রাজবাড়ির প্রতিটি ইটে জীবিত ইতিহাস, এখনও রোমাঞ্চের ঠিকানা ইটাচুনা

রাজবাড়ির প্রায় কুড়িটিরও বেশি ঘর খুলে দেওয়া হয়েছে অতিথিদের জন্য আর আপনি যদি ইট-কাঠ-পাথরের বেড়াজালে পেরিয়ে পল্লিগ্রামের স্বাদ আস্বাদন করতে চান, তবে আপনার সেই ইচ্ছেও পূরণ করবে রাজবাড়িতে অবস্থিত ছোট ছোট ‘মাড হাউসগুলি’।

সারা সপ্তাহজুড়ে দশটা-পাঁচটার অফিস করার পর, সপ্তাহের শেষের দুটো দিন আর বাড়িতে থাকতে যেন মন চায় না। লকডাউন আর করোনার সঙ্গে সঙ্গেই অগুনতি ছুটির দিনও বিদায় নিয়েছে মানুষের জীবন থেকে। এখন আবার লকডাউনের পর চাইলেও ছুটি মেলা ভার। তাই এক-দু’দিনের ছুটি কাটানোর জন্য আপনার হাতে শেষ অপশন কলকাতার আশপাশে কোনও এক জায়গা। সেরকমই একটি আদর্শ ট্রাভেল ডেস্টিনেশন হল হুগলির ইটাচুনা রাজবাড়ি। চলুন, তবে জেনে নেওয়া যাক এই রাজবাড়ি-সংক্রান্ত যাবতীয় খুঁটিনাটি তথ্য।

রাজবাড়ির ইতিহাস
বাংলায় তখন দফায় দফায় চলছে বর্গি আক্রমণ। নবাব আলিবর্দি খাঁ-এর অনুপস্থিতিতে অসংখ্য গ্রাম তখন বর্গি আক্রমণের জেরে কার্যত শ্মশানভূমিতে পরিণত হয়েছে, সেসব চিতা যেন নিভতেই চায় না। নবাব আলিবর্দি খাঁ সেবার বাংলাকে বাঁচাতে ছলেবলে-কৌশলে বর্গি নেতা ভাস্কর পণ্ডিতের শিরশ্ছেদ করলেন ঠিকই, কিন্তু তাতে লাভ প্রায় কিছুই হলো না বললেই চলে। অবশেষে বর্গি সমস্যার মীমাংসা এল মারাঠাদের সঙ্গে নির্মিত সন্ধির হাত ধরে। বর্গি আক্রমণের ফলে বাংলা পেয়েছিল ‘মারাঠা ডিচ’ আর পেয়েছিল এই ইটাচুনা রাজবাড়ি।

মনে পড়ে ১২০২ অব্দে বাংলায় তুর্কি আক্রমণের কথা? ইতিহাস বলে, আক্রমণের পর বেশ কিছু বছর ধরে তুর্কিরা প্রচণ্ড তাণ্ডব চালালেও ক্রমে তারা বাংলার সংস্কৃতিকে ভালবেসে বাঙালিতে পরিণত হয়েছিল , বাংলার রমণীদের নিয়ে দিব্য ঘরকন্না করেছিল তারা। হুগলির ইটাচুনা রাজবাড়ির কাহিনিও খানিক সেরকমই। মারাঠাদের সঙ্গে সন্ধির পর বর্গি সেনাবাহিনী উড়িষ্যায় ফিরে গেলেও বাংলার মোহে বাঁধা পরে যান রাধামাধব কুন্দ্রা নামে একজন মারাঠা সৈন্য। লুঠ করা ধনসম্পত্তি এবং চাষবাস থেকে উপার্জিত অর্থ নিয়ে তিনি ইটাচুনা গ্রামে নিজের পাকাপাকি জমিদারি স্থাপন করেন। বাংলায় থাকতে থাকতে পুরোদস্তুর বাঙালি হয়ে গেলেন তিনি এবং তাঁর পরিবার। কুন্দ্রা বদলে তাঁরা হয়ে গেলে কুণ্ডু। সেই থেকে আজ অবধি ইটাচুনা রাজবাড়ির দেখাশুনা করছে এই মারাঠা কুণ্ডু পরিবার। ১৭৬৬ সালে এই কুণ্ডু পরিবারের অন্যতম সদস্য সাফল্যরাম কুণ্ডু প্রায় ২০ বিঘা জমির উপর গড়ে তোলে এক বিশাল জমিদারবাড়ি, যা আজকের দিনে ইটাচুনা ‘রাজবাড়ি’ নামেই অধিক জনপ্রিয়। যেহেতু এই রাজবাড়ির ইতিহাস জুড়ে ছড়িয়ে আছে বর্গিরাই, সেই কারণে স্থানীয় বাসিন্দারা অনেকেই আবার এই প্রাসাদকে ‘বর্গিডাঙা’ নামে ডেকে থাকেন।

আরও পড়ুন: মারাঠা বর্গী হয়ে উঠেছিলেন বাংলার জমিদার || গা ছমছমে গল্প জড়িয়ে এই রাজবাড়ির সঙ্গে

এবার আসা যাক, এই রাজবাড়ির নাম 'ইটাচুনা' কেন হল? অনেকেই বলে থাকেন, ইট এবং চুনের সমন্বয়ে এই রাজবাড়ি নির্মিত হয়েছিল বলে এর নাম রাখা হয় ইটাচুনা। কথাটা যে একেবারে ভুল, তা নয়। তবে ইটাচুনা একটা গোটা গ্রামের নাম ছিল। রাজবাড়ির ম্যানেজারের কথায়, হুগলির এই অঞ্চলের জলাশয়ে একসময়ে অসংখ্য শামুকের দেখা মিলত। সেই শামুকের খোলস থেকে এলাকার মানুষের ঘরে গড়ে উঠতে থাকে চুনশিল্প। অন্যদিকে আবার সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শামুকের অভাব দেখা দিতে থাকায়, মাটি খুঁড়ে বানানো হয় নতুন নতুন সব জলাশয়। এখন প্রশ্ন ওঠে এত বাড়তি মাটি দিয়ে এলাকার মানুষ করবে কী? এই চিন্তা থেকেই তৈরি হল ইটভাটা। চুন এবং ইট– এই দু'টি শিল্প থেকেই, জনমানবের কাছে এই অঞ্চল পরিচিতি লাভ করতে থাকল ইটাচুনা নামে আর সেই গ্রামের জমিদারবাড়ির নামকরণেও যে তার অন্যথা হবে, তা কেমন করে সম্ভব!

কীভাবে পৌঁছবেন এই রাজবাড়িতে?
আপনি যদি গাড়ি নিয়ে যান, তবে আপনাকে কলকাতা থেকে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে ধরে হালসুই হয়ে পৌঁছে যেতে হবে খন্যান স্টেশনে। এখান থেকে মাত্র ১০ মিনিটের দূরত্বেই ইটাচুনা অবস্থিত। ট্রেনে করে আসলে যে কোন বর্ধমান লোকাল ধরে নেমে পরতে হবে খন্যান রেলস্টেশনে। তারপর স্টেশন থেকে টোটো করে অতি সহজে, অল্প সময়েই আপনি পৌঁছে যাবেন আপনার গন্তব্যে।

এই রাজবাড়ির বর্তমান সদস্যরা, নতুন রূপে রাজবাড়িটিকে সাজিয়েছেন। এখন রাজবাড়ি ভ্রমণকারীরা চাইলেই সেখানে রাত্রিযাপন করতে পারেন। রাজবাড়ির প্রায় কুড়িটিরও বেশি ঘর খুলে দেওয়া হয়েছে অতিথিদের জন্য আর আপনি যদি ইট-কাঠ-পাথরের বেড়াজালে পেরিয়ে পল্লিগ্রামের স্বাদ আস্বাদন করতে চান, তবে আপনার সেই ইচ্ছেও পূরণ করবে রাজবাড়িতে অবস্থিত ছোট ছোট ‘মাড হাউসগুলি’। রাজবাড়ির ভেতরের ঘরগুলি একদিকে যেমন সাজানো হয়েছে জমিদার আমলের রাজকীয় সব পালঙ্ক আর আসবাব দিয়ে, তেমনভাবেই সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই এসি কিংবা গিজারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে। প্রতিটা ঘরের জন্য রাখা হয়েছে আলাদা আলাদা নাম। অতীতের যৌথ পরিবার ব্যবস্থার কথা মাথায় রেখেই সম্ভবত নামগুলো সাজিয়েছেন রাজবাড়ির সদস্যরা। অন্যদিকে মাড হাউসগুলি আবার খুবই ছিমছামভাবে সাজানো হয়েছে তবে এসি, গিজারের সুবিধা আপনি এক্ষেত্রেও পাবেন। মাড হাউসের নামকরণ করা হয়েছে ফুলের নাম অনুসারে এবং অতিথিদের বোঝার সুবিধের জন্য প্রতিটা ঘরের সামনে পোতা রয়েছে সেই ফুলগাছটি।

রাজবাড়িতে দুপুরের এবং রাত্রের খাবার পরিবেশন করা হয় কাঁসার থালাবাসনে। খাবার ঘরে আলো ঝলমলে বিরাট ঝাড়বাতিখানা দেখার মতো। এখানে মূলত থালি সিস্টেমে খাবার পরিবেশন করা হয়, এর সঙ্গে আপনি চাইলে মাছের এবং মাংসের বিভিন্ন আইটেমগুলি আলাদা করে অর্ডার করতে পারবেন। বলে রাখা ভালো, আপনি কিন্তু নিজের ঘরে খাবার নিয়ে গিয়ে খেতে পারবেন না সেক্ষেত্রে খাবার জায়গাতেই আপনাকে আসতে হবে।

অতীত দিনের প্রথা মেনেই এই বাড়ির অন্দরমহল এবং বহির্মহল সম্পূর্ণ আলাদা। কাছারিবাড়ি, হিসেবের ঘর পেরিয়ে তবে অন্দরমহলে পা রাখা যায়। এছাড়াও রয়েছে এক বিশাল নাচঘর, রয়েছে এক রূপোর পালকি, যা চড়ে গৃহদেবতা দোল উৎসব দেখতে যান। বসার ঘরের ঝাড়লন্ঠনটি ইটাচুনার অন্যতম আকর্ষণীয় ঐতিহ্য। গৃহদেবতার সন্ধ্যারতির একটানা কাঁসি ঘণ্টার শব্দে সন্ধ্যা নামে রাজবাড়িতে। আপনি যদি কখনো ইটাচুনা রাজবাড়িতে যান, তবে সন্ধ্যারতি দেখতে কিন্তু ভুলবেন না।

২০ বিঘা জমির উপর অবস্থিত বিশাল রাজবাড়িতে দেখার মতো, কিংবা বলা ভালো উপলব্ধি করার মতো আরও বহু জিনিস রয়েছে। ভাষায় আসলে অনেক কিছুই প্রকাশ করা যায় না, আর ঠিক সেই কারণেই বাকি জিনিসের হদিশ পেতে হলে আপনাকে সশরীরে পা রাখতে হবে ইটাচুনা রাজবাড়িতে। তবে রাজবাড়িতে রাত্রিযাপন করতে হলে আগে থেকে তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে বুকিং করে তবেই যেতে হবে। খাবার-সমেত একদিন থাকার জন্য দু'জনের খরচ পরতে পারে কম-বেশি পাঁচ হাজার টাকা। পুজোর পর থেকে শীতকাল অবধি ভাড়ার অঙ্ক খানিক বেড়ে যায়।

 

More Articles