কলঙ্কিত বাংলা! জালিয়াতিতে রাজ্য দেশের শীর্ষে, বলছে তথ্য, দায় কার?
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্টে জানানো হয়েছে, বাংলা থেকেই সবচেয়ে বেশি জাল নোট ধরা পড়েছে।
বাংলা কি ক্রমাগত কলঙ্কিত হয়ে পড়ছে?
আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে শুরু করে বাংলার গোটা সমাজব্যবস্থা বেশ কিছুদিন হলো রাজনৈতিক টানাপোড়েনে অস্থির। নেতা-মন্ত্রীরা জড়িয়ে পড়ছেন বিপুল টাকার আর্থিক দুর্নীতিতে। গোয়েন্দা অভিযানে কোটি কোটি টাকা উদ্ধার করা হয়েছে বাংলার মন্ত্রী অথবা তাঁদের ঘনিষ্ঠ জনের কাছ থেকে। এদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলছেন, রাজ্যের হাতে টাকা নেই। কারণ কেন্দ্রীয় সরকার প্রাপ্য বকেয়া মেটাচ্ছে না।
এই পরিস্থিতিতে সমস্যা আরও জটিল হয়েছে এবং জাল টাকা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত ও নেপাল সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকিয়ে দিচ্ছে পাচারকারীরা। সেই টাকা পশ্চিমবঙ্গের বাজারে ছড়িয়ে দেওয়ার মরিয়া প্রয়াস চলছে। এ-ব্যাপারে বিএসএফ-এর ভূমিকা নিয়ে এখনও কোনও প্রশ্ন তোলা হয়নি কোনও রাজনৈতিক দলের তরফেই।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র সম্প্রতি প্রকাশিত রিপোর্টে এও জানানো হয়েছে, বাংলা থেকেই সবচেয়ে বেশি জাল নোট ধরা পড়েছে। দেশের সব রাজ্যের থেকে বাংলাতে সর্বাধিক সংখ্যক ভুয়ো নোট বাজেয়াপ্ত হয়েছে, যা সীমান্ত পার করিয়ে ঢোকানো হয়েছে।
আরও পড়ুন: দেড় লক্ষ মানুষের মৃত্যু পথ দুর্ঘটনায়, ট্রাফিক আইন মানছে না দেশ?
শুধুমাত্র জাল টাকাই নয়, ব্যাঙ্ক জালিয়াতিতেও পশ্চিমবঙ্গ দেশের সমস্ত রাজ্যের নিরিখে একনম্বরে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাকে 'সোনার বাংলা'-য় পরিণত করতে বদ্ধপরিকর হলেও বাংলাজুড়ে কার্যত লঙ্কাকাণ্ড চলছে। জাল টাকা আর ব্যাঙ্ক জালিয়াতিতে সারা দেশের মধ্যে এক নম্বর স্থানাধিকারী হওয়া এরই প্রকৃষ্ট নমুনা।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর নথিমাফিক জাল টাকা এবং ব্যাঙ্ক জালিয়াতিতে বাংলা সারা দেশের মধ্যে প্রথম স্থানাধিকারী হলেও রাজ্য সরকার এ-পর্যন্ত কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি। সম্প্রতি ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো যে রিপোর্টটি পেশ করেছে, সেটি ২০২১ সালের। ২০২১ সালেই মিটে গিয়েছে বাংলার বিধানসভা নির্বাচন। রাজ্যে তৃণমূল কংগ্রেস তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় আসার পরে নানা দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলা সরকার তো একেই বিপদে পড়েছে, তার ওপর ২০২১ সালের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো 'মা-মাটি-মানুষ'-এর সরকারের কপালের দুশ্চিন্তা, অস্বস্তির ভাঁজ আরও গভীর করল।
২০২১ সালের হিসেব অনুসারে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো জানিয়েছে, এক বছরে পশ্চিমবঙ্গে জাল নোটের ৭৫টি মামলা নথিবদ্ধ হয়েছে। এছাড়াও ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ৮২টি মামলা নথিবদ্ধ হয়েছে। সারা দেশের অন্য কোনও রাজ্যে এত-সংখ্যক ব্যাঙ্ক জালিয়াতি অথবা জাল নোট-সংক্রান্ত মামলা দায়ের হয়নি। এই মামলাগুলির বর্তমানে কী হাল, সে-ব্যাপারে কোনও তথ্য ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়নি।
তবে সারা দেশের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের পরেই ঠাঁই পেয়েছে বিজেপি-শাসিত অসম। জাল নোট এবং ব্যাঙ্ক জালিয়াতিতে অসম দ্বিতীয়। আর তৃতীয় স্থানাধিকারী রাজ্য তামিলনাড়ু। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বিমুদ্রাকরণ করেছেন সেও কয়েক বছর হলো। বিমুদ্রাকরণ পর্বে বহু মানুষ বিপাকে পড়েছিলেন। পুরনো নোট পাল্টাতে গিয়ে ব্যাঙ্কের লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়াতে রয়েছে নাগরিকদের। আর বয়স্ক নাগরিকদের মধ্যে কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা গিয়েছেন।
বিমুদ্রাকরণের আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘোষণা করেছিলেন, পুরনো নোট বাতিল করা হচ্ছে সব ধরনের সন্ত্রাসবাদকে নির্মূল করতে। এর মধ্যে নকশালবাদী সন্ত্রাসবাদও রয়েছে। জাল টাকা ছড়িয়ে সন্ত্রাসীরা যেন দেশকে বিপন্ন না করতে পারে, সে-কারণেই বিমুদ্রাকরণের সিদ্ধান্ত অতর্কিতভাবে নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন মোদি।
কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হয়নি। মাওবাদী সন্ত্রাসী কার্যকলাপ খানিক কমলেও জম্মু-কাশ্মীর সন্ত্রাসবাদীদের পীঠস্থান হয়ে উঠেছে। ভূস্বর্গে জঙ্গিরা লাগাতারভাবে বহিরাগতদের হত্যা করছে। ফলত, মানুষের হাতে আদর্শের নামে খুন হচ্ছে মানুষই। এদিকে সমঝোতা কিংবা আলোচনার রাস্তা খুলছে না।
একই সঙ্গে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলিতেও জঙ্গি কার্যকলাপ অব্যাহত। আফগানিস্তানে তালিবানরা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। পাকিস্তানের মদতে ভারতে জঙ্গি কার্যকলাপ চলছে এই অভিযোগে মোদি ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারত সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। আফগান সরকারকেও ইতিমধ্যে ভারত সতর্ক করেছে, ভারতের মাটিতে জঙ্গি কার্যকলাপ চালালে পরিণাম ভালো হবে না।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মস্তিষ্কপ্রসূত বিমুদ্রাকরণ যে জাল নোটের কারবারে রাশ টানতে পারেনি, কেন্দ্রীয় সংস্থার রিপোর্ট অনুসারে সেটাই বাস্তব পরিস্থিতি। জাল নোট এবং ব্যাঙ্ক জালিয়াতির নিরিখে ভারতে তৃতীয় স্থানাধিকারী রাজ্য তামিলনাড়ু।
২০২১ সালে অসমে জাল নোটের কারবার এবং ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ৭৫টি মামলা নথিবদ্ধ হয়েছে। এছাড়া তামিলনাড়ুতে এ-সংক্রান্ত ৬২টি মামলা নথিবদ্ধ হয়েছে। এছাড়া ৫৫টি মামলা মহারাষ্ট্রে, ৫৪টি রাজস্থানে, উত্তরপ্রদেশে ৪২টি মামলা দায়ের হয়েছে।
কেন বিপুল পরিমাণ জাল নোটে করোনা পরিস্থিতিতে ছেয়ে গেল বাজার, আর কেনই বা লাগাতার ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, সে-সম্পর্কেও কেন্দ্রীয় সংস্থা ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো কোনও ব্যাখ্যা দেয়নি। ওয়াকিবহাল মহলের প্রশ্ন, তাহলে বিমুদ্রাকরণও কি মোদির আরেকটি ব্যর্থতার নমুনায় পরিণতি পেল?
তবে এর আগেও জাল টাকা অথবা ব্যাঙ্ক জালিয়াতির নিরিখে বাংলা ছিল দেশের অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় এগিয়ে। এর আগেও নেপাল এবং বাংলাদেশ সীমান্তকে ব্যবহার করে বাংলায় ঢোকানো হয়েছে জাল টাকা। পাশাপাশি ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ঘটনাও একইভাবে ঘটেছে। এর আগে এই ধরনের ঘটনার তুলনায় ২০২১ সালে বরং জাল টাকা এবং ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ঘটনা তুলনায় কিছুটা কমেছে।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র পেশ করা তথ্য অনুসারে, ২০২০ সালে বাংলায় জাল নোট বাজেয়াপ্ত হয়েছে ১০৯টি ক্ষেত্রে। এছাড়া ২০১৯ সালে এই রাজ্যে ব্যাঙ্ক জালিয়াতির মামলা ২০৮টি ক্ষেত্রে নথিভুক্ত হয়েছে। এ-সম্পর্কে ২০২১ সালের যে খতিয়ান পেশ করেছে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো তাতে বাংলা শীর্ষে থাকলেও সারা দেশে ব্যাঙ্ক জালিয়াতির এবং জাল টাকার মোট ৬৮৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। এছাড়া ২০২০ সালে ভারতে জাল নোট এবং ব্যাঙ্ক জালিয়াতির ৬৩৭টি মামলা দায়ের হয়েছে।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রিপোর্টে আরও জানা গিয়েছে, ২০২১ সালে সারা ভারতে মোট ৩ লক্ষ ১০ হাজার ৮০টি জাল টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। ২০ কোটি টাকার বেশি জাল নোট বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় সরকারের মদতে একশ্রেণির শিল্পপতি ব্যাঙ্ক জালিয়াতি করেছে বলে অভিযোগ। এ-ব্যাপারে সরব বাংলার শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। এরপর ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র রিপোর্টে বাংলায় এই ধরনের অপরাধের যে খতিয়ান পেশ করা হয়েছে, তাতে রাজ্য সরকারের অস্বস্তিই যে কার্যত বাড়ল, সেকথাও বলার অপেক্ষা রাখে না।