আবার প্রতারণা নীতীশের! যেভাবে এগোয় পল্টুরামের পাল্টির কিসসা
Nitish Kumar Resigns : এক দশকে এই নিয়ে পঞ্চম ডিগবাজি খেলেন নীতীশ। বিহারের পল্টুরাম বলছেন, বিরোধী জোটে কেউ নাকি কোনও কাজ করছিল না।
সবাই জানেন তিনি ডিগবাজি মাস্টার। সবাই জানে তিনি আজ এ-ডালে, কাল ও-ডালে। সবাই জানে তিনি ক্ষমতায় থাকতে যে কোনও মুহূর্তে রঙ বদলাতে পারেন। তবু, প্রতিবারই সকলে নতুন করে অবাক হয়! নীতীশ কুমার ২০২৪ সালে নতুন করে ইস্তফা দিয়ে ফের নতুন করে তাজ্জব করে দিয়েছেন রাজ্যবাসীকে, দেশবাসীকে। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন নীতীশ কুমার। বেশ কিছুকাল ধরেই শোনা যাচ্ছিল, বিজেপির সঙ্গেই জোটে ফিরতে চলেছেন নীতীশ। এদিকে তিনি বিজেপি বিরোধী 'ইন্ডিয়া' জোটেরও শরিক ছিলেন। তাহলে জনতা দল ইউনাইটেড কি আর ইন্ডিয়াপন্থী নয়? রবিবার সকাল সকাল রাজ্যপালের অফিসে গিয়ে পদত্যাগপত্র জমা দেন নীতীশ। বুঝিয়ে দেন ২৮ টি দলের বিরোধী শিবির 'ইন্ডিয়া' থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। হাত ধরবেন বিজেপিরই। শোনা যাচ্ছে, নীতীশ কুমার লালু যাদবের দল রাষ্ট্রীয় জনতা দলের (আরজেডি) মন্ত্রীদের বরখাস্ত করার পরিকল্পনা করছেন।
আগামী তিন মাসের মধ্যে লোকসভা নির্বাচন হবে। বিজেপি এবং নীতীশ কুমারের জনতা দল (ইউনাইটেড), বা জেডি(ইউ) এই লোকসভা নির্বাচনের জন্য আসন ভাগাভাগির চুক্তিও চূড়ান্ত করে ফেলেছে। বিহারের সমস্ত বিজেপি বিধায়ক ইতিমধ্যেই নীতীশ কুমারকে সমর্থন জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন। বিজেপির হাত ধরে নীতীশই ফের মুখ্যমন্ত্রী হবেন বিহারের। শোনা যাচ্ছে, বিজেপির সম্রাট চৌধুরী, বিজয় সিনহা, এই দু'জন বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী হতে চলেছেন। নীতীশ কুমার রবিবার বিকেলেই বিজেপির জোটসঙ্গী হয়ে শপথগ্রহণ করবেন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে।
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার পদত্যাগ করার পরে, কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়্গে বলেছেন, তিনি জানতেন এটাই ঘটবে। বলছেন "দেশে 'আয়া রাম-গয়া রাম'-এর মতো অনেক লোক রয়েছে। নীতীশ কিন্তু এই ডিগবাজি দলের সেরার সেরা একথা মানতেই হবে। একবার, দু'বার, তিনবার নয়। নীতীশ কুমার এই নিয়ে অষ্টমবার বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। এই নীতীশ কুমারই বিরোধীদের 'ইন্ডিয়া' জোটের অন্যতম মুখ্য মুখ ছিলেন। কিন্তু কংগ্রেস চাইছিল মল্লিকার্জুন খাড়্গে দেশের প্রধানমন্ত্রী মুখ হন। নীতীশের মতো রাজনীতিবিদ যেখানে আছেন, যিনি ক্ষমতায় থাকতে হামেশাই সঙ্গী বদলান তিনি ইন্ডিয়া জোটের বাকি পাঁচটা দলের মতো থেকে যাবেন এমন সমীকরণ করাটাই ভুল ছিল সম্ভবত।
নীতীশ কুমার এনডিএ-তে যোগ দিলে বিহারের বিধানসভার সমীকরণই বদলে যাবে। আরজেডি বর্তমানে ২৪৩ সদস্যের বিহার বিধানসভায় একক বৃহত্তম দল, যার ৭৯ জন বিধায়ক রয়েছে। কিন্তু অর্ধেক আসন অর্থাৎ ১২২-এর থেকে ৪৩ টি কম আসন তাদের। ৭৮ জন বিধায়ক নিয়ে বিধানসভায় বিজেপি দ্বিতীয় বৃহত্তম দল। আরজেডির ৭৯ জন বিধায়ক, বিজেপির ৭৮ জন বিধায়ক, জেডি(ইউ)-এর ৪৫ জন, কংগ্রেসের ১৯ জন, সিপিআই (এম-এল)-এর ১২ জন, হিন্দুস্তানি আওয়াম মোর্চা (ধর্মনিরপেক্ষ)-র ৪ জন, সিপিআই-এর ২ জন, সিপিআই(এম)-এর ২ জন, এআইএমআইএম-এর ১ জন এবং নির্দল ১ জন।
আরও পড়ুন- ‘পুরুষ রোজ রাত কো…’ বিধানসভায় যৌনশিক্ষা নিয়ে বলতে গিয়ে কেন বিপাকে নীতীশ?
এক দশকে এই নিয়ে পঞ্চম ডিগবাজি খেলেন নীতীশ। বিহারের পল্টুরাম বলছেন, বিরোধী জোটে কেউ নাকি কোনও কাজ করছিল না। "আমি অনেক কিছু করেছি। আমি একটি বিরোধী জোট গঠন করেছি কিন্তু কেউ কাজ করছে না। মানুষজন বিরক্ত হয়ে যাচ্ছেন," বলছেন নীতীশ। নীতীশের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, দল যাই হোক, জোটে যেই আসুক, মুখ্যমন্ত্রী হবেন তিনিই। এই যে রবিবার তিনি মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন, বিজেপির হাতে হাত রেখেছেন, এর পরেও মুখ্যমন্ত্রী থাকবেন তিনিই, নবম বার শপথ নেবেন একই পদে।
১৯৯৪ সালে নীতীশ তৎকালীন জনতা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জর্জ ফার্নান্দেজের সঙ্গে সমতা পার্টি গঠন করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি বিজেপিতে চলে যান এবং অটল বিহার বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হন। ২০০৩ সালে শরদ যাদব এবং লালু প্রসাদ যাদব জোট ভেঙে আরজেডি গঠন করেন। নীতীশ ঠিক করেন তাঁর সমতা পার্টিকে জনতা দলের সঙ্গে মিলিয়ে দেবেন এবং নতুন জোটের নাম হবে জনতা দল (ইউনাইটেড)।
নরেন্দ্র মোদি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর থেকে এক দশকের বহুবার দল বদলেছেন নীতীশ। ২০১৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদিকে যখন বিজেপি প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী করে, তখন নীতীশ এই সিদ্ধান্তের নিন্দা করে বলেছিলেন তাঁর দল ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে। ২০১৫ সালের বিহার বিধানসভা নির্বাচনের আগে নীতীশ তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী লালু প্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দল এবং কংগ্রেসের সঙ্গে প্রথম 'মহাগঠবন্ধন জোট' গঠন করেন। এই মহাজোট ১৭৮টি আসনে জয়লাভ করে এবং সরকার গঠন করে।
২০১৭ সালেই IRCTC কেলেঙ্কারিকে ঘিরে এই 'মহাগঠবন্ধন' ত্যাগ করেন নীতীশ। জোট ছেড়ে আবার এনডিএ-তে যোগ দেন এবং বিজেপির সমর্থনে আবারও মুখ্যমন্ত্রী হন। তখনই আরজেডি নেতারা নীতীশকে প্রথম 'পল্টুরাম' বলে ডাকতে শুরু করেন।
২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনের পরে এই জোটটির সঙ্গেও সমস্যা হয় নীতীশের। বিজেপি নীতীশ কুমারকে মুখ্যমন্ত্রী করতে চায়নি কারণ জেডিইউ-এর বিধানসভা আসন ২০১৫ সালে ছিল ৭১, ২০২০ তে তা কমে দাঁড়ায় ৪৩!। অন্যদিকে বিজেপির আসন ৫৩ থেকে বেড়ে হয় ৭৪। নীতীশ আশঙ্কা করেছিলেন যে বিজেপি জেডি(ইউ) নেতা এবং তৎকালীন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আর.সি.পি. সিংকে ব্যবহার করে তাঁর দল ভাঙাতে পারে।
২০২৪ সালের নীতীশের মূল সমস্যা হয় আরজেডির সঙ্গেই। লালুর কন্যা রোহিণী আচার্য নীতীশের 'পারিবারিক রাজনীতি' মন্তব্যের জন্য নিন্দা করেন। বলেন, হাওয়া যেদিকে বয় নীতীশের আদর্শ সেদিকেই বেঁকে যায়। সেই থেকেই শুরু হয় তিক্ততা। সূত্র বলছে, ইন্ডিয়া জোটের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, বিশেষত কংগ্রেসের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগের সঙ্কটই নীতীশের এই পদক্ষেপের মূল কারণ। আসন ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা করতে ঢিলেমি এবং বিরোধী জোটের নেতা হিসাবে নীতীশ কুমারকে তুলে না ধরার জন্যই বিজেপির হাত ধরলেন পল্টুরাম।
নীতীশ কুমারের জেডিইউ এবং বিজেপি ২০১৯ সালে বিহার লোকসভা নির্বাচনে জিতেছিল৷ কর্পুরী ঠাকুরকে ভারতরত্ন দেওয়ার কথা এবং নীতীশের আবার এনডিএ-র সঙ্গে বন্ধুত্ব সব একই সারিতে৷ বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কর্পুরী ঠাকুরকে যেই ভারতের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান ভারতরত্ন প্রদান করার সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় জনতা পার্টি, তারপরেই নীতীশ নিজের আনুগত্য পরিবর্তনের দিকে ঝোঁকেন। নীতীশ কুমার ১৯৯৬ থেকে এই দলবদলের ধারা জারি রেখেছেন। কিন্তু নিজের রেকর্ড ভাঙতে দেননি। নবমবারের মতো মুখ্যমন্ত্রীর আসনটি নিজের কাছেই ধরে রাখছেন নীতীশ।