দামী টিকিট, রক্তঘাম করা টাকায় দেওয়া আয়কর; ভারতীয় রেলে কোথায় যাত্রীসুরক্ষা?
Coromandel express Rail Kavach: যখন করমণ্ডল এক্সপ্রেস এবং যশবন্তপুর এক্সপ্রেসের সংঘর্ষ হলো, তখন কোনওটাতেই ছিল ছিল না এই ‘কবচ’ প্রযুক্তি। কেন ছিল না?
জ্ঞানেশ্বরী হোক বা গাইসাল রেল দুর্ঘটনা। কখনও লাইনচ্যুত ট্রেন, তো কখনও অন্য ট্রেনের সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কা। ট্রেন দুর্ঘটনার কোনও কমতি নেই ১৪৩ কোটির এই দেশে। গুচ্ছ গুচ্ছ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে যে ট্রেনগুলিতে চেপে বসেন যাত্রীরা, সেখানে কখনও ওঠে শৌচালয় নিয়ে অভিযোগ, তো কখনও প্যানট্রির রান্নায় দূষিত জলের ব্যবহার নিয়ে নালিশ। তবু এই সমস্ত অভাব-অভিযোগের সঙ্গে একরকম মানিয়েই নিয়েছেন ভারতীয় যাত্রীরা। টুইটারে ছোটখাটো ঝড়, বড়জোর দু-চারটে ফেসবুক পোস্ট, ওই পর্যন্তই। ভারতীয়েরা বরাবরই সহনশীল জাতি বলে পরিচিত। তাই বলে প্রাণের গ্যারান্টি! সেখানেও সমঝোতা! একটিমাত্র প্রাণপক্ষীরও কোনও সুরক্ষা দেবে না ইন্ডিয়ান রেলওয়ে! প্রতিবার প্রতিটি দুর্ঘটনার পরেই এই প্রশ্নটা ওঠে! আবার ঘুমিয়ে পড়ে বাকি সমস্ত প্রতিবাদ-প্রশ্ন-বিরোধিতার মতোই। নাকি এত বেশি জনসংখ্যার দেশে তেমন দাম নেই দু'শো-আড়াইশোটি প্রাণের। বড় বড় দেশে যে এমন ছোটখাটো ঘটনা ঘটতেই থাকে, তা তো 'সেনোরিটা'-রা জেনেই গিয়েছেন অ্যাদ্দিনে। তবু প্রশ্ন ওঠে। বারবার ওঠে। উঠেছে এবারও।
শুক্রবার সন্ধ্যায় ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছে একগুচ্ছ রক্তমাংসের দেহ। সংখ্যাটা আড়াইশো পেরিয়েছে। আগামী কয়েক ঘণ্টায় হয়তো তা বাড়বে আরও কয়েকশো। কয়েকশো মানুষ বেঁচে থাকবেন পঙ্গু হয়ে। হাসপাতালের বিছানায় কাতরাবেন, অবশ্য কেউ কেউ ক্ষতিপূরণের টাকাও পাবেন। আর একটা বড় অংশ বাকি জীবনটা বেঁচে থাকবেন এক ভয়ঙ্কর রাতের দুঃস্বপ্ন নিয়ে। যেখানে পড়ে থাকবে দলা দলা রক্তমাংস পিণ্ড, আর কানে বেজে চলবে অজস্র মানুষের কান ফাটানো আর্তনাদ। অথচ এঁরা প্রত্যেকেই মাথার ঘাম পায়ে ফেলা উপার্জনের টাকা খরচ করে ট্রেনের টিকিট কেটেছিলেন। কেউ যাচ্ছিলেন চেন্নাই, তো কেউ ফিরছিলেন ঘরে। না, শেষমেশ ফেরাটা হল না। ওড়িশার বালেশ্বরে মালগাড়ির সঙ্গে ধাক্কা লাগে চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেসের। উল্টে যায় যাত্রীবাহী ট্রেনটির অধিকাংশ কামরা। ইঞ্জিন উঠে যায় মালগাড়ির উপরে। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে বাদবাকি কামরাগুলি। ঘটনাস্থলেই মারা যান বহু যাত্রী। অথচ এরা সকলেই প্রতি বছর সরকারকে কর দেন মনে করে। রোদ-ঝড়-জল মাথায় করে লাইনে দাঁড়িয়ে বেছে আনেন গণপ্রতিনিধি। গড়েন সরকার। তারপর!
আরও পড়ুন- এবার আরও কাছাকাছি কলকাতা, এক ট্রেনেই যাওয়া যাবে হাওড়া থেকে বাঁকুড়া, কবে শেষ হবে কাজ?
তারপর কিছু মানুষ মরে। বাকিরা তা নিয়ে বেশ কিছুদিন কথাবার্তা বলেন, হোয়াটসঅ্যাপ স্ট্যাটাস দেন। তারপর ভুলে যান। যেন থ্যানোসের তুড়ি বাজানোর ছিল, বাজিয়ে চলে গিয়েছে। বাকিরা কাঠ কাটে, জল ভরে, অফিস যায়, খায়দায়, ঘুমায়। তার পরেও প্রশ্নটা থেকেই যায়। কেন বারবার দুর্ঘটনা? শুক্রবারের এই দুর্ঘটনা নিয়ে কী জানাচ্ছে রেল মন্ত্রক!
ভারতীয় রেলের সদর দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে, শালিমার থেকে রওনা দেওয়ার পর ওড়িশার বাহানাগা বাজার স্টেশনের কাছে যখন ট্রেনটি পৌঁছয়, সেই সময় উল্টোদিক থেকে আসছিল যশবন্তপুর-হাওড়া এক্সপ্রেস। করমণ্ডল এক্সপ্রেস অত্যন্ত বেশি গতিতে চললেও, সামনে থেকে আসা যশবন্তপুর-হাওড়া এক্সপ্রেসের গতি খুব বেশি ছিল না। কথা ছিল, দু'টি ট্রেন একে অপরকে পাশাপাশি কাটিয়ে চলে যাবে। কিন্তু পাশাপাশি যাওয়ার সময় সেই যশবন্তপুর এক্সপ্রেসের কোনও একটি বগি লাইনচ্যুত হয় এবং সেটি গিয়ে ধাক্কা মারে করমণ্ডল এক্সপ্রেসে। আর সেই ধাক্কাতেই লাইন থেকে ছিটকে যায় প্রচণ্ড গতিতে থাকা করমণ্ডল এক্সপ্রেসও। আর এ সময় পাশের রেল ট্র্যাকে দাঁড়িয়ে ছিল একটি মালগাড়ি। করমণ্ডল এক্সপ্রেস গিয়ে ধাক্কা মারে ওই মালগাড়িটিকে। যার ফলে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন উঠে যায় মালগাড়িটির উপরে। রেলের ইঞ্জিনিয়ারদের দাবি, করমণ্ডল এক্সপ্রেস এবং যশবন্তপুর এক্সপ্রেস যে গতিতে এগোচ্ছিল, তাতে তাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হলেও এত বড় অঘটন ঘটত না। কিন্তু মুখোমুখি সংঘর্ষ না হয়ে ধাক্কা লাগে পাশাপাশি। যশবন্তপুর এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হওয়ার ফলেই ঘটে যায় এই বিপদ।
আর এর জন্য মূলত সিগন্যাল ব্যবস্থার ত্রুটিকেই দুষছেন ভারতীয় রেলের পর্যবেক্ষক দল। শুক্রবার ওই ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রেলের আধিকারিকেরা। যদিও এটি প্রাথমিক তদন্ত রিপোর্ট। তলিয়ে তদন্ত করে বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে কয়েক দিনের মধ্যেই। আর তারপরেই স্পষ্ট হবে দুর্ঘটনার আসল কারণ। তবে প্রাথমিক রিপোর্ট অনুযায়ী, আপ মেইন লাইনে সবুজ সিগন্যাল দেওয়া সত্ত্বেও সেখানে ঢোকেনি করমণ্ডল এক্সপ্রেস। বদলে সেটি ঢুকেছিল লুপ লাইনে। তখন ডাউন লাইন দিয়ে বালেশ্বরের দিকে যাচ্ছিল যশবন্তপুর এক্সপ্রেস। সেই ট্রেনের দু'টি বগি লাইনচ্যুত হয় এবং সংঘর্ষ হয় করমণ্ডল এক্সপ্রেসের সঙ্গে। আগে থেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল একটি মালগাড়ি এবং মালগাড়ির সঙ্গে সংঘর্ষেই উল্টে যায় করমণ্ডল এক্সপ্রেস। কিন্তু মেন লাইনে সবুজ সিগন্যাল পাওয়া সত্ত্বেও করমণ্ডল এক্সপ্রেস কীভাবে লুপ লাইনে ঢুকে পড়ল, তা এখনও স্পষ্ট নয়। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে সিগন্যাল দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও ত্রুটি হয়েছে।
আরও পড়ুন- বাংলা থেকে বিশ্ব- ইতিহাসের ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা যা আজও ভুলতে পারেনি কেউ
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই যে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা, এত প্রাণহানি, এর দায় আসলে কার? বিশেষজ্ঞরা অবশ্য মনে করছেন, এই দুর্ঘটনার নেপথ্যে থাকতে পারে এলএইচবি রেক। ২০২২ সালের গোড়ার দিকে ভয়াবহ দুর্ঘটনা হয়েছিল বিকানের-গুয়াহাটি এক্সপ্রেসে। সেই দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছিলেন ৯ জন। তখন মনে করা হয়েছিল, আইসিএফ কোচের কারণেই এই সমস্যা। তড়িঘড়ি রেলমন্ত্রীর তৎপরতায় আইসিএফ কোচ পাল্টে আনা হয় এলএইচবি কিংবা লিংক হফম্যান বুশ কোচ। জার্মান প্রযুক্তিতে নির্মিত এই কোচের বিশেষত্ব হল, এটি ১৬০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিবেগ থেকে ২০০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা গতিবেগ পর্যন্ত যেতে পারে। ভারতে পরীক্ষিত গতিবেগ অবশ্য ১৮০ কিলোমিটার প্রতি ঘণ্টা। ২০০০ সাল নাগাদ ভারতে প্রথম শতাব্দী এক্সপ্রেসে এই কোচ ব্যবহৃত হয়। এরপর শতাব্দী এক্সপ্রেসে বেশ কয়েকটি এলএইচবি কোচ ব্যবহার করা হত। তবে গত বছর থেকেই বহু ট্রেনে এই কোচ ব্যবহার শুরু হয়েছে।
২০১৬ সালের অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে ঘোষণা করা হয়েছিল, সমস্ত আইসিএফ কোচ বদলে এলএইচবি কোচ ব্যবহার করা হবে। লোহার বদলে অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে তৈরি হওয়ায় এই কোচগুলি তুলনামূলক অনেক হালকা। এর পাশাপাশি এলএইচবি কোচ যাত্রীদের জন্য অত্যন্ত আরামদায়কও। পুরনো রেকের তুলনায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থাও আরও বেশি উন্নত এই কোচগুলিতে। স্বাভাবিক ভাবেই যাত্রীরাও এই কোচগুলি পছন্দ করেছেন। এই কোচের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো, এটি 'অ্যান্টি টেলিস্কোপিক'। অর্থাৎ, সংঘর্ষ হলেও কোচগুলি উল্টে যাবে না। কোচগুলি অ্যান্টি ফ্লিপ টেকনোলজিতে তৈরি। কিন্তু এদিন করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ঘটনা প্রশ্ন তুলে দিল এর ‘অ্যান্টি টেলিস্কোপিক’ ক্ষমতা নিয়ে। দুর্ঘটনার যে ছবি উঠে আসছে তাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সংঘর্ষের ফলে উল্টে রয়েছে বগিগুলি। তার মধ্যে আটকে রয়েছে অসংখ্য মানুষের দেহ।
একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠছে ভারতীয় রেলের 'কবচ' প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়েও। ২০১৪ সালে প্রথম পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহার করা হয়েছিল এই প্রযুক্তি। কবচ যেমন যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধাদের সুরক্ষা প্রদান করে, ঠিক একইভাবে এই ‘কবচ’ ট্রেনকে সুরক্ষা প্রদান করে। এই বিশেষ টেকনোলজিটি মাইক্রো প্রসেসর, জিপিএস এবং রেডিও সংযোগ ব্যবস্থার মাধ্যমে ট্রেনের অবস্থান বলে দেয়। একই সঙ্গে মুখোমুখি একই লাইনে কোনও ট্রেন এলে অনেক আগে থেকেই সতর্ক করা শুরু করে। এমনকি, দু'টি ট্রেন যদি একই লাইনে চলে আসে তাহলে বিপদ সংকেত দেওয়া শুরু করে এই ‘কবচ’। ভারতীয় রেল মন্ত্রকের তরফে এর আগে দাবি করা হয়েছিল, এই 'কবচ' বিপদ সংকেতের পাশাপাশি বিপদের পরিস্থিতিতে অটোমেটিক্যালি গতিবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। অর্থাৎ কোনও ট্রেন যদি খুব জোরে ছোটে এবং সামনে কোনও রকম বিপদ এসে পড়ে, তাহলে নিজে থেকেই গতিবেগ কমতে শুরু করে সেই ট্রেনের। ২০২২ সালেও এ নিয়ে প্রচুর পরীক্ষানিরীক্ষা চলেছে। সেই পরীক্ষামূলক যাত্রায় একটি ট্রেনে ছিলেন স্বয়ং রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। এরপর কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে জানানো হয়েছিল ভারতের সব দূরপাল্লার ট্রেনেই ব্যবহার করা হবে এই প্রযুক্তি। দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য এই পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণভাবে যখন করমণ্ডল এক্সপ্রেস এবং যশবন্তপুর এক্সপ্রেসের সংঘর্ষ হলো, তখন কোনওটাতেই ছিল ছিল না এই ‘কবচ’ প্রযুক্তি। কেন ছিল না? এই প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেনি ভারতীয় রেল কিংবা কেন্দ্রীয় সরকার। এই প্রযুক্তি ট্রেন দু'টিতে উপস্থিত থাকলে হয়তো এই এত বড় দুর্ঘটনা হয়তো এড়িয়ে যাওয়া যেত।
নাগরিকদের আয়করের টাকায় চলা এই যে অন্তহীন পরীক্ষানিরীক্ষা, প্রযুক্তি আনতে কোটি কোটি টাকা খরচ - তবে কি শুধুমাত্র ভোটবাক্সে লোক টানার কৌশল? আদতে এ সবই কি শুধু ছল আমজনতার চোখে ধুলো দেওয়ার জন্য। আর কত হাজার মরলে পরে নড়বে টনক! শুক্রবার করমণ্ডল এক্সপ্রেসের এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা সেই প্রশ্নটাই তুলে দিয়ে গেল আবারও! 'রাজা, তোর কাপড় কোথায়?'- বলার সময় কি আসেনি এখনও! একবার ভেবে দেখবেন বরং।