ক্ষুদ্র প্রোটিন রোধ করবে করোনা, ভারতীয় বিজ্ঞানীদের আশ্চর্য আবিষ্কার
এই ধরনের মলিকিউল আগে তৈরি হয়নি, যা এই ভাবে নভেল করোনাভাইরাসে আবদ্ধ হয়ে, তাকে নিষ্ক্রিয় করে।
কম্পিউটেশনের মাধ্যমে এবার খুব ক্ষুদ্র এক ধরনের প্রোটিন বা মিনিপ্রোটিন বানালেন বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স-এর বিজ্ঞানীরা, যা নভেল করোনাভাইরাসের (SARS-CoV-2) সংক্রমণ আটকাতে সাহায্যে করবে। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্সের (IISc) মলিকিউলার বায়োফিজি়ক্স বিভাগের অধ্যাপক ড. জয়ন্ত চ্যাটার্জ্জির তত্ত্বাবধানে এই গবেষণাটি করা হয়েছে। খুব সম্প্রতি যা প্রকাশিত হয়েছে নেচার কেমিক্যাল বায়োলজি নামের সায়েন্টিফিক জার্নালে।
কিন্তু কীভাবে এই প্রোটিনটি ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করে, তা জানার আগে আমাদের জানা প্রয়োজন, নভেল করোনাভাইরাস কীভাবে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে। কারণ সেখানেই লুকিয়ে রয়েছে, ছোট্ট এই প্রোটিনটির কাজের পদ্ধতি।
নভেল করোনাভাইরাস বা একদম বাইরের আবরণে কাঁটার মতো দেখতে স্পাইক প্রোটিন বা S-Protein গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ভাইরাসটির সংক্রমণে। স্পাইক প্রোটিনের সাহায্যে ভাইরাসটি এসে আটকে যায় এসিই-২ রিসেপ্টরে (ACE-2 Receptor)। এসিই-২ রিসেপ্টর আমাদের দেহে বিভিন্ন কোশের বাইরের আবরণে থাকে। বলা যেতে পারে, এসিই-২ রিসেপ্টর একটি দরজা, যা না থাকলে নভেল করোনাভাইরাস আমাদের শরীরে প্রবেশ করতে পারবে না।
আরও পড়ুন: মাঙ্কিপক্স আতঙ্কের আঁচ ভারতেও, যৌন সম্পর্ক থেকেই সংক্রমণ? চিন্তায় চিকিৎসকরা
যখনই এসিই-২ রিসেপ্টরের সঙ্গে তালা-চাবির মতো আটকে যায় স্পাইক প্রোটিন, আর তখনই কেল্লা ফতে! নভেল করোনাভাইরাসের শরীরে প্রবেশের রাস্তা, অর্থাৎ এসিই-২ রিসেপ্টর খুলে যায় তখন। তবে খুব সোজা নয় ভাইরাসের শরীরের কোশে প্রবেশ করার পদ্ধতি। এর জন্য স্পাইক প্রোটিনের একটি ছোট অংশই মূল ভূমিকা পালন করে।
ইন্সক্রিপ্ট-কে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে ড. জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, "এই ছোট অংশটির নাম রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেন, যা থাকে স্পাইক প্রোটিনের একদম মাথায়।" নাম শুনেই স্পষ্ট হয়ে যায়, যে এই ডোমেনই এসিই-২ রিসেপ্টরের সঙ্গে যুক্ত হয়, যার ফলে ভাইরাসটির কোশের ভেতরে প্রবেশের দরজা খুলে যায়।
নতুন এই মিনিপ্রোটিনটি রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেনে বসে, সেই জায়গা দখল করে নেয়। এর আগে, "একটি মিনিপ্রোটিনের সঙ্গে আরও একটি মিনিপ্রোটিন এসে যুক্ত হয়ে ডাইমার তৈরি করে। এই ডাইমারই রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইন দখল করে নেয়", জানাচ্ছেন এই পেপারের ফার্স্ট অথর ভবেশ খত্রি।
এর ফলে রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেন আর এসিই-২ রিসেপ্টরে যুক্ত হতে পারে না, কারণ সেখানে বসে আছে মিনিপ্রোটিন। আর তা হয় না বলেই এসিই-২ রিসেপ্টর অর্থাৎ ভাইরাসটির দেহকোশে প্রবেশের দরজাও খোলে না।
যে কোনও প্রোটিনই তৈরি হয় পলিপেপটাইড চেন দিয়ে, আবার পলিপেপটাইড চেনগুলিতে থাকে অসংখ্য অ্যামাইনো অ্যাসিড। অ্যামাইনো অ্যাসিডকে বলা হয় প্রোটিনের গঠনগত একক। এই মিনিপ্রোটিনটিতে রয়েছে পলিপেপটাইড চেইন, "যার মাত্র আটত্রিশটি অ্যামাইনো অ্যাসিড আছে। যেখানে সাধারণত অন্যান্য প্রোটিনে অনেক বেশি অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে। কিন্তু এই পলিপেপটাইড চেনের মূল বৈশিষ্ট্য হলো, প্রোটিনের মতো বেশ কিছু জটিল রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য দেখায়। যা আবার অন্যান্য ছোট ছোট পলিপেপটাইড চেনের ক্ষেত্রে দেখা যায় না", জানাচ্ছেন ড. চট্টোপাধ্যায়। "এই কাজের মূল ধারণা আসে ডেভিড বেকারের একটি কাজ থেকে। যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০২০ সালে। যেহেতু তিনিও এই বৈশিষ্ট্যগুলির জন্যই একে মিনিপ্রোটিন নাম দিয়েছিলেন। আমরাও সবকিছু মাথায় রেখে, একে মিনিপ্রোটিন নাম দিয়েছি।"
“এই গবেষণাটির নতুনত্ব এখানেই যে, এরকম প্রোটিন বা অন্য মলিকিউল আগে কখনও তৈরি হয়নি, যা এই ভাবে নভেল করোনাভাইরাসের সঙ্গে এইভাবে আবদ্ধ হয়ে, ভাইরাসের সংক্রমণ আটকাবে”, বললেন ড. চট্টোপাধ্যায়। কোভিড ভ্যাকসিনে থাকা অ্যান্টিবডিও ভাইরাসের আক্রমণকে প্রতিহত করে। এমনকী, অ্যান্টিবডিগুলি যেভাবে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে আবদ্ধ হয়, সেই আবদ্ধ হওয়ার ধরণের থেকেও এই মিনিপ্রোটিনের আবদ্ধ হওয়ার ধরন একেবারেই আলাদা।
ভাইরাসের জিনে রাসায়নিক পরিবর্তন বা মিউটেশন হলে, নতুন ভ্যারিয়েন্ট ও সাব-ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে স্পাইক প্রোটিনের গঠনেও পরিবর্তন আসে। আর ভ্যাকসিনের থাকা অ্যান্টিবডিগুলি বানানো হয় এমন করে, যাতে ঠিক তালা-চাবির মতো খাপে খাপে তারা স্পাইক প্রোটিনের সঙ্গে বসে যেতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই মিউটেশনের ফলে স্পাইক প্রোটিনে পরিবর্তন এলে, অ্যান্টিবডি স্পাইক প্রোটিনে আবদ্ধ হতে সমস্যা হতে পারে। সেক্ষেত্রে কোভিডের ভ্যাকসিন কার্যকর না-ও হতে পারে কিংবা কোভিড ভ্যাকসিনে আবার পরিবর্তন আনতে হতে পারে।
সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠে আসে, মিউটেশনের ফলে যদি স্পাইক প্রোটিনে রাসায়নিক বদল আসে, মিনিপ্রোটিনগুলির আবদ্ধ হতে সমস্যা দেখা যাবে কি না এবং সেক্ষেত্রে এদেরও পরিণতি কোভিডের ভ্যাকসিনের মতো হবে কি না। ড. চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, "স্পাইক প্রোটিন বদল এলে, এই মিনিপ্রোটিনটির ভাইরাসের সঙ্গে যুক্ত হতে সমস্যা দেখা দিতে পারে।" সেখানেই মিনিপ্রোটিনটির ভ্যাকসিনের সঙ্গে কোনও তফাৎ নেই।
তিনি আরও জানাচ্ছেন, "যদিও একাধিক সর্বভারতীয় সংবাদপত্র লিখেছে, এই মিনিপ্রোটিনটি ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যাবে বা ভ্যাকসিনের বিকল্প হিসেবে এবং কোভিড নিরাময়ের অব্যর্থ ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে, তা কিন্তু একেবারেই সঠিক নয়। এই মিনিপ্রোটিন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্যও নির্বাচিত হবে না। এমনকী, নতুন এই মিনিপ্রোটিন নভেল করোনাভাইরাসের আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্টের (B.1.351) সঙ্গেও সঠিকভাবে আবদ্ধ হয়ে, তাকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে না।"
তবে এই ধরনের মলিকিউল আগে তৈরি হয়নি, যা এই ভাবে নভেল করোনাভাইরাসে আবদ্ধ হয়ে, তাকে নিষ্ক্রিয় করে। ড. চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, "কোভিডের অব্যর্থ ওষুধ এটি না হলেও, আগামীতে ক্যানসারের মতো একাধিক কঠিন রোগের চিকিৎসায় মিনিপ্রোটিনটিকে ব্যবহার করা যাবে।"