCRB report: শিশুদের প্রতি ঘটে চলা অপরাধের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতিবছর। ০২১ সালে শিশুদের প্রতি অপরাধের সংখ্যা ছিল ৩৩.৬ শতাংশের কাছাকাছি। ২০২২ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬.৬ শতাংশ।
দেশ এগোচ্ছে। জনসংখ্যা বাড়ছে। জিডিপি বাড়ছে। বাড়ছে দূষণ। হু হু করে ডিজিটাল ভারতে এসেই পড়ছে 'অচ্ছে দিন'। আর এসবের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই বাড়ছে অপরাধও। হ্যাঁ, এমন কথাই শোনাচ্ছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো। জানা গিয়েছে, গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের হিসেব বলছে, মেয়েদের উপর অপরাধের হার বেড়েছে অন্তত ৪ শতাংশ। শুধু নারীদের উপর অপরাধই নয়, একই সঙ্গে শিশু, প্রবীণ, তফসিলি জাতি-উপজাতির মানুষের উপর ঘটে চলা অপরাধের সংখ্যাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। দেশের ৩৬টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের পাশাপাশি বিভিন্ন কেন্দ্রীয় সংস্থা থেকে তথ্য সংগ্রহ করেই ওই রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো (NCRB)।
প্রতি বছরই গত এক বছরের অপরাধের হার সংক্রান্ত একটি করে রেকর্ড প্রকাশ করে ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো। এ বছরও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে মাস পাঁচেক দেরি হয়েছে রিপোর্ট প্রকাশে। সাধারণ ভাবে জুন-জুলাই মাসে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। তবে এ বছর প্রথা ভেঙে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে 'ক্রাইম ইন ইন্ডিয়া ২০২২' সংক্রান্ত রিপোর্টটি প্রকাশ্যে এনেছে NCRB। দেখা গিয়েছে, ২০২১ সালের তুলনায় সব ধরনের অপরাধই বেড়েছে ২০২২ সালে। বেড়েছে নারী ও শিশুদের প্রতি অপরাধ। একই সঙ্গে বেড়েছে দলিত ও তফসিলি জাতি-উপজাতির মানুষদের প্রতি ঘটে চলা অপরাধের সংখ্যা। NCRB-র রেকর্ড অনুযায়ী, দেশ জুড়ে নারীদের প্রতি অপরাধের পরিমাণ বেড়েছে ৪ শতাংশ। শিশুদের প্রতি অপরাধ বেড়েছে ৮.৭ শতাংশ। বাদ নেই বৃদ্ধবৃদ্ধারাও। প্রবীণদের প্রতি অপরাধ বেড়েছে ৯.৩ শতাংশ। পাশাপাশি এসসি-এসটি সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতিও বেড়েছে অপরাধের প্রবণতা। এসসি-দের উপর অপরাধ বেড়েছে ১৩.১ শতাংশ। এসটি-দের প্রতি অপরাধ বেড়েছে ১৪.৩ শতাংশ। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশ জুড়ে বেড়েছে অর্থনৈতিক অপরাধ। ১১.১ শতাংশ বেড়েছে অর্থনৈতিক অপরাধ, ২০২২ সালে দুর্নীতি বেড়েছে ১০.৫ শতাংশ।
আরও পড়ুন: নারীদের জন্য নিরাপদ কলকাতা! কোথায় দাঁড়িয়ে দেশের অপরাধ মানচিত্র?
প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন কোণা থেকে বিভিন্ন ধরনের সাইবার অপরাধের খবর আসে। কখনও সেই সাইবার অপরাধের শিকার অভিনেতারা, তো কখনও আম আদমি। প্রতিদিন নতুন নতুন পদ্ধতি খুঁজে নয়া টেকনিকে চলছে সাইবার অপরাধ। কখনও লুঠ হয়ে যাচ্ছে টাকা, কখনও ছিনিমিনি খেলা হচ্ছে মেয়েদের সামাজিক সম্মান। চলছে ব্ল্যাকমেল। আর ২০২১ সালের তুলনায় এ ধরনের সাইবার অপরাধের ঘটনাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। ২০২২ সালে সাইবার অপরাধ বেড়েছে প্রায় ২৪.৪ শতাংশ।
খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। নির্ভয়াকাণ্ড নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল গোটা দেশ। ওই মামলায় দোষীসাব্যস্তদের ফাঁসির সাজা দেয় কোর্ট। সেই দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির পরেও কি বদলেছে সমাজ। না, ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রিপোর্ট তো তা বলছে না। আহমেদাবাদ, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, কোয়েম্বত্তূর, দিল্লি, গাজিয়াবাদ, হায়দরাবাদ, ইনদওর, জয়পুর, কানপুর, কোচি, কোঝিকোড়, লখনউ, মুম্বাই, নাগপুর, পাটনা, পুণে, সুরাত ও কলকাতা মিলিয়ে প্রায় ১৯টি মেট্রোপলিটন শহরের ক্রাইম রেকর্ড ঘেঁটে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো। সেখানে দেখা যাচ্ছে, কুড়ি লক্ষেরও বেশি জনসংখ্যার এই শহরগুলিতে ২০২২ সালে মোট ৪৮,৭৫৫টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছিল। ২০২১ সালের তুলনায় যা বেড়েছে প্রায় ১২.৩ শতাংশ। অর্থাৎ ৪৩,৪১৪টি নারী নির্যাতনের ঘটনা অতিরিক্ত ঘটেছে ওই বছর। এ সব তো এমন অপরাধ, যা কোনও না কোনও ভাবে পুলিশের খাতা অবধি পৌঁছেছে। আরও এমন অনেক যৌনহেনস্থা ও নারীনির্যাতনের ঘটনা রয়েছে, যা নিয়ে কোনও অভিযোগ দায়ের হয় না। সেসব মেলালে সংখ্যাটা কোথায় পৌঁছবে ভাবলে আশঙ্কা হয়। নারীনির্যাতনের অভিযোগের একটা বড় অংশ জুড়ে রয়েছেন তেমন নারীরা, যাঁরা বারংবার স্বামী বা পরিবারের অন্য সদস্যের হাতে নিগ্রীহিতা হন। নারীদের প্রতি সংঘটিত অপরাধের প্রায় ৩২.৬ শতাংশ জুড়েই রয়েছে এই ধরনের ঘটনা। ১৯.৪ শতাংশ ঘটনা নারী অপহরণ ও পাচারের। মেয়েদের সম্মান নষ্ট করতে হামলার ঘটনা ঘটেছে ১৭.৯ শতাংশ। একই সঙ্গে রয়েছে শিশু নিগ্রহের ঘটনাও। পকসো আইনে ওই বছরে মামলা দায়ের হয়েছে প্রায় ১৩.২ শতাংশ।
নারীদের প্রতি অপরাধের নিরিখে এ বছরও নিজের জায়গা ধরে রেখেছে দিল্লি। মহিলাদের জন্য দিল্লি যে একেবারেই সুরক্ষিত নয়, এমন একটা ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছে বহু দিন ধরেই। আর তা যে শুধু ধারণা নয়, তা বারবার প্রমাণ করে দিয়েছে রাজধানীর রিপোর্ট। দিল্লিতে মহিলাদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ ১৪,১৫৮টি রিপোর্ট নথিভুক্ত হয়েছে ২০২২ সালে। যা ২০২১ সালের তুলনায় খুব সামান্য কম। তবে এ বছর শীর্ষ স্থান দখন করেছে যোগীরাজ্য। মহিলাদের বিরুদ্ধে অন্তত ৬৫,৭৪৩টি অপরাধের ঘটেছে সেখানে। আইপিসিভারতীয় দণ্ডবিধি ও স্পেশাল অ্যান্ড লোকাল 'ল'-এর আওতায় দায়ের হয়েছে অভিযোগও। যেসব মামলায় চার্জশিট দেওয়ার হার ৭৫.৬ শতাংশ। এরপরে রয়েছে মহারাষ্ট্র। মোট ৪৫,৩৩১টি মেয়েদের প্রতি অপরাধের অভিযোগ দায়ের হয়েছে সেখানে। চার্জশিট রেট ৮০.৬ শতাংশ। রাজস্থানে ঘটেছে ৪৫,০৫৮ টি নারী-অপরাধের ঘটনা। যেখানে চার্জশিট গঠনের হার মাত্র ৫৪ শতাংশ। মেট্রোপলিটন শহরগুলির মধ্যে পিছিয়ে নেই বেঙ্গালুরুও। রাজ্যগুলির মধ্যে, মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের সর্বোচ্চ হার হরিয়ানায় (১১৮.৭ ) নথিভুক্ত রয়েছে। তারপরেই রয়েছে তেলেঙ্গানা (১১৭) এবং রাজস্থান (১১৫.১)। ২০২১ সালের তুলনায় যা একটু বেশিই।
শিশুদের প্রতি ঘটে চলা অপরাধের সংখ্যাও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে প্রতিবছর। শিশু সুরক্ষা আইন জোরদার করা থেকে শুরু করে পকসো আইনে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি, এত কিছু সত্ত্বেও রোখ টানা যাচ্ছে না শিশু অপরাধে। পাল্লা দিয়ে চলছে যৌনহেনস্থা থেকে শুরু করে পাচারের ঘটনা। প্রতিদিন খবর চোখ রাখলেই কোনও না কোনও নাবালিকা হেনস্থার খবর কানে আসে। ২০২১ সালে শিশুদের প্রতি অপরাধের সংখ্যা ছিল ৩৩.৬ শতাংশের কাছাকাছি। ২০২২ সালে সেটা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৬.৬ শতাংশ। ২০২২ সালে মোট ২০,৫৫০টি মামলা দায়ের হয়েছে মেট্রোপলিটন শহরের তুলনায়। ২০২১ সালে যা ছিল ১৯,০৫৫-র কাছাকাছি। শিশুদের অপরাধপ্রবণতা ২০২২ সালে সামান্য কমেছে বটে। তবে তা চোখে পড়ার মতো নয়। ২০২১ সালে ৩১,১৭০ টি মামলা দায়ের হয়েছিল জুভেনায়েল অপরাধের। এ বারে সেই সংখ্যা ২ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৩০,৫৫৫-য়।
আরও পড়ুন:আফতাব একা নয়, যোগীরাজ্যেও প্রেমিকার দেহ টুকরো টুকরো, রাজ্যে রাজ্যে কেন বাড়ছে এই ধরনের অপরাধ?
প্রবীণদের বিরুদ্ধে অপরাধও ২০২১ সালের তুলনায় ৯.৩ শতাংশ বেড়েছে ২০২২-এ। তার মধ্যে রয়েছে চুরি, জালিয়াতির পাশাপাশি মারধরও। তফসিলি জাতির বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগ এ বছর দায়ের হয়েছে ৫৭,৫৮২টি। যা ২০২১ সালের তুলনায় ১৩.১ শতাংশ বেশি। এসটি-র বিরুদ্ধে অপরাধ বেড়ে দাঁড়িয়েথে ১০,০৬৪টি মামলায়। যা ২০২১ সালের তুলনায় ১৪.৩ শতাংশ বেশি। অর্থনৈতিক অপরাধের সংখ্যাও বেড়েছে ১১.১ শতাংশ। ২০২২ সালে ৪,১৩৯টি অর্থনৈতিক অপরাধ নথিভুক্ত হয়েছে। ২০২১ সালে যে সংখ্য়াটি ছিল ৩,৭৪৫টির মতো। সব মিলিয়ে মোদি সরকার যতই 'নয়া ভারত নয়া ভারত' করে লাফাক না কেন, অপরাধের নিরিখে যে ভারত সেই ভারতেই আছে, তা ফের প্রমাণ হয়ে গিয়েছে ন্যাশানাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ২০২২ সালের রিপোর্টে। এই অপরাধময় দেশ কি তবে মোদি সরকারের নয়া অচ্ছে দিন? প্রশ্ন থেকেই যায়।