হাওয়াই চটি বনাম পল্টুরাম || দেশে বিজেপি বিরোধী মুখ হিসেবে বেশি এগিয়ে কে?
Nitish Kumar Vs Mamata Banerjee: ৫ সেপ্টেম্বর থেকে দিল্লিতে একের পর এক বিরোধী দলের, অর্থাৎ বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী।
দিল্লি যাবেন ‘হাওয়াই চটি’! নাকি দিল্লি যাচ্ছেন ‘বিহারি পাল্টি’! দেশের রাজনৈতিক অলিন্দে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে এই স্লোগান। কেউ কেউ বলছেন, চিরাচরিত বিহারি-বাঙালি ঠান্ডাযুদ্ধ এবার দিল্লি নিয়েও। আসলে এই লড়াই দিল্লির মসনদ নিয়ে। দেশের রাজত্বের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। কেন উঠছে এই প্রশ্ন? সম্প্রতি স্বাধীনতার মাস অগাস্টের প্রথম সপ্তাহেই ফের পরিবর্তিত হন নীতীশ কুমার। বন্ধু বিজেপির সঙ্গ ছেড়ে হাত ধরেন লালু-পুত্র তেজস্বী যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের। পুরনো শত্রুর সাহায্যে ১০ অগাস্ট অষ্টমবারের জন্য বিহারের মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেন নীতীশ। তারপর থেকেই শুধু বিহার নয়, দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শুরু হয়েছে জল্পনা। তাহলে কি একদা নরেন্দ্র মোদির কট্টর সমালোচক, পরবর্তীকালে বন্ধু নীতীশই ২০২৪-এ মোদির প্রতিদ্বন্দ্বী! পোড়খাওয়া রাজনীতিক 'পল্টুরাম' ফের কঠিন লড়াই দেবেন বিজেপিকে! প্রশ্ন আর জল্পনার মধ্যেই আলোচনার অবকাশ সৃষ্টি করেছেন নীতীশ কুমার নিজেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নীতীশকে 'পল্টুরাম' হিসেবেই ডাকেন লালু যাদব। পাটনার সামগ্রিক পরিস্থিতি এবং নীতীশের দিল্লি-সফর, ২০২৪-র পরিকল্পনার সুতোই বুনছে, এমনই বলছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ।
কেন? সম্প্রতি ৫ সেপ্টেম্বর থেকে দিল্লিতে একের পর এক বিরোধী দলের, অর্থাৎ বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। মঙ্গলবার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল, সোমবার সিপিআইএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি, ডি রাজার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন নীতীশ কুমার। এদিকে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধির সঙ্গেও দেখা হয়েছে তাঁর। বুধবার এনসিপি প্রধান শরদ পাওয়ার, সমাজবাদী দলের অখিলেশ যাদব, আইএনএলডি-র প্রকাশ চৌতালার সঙ্গে সাক্ষাৎ নীতীশের। একের পর এক বৈঠক এবং মোদি-বিরোধী রাজনৈতিক দলের কাছে নিজেকে উপস্থাপনের চেষ্টার মধ্যে এক অন্য রাজনৈতিক কৌশল দেখছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। যে পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, বিহারে গিয়ে নীতীশ কুমারের সঙ্গে দেখা করেছেন তেলেঙ্গনার মুখ্যমন্ত্রী কে চন্দ্রশেখর রাও। চন্দ্রশেখর সাংবাদিক সম্মেলনে ২০২৪-র নির্বাচনে ‘বিরোধী মুখ নীতীশ’ প্রশ্নে বলেন, “বিরোধীরা আলোচনা করে ঠিক করবেন কে মুখ হবেন।”
আরও পড়ুন- রাজনাথকে উপহারে টাট্টু ঘোড়া! যুদ্ধবিমানের নামে নাম দিলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রীই
এদিকে পটনার অলিগলিতে ‘দেশের নেতা নীতীশ’ বলে পোস্টার পড়েছে। নীতীশের দল বিজেপি ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরেই নীতীশকে প্রজেক্ট করা হচ্ছে দেশের নেতা হিসেবে। অর্থাৎ তেজস্বী যাদব বিহারের মুখ্যমন্ত্রী আর নীতীশ যাবেন দিল্লি! এই সূত্রেই সমগ্র পটনার তথা বিহারের রাজনৈতিক পথ বেঁধে দিতে চাইছে তাঁর দল। অন্যদিকে গত রবিবার জনতা দল ইউনাইটেডের সম্মেলনে নীতীশ বলেন, “বিজেপি ছেড়ে আমি মুক্ত হয়েছি। হাসিখুশি থাকতে পারছি। কথা বলতে পারতাম না।” বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, “আজাদি কা অমৃত মহোৎসব কেন? অমৃত কে? এখানে বাপু নেই কেন! আরএসএস পারলে দেশের ইতিহাসও নতুন করে লিখবে।” দিল্লিতে দাঁড়িয়ে নীতীশের দাবি, “প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা বা আগ্রহ নেই, বিরোধীরা একজোট হয়ে লড়লে বিজেপি ৫০ আসনও পাবে না।” কিন্তু এই ‘আগ্রহ নেই’ এবং আরএসএসকে আক্রমণের মধ্যেই দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক চাল খুঁজে পাচ্ছেন রাজনৈতিক কারবারিরা। তাঁদের একাংশের মত, কয়েক দিন আগেই আরএসএসের প্রশংসা শুনতে পাওয়া গিয়েছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়। যিনি আপাত অর্থে বিজেপি অর্থাৎ মোদি বিরোধিতায় সরব হন বারবার। মমতা এবং নীতীশ, দু’জনেই বিজেপির প্রাক্তন বন্ধুও। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে তীব্র মোদি বিরোধী মুখ মমতার আরএসএসের প্রতি ‘নরম অবস্থান’ খুব একটা ভাল চোখে দেখছে না অন্যান্য বিজেপি বিরোধীরা। সেখানে প্রমাণিত হচ্ছে মোদি বিরোধিতায় মমতা সার্থক ভূমিকা পালন করতে পারবেন না! অর্থাৎ তিনি বিরোধীদের মুখ হিসেবে যে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার দিকে এগোচ্ছিলেন, তা ধাক্কা খেয়েছে।
শুধু আরএসএস ইস্যু নয়, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মমতার নেতৃত্বে বিরোধীদের ঐক্য সঠিক দিশা দেখালেও পরবর্তীতে দ্রৌপদী মুর্মূকে নিয়ে নরম মনোভাব দেখান মমতা এবং উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী জোটের প্রার্থীকে ভোট দেয়নি তাঁর দল। এই অবস্থায় কংগ্রেস বা বামেরা মমতার আসল উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান! যার আবহে অগ্নিসংযোগ করেছে মমতার মুখে আরএসএস-প্রশস্তি। ‘বিরোধী মুখ মমতা,’ এই ভাবনায় খানিকটা ধাক্কা এসেছে। আর এই অবস্থাতেই সুযোগ পেয়েছেন নীতীশ কুমার। সদ্য বিজেপি ত্যাগ এবং একযোগে গেরুয়া-আরএসএস বিরোধিতা করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন তিনি আর মোদির নন, তিনিই হলেন আসল প্রতিদ্বন্দ্বী। প্রকাশ্যে বিরোধী মুখ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ না করলেও হাবেভাবে বুঝিয়ে দিচ্ছেন মমতা নয়, মোদির সঙ্গে লড়াইয়ে তিনিই সেরা। কংগ্রেসের কী ভূমিকা হবে, রাহুল গান্ধি মুখ হবেন কি না, এই বিতর্কও জিইয়ে রাখছেন নীতীশ। যদিও নীতীশের এই খেলায় বাধ সেধেছেন নীতীশের পুরনো বন্ধু, মমতা ঘনিষ্ঠ আর এক বিহারি। ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর।
আরও পড়ুন- পাখির চোখ শুধু শুভেন্দু, দুই চালে কিস্তিমাত করতে জাল ছড়াচ্ছে শাসক দল
‘জন সুরজ অভিযানের’ মোড়কে বিহারের জেলায় জেলায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন পিকে। ৫ সেপ্টেম্বর বিহারের সীতামুঢ়ি জেলায় দাঁড়িয়ে প্রশান্ত তাৎপর্যপূর্ণভাবে বলেন, “নীতীশ কুমার এক মাস আগেও অন্য এক দলের সঙ্গে ছিলেন, আজ অন্য আর এক দলের সঙ্গে। মানুষ বুঝবেন, ঠিক কী করবেন তাঁর বিষয়ে। তিনি (নীতীশ) নিজে কী করবেন জানেন। তবে এই ঘটনা অর্থাৎ নীতীশের মনবদল দেশের রাজনীতিতে প্রভাব ফেলবে না। এটা রাজ্যের ঘটনা। দেশের জন্য খুব একটা এদিক-ওদিক হবে না কিছু।” প্রশান্ত কিশোরের এই মন্তব্য খানিকটা হলেও প্রশ্ন তুলে দিয়েছে নীতীশের অঘোষিত ‘মিশন ২৪’ নিয়ে। তাহলে কি দিল্লি যাওয়া, রাতারাতি বিজেপি ছেড়ে প্রবল বিরোধিতা শানানো, খুব একটা কাজে দেবে না নীতীশের জন্য। মোদি বিরোধিতার মুখে হতে গিয়ে কি ফের ধাক্কা খাবেন নীতীশ! অনেকেই বলছেন, নীতীশ কুমারকে তাঁর রাজনৈতিক শত্রুরা ‘পাল্টিবাজ’ বলেন। সেই নামটি খুব একটা অযৌক্তিক নয়, যা বিরোধী রাজনৈতিক লড়াইয়ের ক্ষেত্রে খানিকটা বিড়ম্বনা সৃষ্টি করতে পারে। আবার মমতা বা তাঁর দলের বিরাট সমর্থন নীতীশ মুখ হলে থাকবে কি না, কংগ্রেসের ভূমিকা কী হবে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
এর মধ্যেই ফিরে আসছে নীতীশ-ইতিহাস। ২০১৩ সাল। বিজেপি প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির নাম ঘোষণা করতেই গোঁসা হয় নীতীশের। বন্ধুর হাত ছাড়েন তিনি। এই বিচ্ছেদেও নীতীশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্নভঙ্গ ছিল, এমন দাবিও করেন কেউ কেউ। তারপর ফের রাজনৈতিক শত্রু লালুপ্রসাদ যাদবের আরজেডির হাত ধরে কংগ্রেসের সমর্থনে, বিহারে ক্ষমতার স্বাদ নেন তিনি। ফের মোহভঙ্গ। দমবন্ধ হওয়ার চেনা অভিযোগেই ২০১৭ সালে ফের বিজেপির হাত ধরেন নীতীশ কুমার। ২০২০ সালে তেজস্বী যাদবের নেতৃত্বে বিহার বিধানসভা নির্বাচনে আরজেডি একক বৃহত্তম দল হয়। বিজেপি দ্বিতীয়। নীতীশ তৃতীয় হয়েও গেরুয়া-সমর্থনে মুখ্যমন্ত্রী হন। ২০২২-এ এসে ফের বিজেপির সঙ্গ ছেড়েছেন নীতীশ। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে নীতীশ যে আবার বিজেপিকে ‘নোটিশ’ করবেন না, এমন নিশ্চয়তা নেই! প্রশান্ত কিশোরের মন্তব্য এখানে গুরুত্ব পেয়েছে। যার পরে শুরু হয়েছে জল্পনা। কংগ্রেসকে গৌণ করে বিজেপির প্রাক্তন জোটসঙ্গী মমতা, না কি নীতীশই হবেন বিজেপি বিরোধী মুখ? আবার সব কাটিয়ে মমতাই কি হাসবেন শেষ হাসি! এই প্রশ্নেই এখন উত্তাল দিল্লির রাজনৈতিক রাজপথ।