চিনতে অস্বীকার করেছিলেন মেরি কম, সোনাজয়ী নিখাত আর লক্ষ মেয়ের অনুপ্রেরণা

প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরূদ্ধে সোনার মেয়ের লড়াই তাঁকে পৌঁছে দিল সর্বসেরার দলে।

ভারতীয় ক্রীড়া ইতিহাসে নতুন পালক। শেষ সপ্তাহে ভারতের থমাস কাপ জয় এবং এই সপ্তাহে ভারতীয় বক্সার নিখাত জারিনের সোনা - স্বপ্নের দিন কাটছে । হায়দরাবাদের নিখাত জারিন মহিলা বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে সোনার পদক জিতে ইতিহাস রচনা করলেন। নিখাত পঞ্চম ভারতীয় মহিলা এবং এবছর টুর্নামেন্টে প্রথম মহিলা যিনি এই পদক ছিনিয়ে নিলেন। ভারতীয় বক্সার নিখাত জারিন তুরস্কের ইস্তাম্বুলে বৃহস্পতিবার ৫২ কেজি বিভাগের ফাইনালে থাইল্যান্ডের জিতপং জুটামাসকে ৩০-২৭, ২৯-২৮-এ পরাজিত করে সোনার পদক জিতেছেন। রাষ্ট্রপতি থেকে সাধারণ ভারতীয় ক্রীড়াপ্রেমী মানুষ নিখাতের জয়ে উচ্ছ্বসিত সকলেই। কিন্তু বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পথে বাঁধা এসেছে বহু।তবে প্রতিকূল পরিস্থিতির বিরূদ্ধে সোনার মেয়ের লড়াই তাঁকে পৌঁছে দিল সর্বসেরার দলে।


নিখাত জারিন কে?


নিখাত জন্ম ১৯৯৬ সালে ভারতের তেলেঙ্গানার নিজামবাদ শহরে ।ছোট থেকে কিন্তু বক্সিং নয় বরং ১০০ ও ২০০ মিটার দৌড় প্র্যাকটিস করত সে তবেঅনেক ছোট থেকে শিরোনামে উঠে এসেছেন এই মেয়ে। ২০১১ সালে ৫০ কেজি বিভাগে বিশ্ব জুনিয়র বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে প্রথম নজর কেড়েছিল এই মেয়ে। আমেরিকান কোচ রন সিমসের কাছে বিজয়নগরের ইন্সপায়ার ইনস্টিটিউট অফ স্পোর্টসে প্রশিক্ষণ নেন নিখাত। ২০১৯ সালে থাইল্যান্ড বক্সিং টুর্নামেন্টে রৌপ্য পদক জিতেছিলেন নিখাত। ২০১৯ এশিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ এবং সেই বছরেই স্ট্র্যান্ডজা মেমোরিয়াল টুর্নামেন্টে স্বর্ণ পদক জেতেন তিনি।ফের ২০২২ সালের স্ট্র্যান্ডজা মেমোরিয়ালে স্বর্ণপদক জিতেছিলেন। তবে ১৯ মে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জয় নিখাতকে লাইমলাইটে এনে দিয়েছে। মেরি কম, সরিতা দেবী, জেনি আরএল এবং লেখা কেসির পর নিখাত পঞ্চম মহিলা যিনি এই পদক জিতলেন। ২০১৮ সালে মেরি কমের পর প্রথম মহিলা হিসেবে নিখাতের স্বর্ণপদক নিঃসন্দেহে মানুষের উল্লাস বাড়িয়ে তুলেছে।

 

মেরি কম: অনুপ্রেরণা ও বিতর্ক


নিখাত বরাবরই স্বীকার করেছেন যে তিনি মেরি কমের খুব বড় ভক্ত। কিন্তু ২০২০ সালে মেরি কম ও নিখাতের বিতর্কের কথা ক্রীড়াপ্রেমীদের অনেকেই হয়তো ভোলেন নি। সে বছর টোকিও অলিম্পিক বাছাইপর্বের ম্যাচে জয়লাভ করেছিলেন মেরি কম।তবে সবশেষে বিপক্ষের সাথে প্রথাগত হ্যান্ডশেক বা আলিঙ্গন না করায় জনসমক্ষেই সমালোচনা করেছিলেন নিখাত। তিনি জানিয়েছিলেন যে পেশাদার ম্যাচের শেষে তিনি আলিঙ্গন করতে চাইলে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন মেরি কম তা করেননি। আরো বলেন যে একজন সিনিয়রের কাছে আপনি আশা করেন যে সেও তার জুনিয়ারদের যথেষ্ট সম্মান দেবে। উল্টে খারাপ শব্দ নাকি প্রয়োগ করেছিলেন মেরি কম, এমনটাই দাবি করেছিলেন নিখাত। প্রত্যুত্তরে মেরি কম বলেছিলেন,' পারফর্ম করে আমার জায়গাটা ছিনিয়ে নাও।তোমাকে কে বাধা দিচ্ছে? আমি কোন বিতর্ক একেবারেই পছন্দ করি না। নিজেকে বক্সিং রিংয়ের ভিতরে প্রমাণ করো।' ২০১৯ সালে মেরি কম সরাসরি বলেছিলেন,' কে নিখাত জারিন? আমি চিনি না ওকে'।

 

ম্যাচ শেষে প্রেস কনফারেন্স উচ্ছসিত নিখাত প্রশ্ন করেন, আমি টুইটারে ট্রেন্ডিং করছি? ২৫ বছর বয়সী নতুন এই বক্সিং স্টার নিজেই ট্যুইট করে লিখেছেন, 'অবশেষে এই পদক। দীর্ঘ সময় ধরে কঠোর পরিশ্রম এবং ধৈর্য্যের ফল। ভারত এই পদক তোমার জন্য।আমরা করে একসাথে করে দেখিয়ে দিয়েছি '। নিখাতের বাবা নিজেও একজন খেলোয়াড় ছিলেন। মেয়ের জয়ে বাবার কথায় উঠে এসেছে কীভাবে ছোট পোশাকের জন্য তাঁর ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে কথা শুনতে হয়েছে নিখাতকে। সাথে শুনতে হয়েছিল বক্সিং মেয়ে নয় ছেলেদের খেলা। তবে আজ সবকিছুরই যোগ্য জবাব দিয়েছে সোনার মেয়ে নিখাত। নিখাতের বাবা জামিল বলেছেন যে তাঁর মেয়ে ভবিষ্যৎ মুসলিম মেয়েদের কাছে অনুপ্রেরণা হয়ে উঠবে। তাঁদের নতুন করে বড় স্বপ্ন দেখতে সাহস জোগাবে নিখাত। মার্চ মাসে একটি সাক্ষাৎকারে নিখাত বলেছিলেন, আমি প্রমাণ করতে চাই মেয়েরাও পারে বক্সিং করতে'।


স্বপ্নের এই জয়ের পর নিখাত নিজেও চোখের জল ধরে রাখতে পারেন নি। রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোভিন্দ,প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ, ক্রীড়াজগতের সচিন তেন্ডুলকর ,অভিনেত্রী তাপসী পান্নু সকলেই শুভেচ্ছা বার্তায় ভরিয়ে দিয়েছেন নিখাতকে। ভারতীয় বক্সিং ফেডারেশনও শুভেচ্ছা জানিয়েছে সোনার মেয়েকে। নিখাতের একসময়ের কোচ চিরঞ্জীব সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন,' ওর সবচেয়ে বড় শক্তি হল ইচ্ছাশক্তি। রিংয়ের ভিতর ওর বুদ্ধি, সংযম এবং বিপক্ষকে বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা ওকে জয় পেতে সাহায্য করেছে '। ২০১৭ সালের চোটের পর ঘুরে দাঁড়িয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখেছেন তিনি। করোনা আবহেও অনুশীলন বন্ধ করেননি নিখাত। এখন চোখ ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকের দিকে। এখন সেই টুর্নামেন্টের দিকেই নজর থাকবে দেশবাসীর।

More Articles