নোলান শেষমেশ ঝোলালেন, ম্যাচের গোলাপি ঘোড়া বার্বিই!

Oppenheimer and Barbie Review: নোলান শুধুমাত্র ক্রিয়েশনকে একা এগিয়ে যেতে দিতে পারলেন না, কন্ট্রোল ফ্রিক ওপেনহাইমারের মতোই।

ওপেনহাইমার দেখলাম। নোলান প্রিয় তো বটেই, তাই দেখতামই। ফেসবুকে বহু মানুষের প্রায় প্রথম পাঁচ মিনিট দেখেই, হল থেকে লাইভ পোস্ট, পিরিয়ড, নোলান শ্রেষ্ঠ বা এরপর আমি অন্ধ হয়ে গেলেও আর খেদ থাকবে না, এ কী দেখিলাম! — দেখেশুনে হৃদয়ে শঙ্কার মেঘ যে জমেনি, বলব না, তবুও প্রত্যেকবার মানুষকে যা যা মুগ্ধ করবে, আমায় ঠিক উল্টো করবে, এমনটা তো হতে পারে না, এই ভেবে দিলুম লাফ। এবং হে অলমাইটি, আমি এবারও তোমাদেরই লোক হতে পারলাম না।

সোজা কথা, আমার ওপেনহাইমার তেমন কিছু একটা লাগেনি। কেন যে নোলান আমায় একটা মানুষের বায়োপিক দেখাবেন বলে ঝাড়া তিন ঘণ্টার ওপর, পরীক্ষার ইলেভেন্থ আওয়ারে ঠিক যেমনভাবে বেয়াড়া ছেলেকে মা কলেজস্ট্রিট থেকে মানে বই এনে সম্ভাব্য প্রশ্ন দাগ দিয়ে মুখস্থ করান, তেমনটা করাবেন বোধহম্য হলো না। যেন স্কিপ করে করে এ অধ্যায়ের কিছু, ও চ্যাপ্টারের সামান্য, সে অংশের মধ্যভাগখানি। দর্শক তাঁর আগের অনেক ছবির মতোই এটিও যেন ঘেঁটে না ফেলে, সে ভয়ই কি গ্রাস করেছিল? কে জানে! মনে তো হতো, নোলানের মতো বাঘা পরিচালক অত বুনো তেঁতুল নিয়ে ভাবেন না! অবশ্যই এক দল দেখতে যাবেন, যাঁরা বইমেলা, সার্কাস, ইডেনে টি-টোয়েন্টি, সরস মেলা, হাওড়া ব্রিজের ওপর বিষণ্ণ মনে কেউ উঠে পড়লে, এনিথিংয়ে ভিড় করবেন। কিন্তু আর এক দল তো আছে রে বাবা, যাঁরা হোঁচট খেয়ে, থমকে, বোমকে শেষ অবধি পৌঁছতে চান, নোলানের সঙ্গেই। আমি হতাশ তাঁদের মতোই। না এ ছবি কঠিন নয় বলে হতাশ নই। হতাশ, কারণ এ ছবি অনেক কিছু চাপার চেষ্টা করল। এবং তাও আদপেই নিপুণ ভাবে করা গেল না।

আরও পড়ুন- সত্যিই কি ওপেনহাইমার শতাব্দীর সেরা সিনেমা? নাকি…

ওপেনহাইমার যখন তাবড় বিজ্ঞানীদের এক ছাতের তলায় নিয়ে এসে বানাচ্ছেন চিরতরে ইতিহাস বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখা গণহত্যার এক মারণ হাতিয়ার, তখন একবারের জন্যেও বুঝতে পারেননি কি, সব দানব ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইনের হাত থেকে এক দিন ঠিক বেরিয়ে যায়ই? ওপেনহাইমার সম্পর্কে যা পড়েছি, ছবি দেখার পরও যা পড়লাম, একবারও তো মনে হয়নি, তিনি অমন সরল, সাদাসিধে! স্টেট কীভাবে এক একটি পদক্ষেপ করে, তা বুঝতে পারেন না। না জানি, রাষ্ট্রের মতিগতি বোঝা লস অ্যালামস প্রোজেক্টের মতোই সাংঘাতিক এক কর্মকাণ্ড, কিন্তু হিটলারকে আটকাতে যে বোমা তৈরির তোড়জোড়, তা যে কখনই সমস্ত যুদ্ধ থামিয়ে পৃথিবীতে শান্তির সমীরণ বইয়ে দিতে পারে না, এটা ওপেনহাইমার বুঝতে পারেননি, মানতে হবে? এবং সত্যিই তো তিনি সে সবই জানতেন, নইলে কেনই বা তিনি বলবেন, ‘…দ্য ফিজিসিস্টস হ্যাভ নোন সিন…’! অর্থাৎ তিনি ও তাঁর দল জেনেছেন এ পাপবোধ। গোটা উদ্ধৃতিটি  রইল,

"In some sort of crude sense which no vulgarity, no humor, no overstatement can quite extinguish, the physicists have known sin; and this is a knowledge which they cannot lose.’

আর একটি অংশ তুলে দিই,

‘I never regretted … having done my part of the job…I… think that it was a damn good thing that the bomb was developed, that it was recognized as something important and new, and it would have an effect on the course of history."

এই যে ইতিহাসে অমর হয়ে যাওয়ার স্বাদ, এটি কি ওপেনহাইমারকে তাড়িয়ে বেড়ায়নি? সে যতই প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান ভরাট তাচ্ছ্বিল্যের সুরেই বলুন না কেন, বোমা কে তৈরি করল তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই, বোমা কে ফেলল, সবাই তার নামটাই জানবে। নোলান ওপেনহাইমারকে হিরোশিমা-পরবর্তী ক্ষণে, ‘আই হ্যাভ ব্লাড ইন মাই হ্যান্ডস’ বলিয়েই কী অনায়াসে এক রকম নিষ্কৃতি দিলেন। আর তারপর তাঁর বিরুদ্ধে বসানো হিয়ারিং যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা বোঝার পরেও যেভাবে ওপেনহাইমার সবটা ‘সয়ে’ গেলেন, বা নোলানের মতে নিজেকে পুড়ে ছাই হতে দিলেন, তা যেন সেই আগুনে পুড়ে শুদ্ধ হওয়ার সামিল। ওপেনহাইমার বাস্তব জীবনে তেমনটা হতেই পারেন, করতেই পারেন কিন্তু নোলান কেন এ পদক্ষেপ নিয়ে প্রশ্ন করবেন না? ভাবায়। নোলান যদি বলতেন অন্তত, দেখো হে তুমি জেনেবুঝে এ কাজকে এগিয়ে নিয়ে গেছ, তোমার হাতে তো রক্ত লেগে থাকারই কথা, সে তুমি তারপর যতই উন্মাদের মতো ধুয়ে তুলে ফেলতে চাও তা…

আরও পড়ুন- নেহাত সাধনা নাকি ঈশ্বরত্বের হাতছানি, কেন সর্বঘাতী পরমাণু বোমা বানিয়েছিলেন ওপেনহাইমার?

কিন্তু আমরা কী দেখছি? ওপেনহাইমারই নিজে কেমন আপন প্রায়শ্চিত্তের ক্ষণ, পদ্ধতি ঠিক করে নিচ্ছেন। কতটা দগ্ধ হবেন তিনি, সে রেগুলেটরও তাঁরই হাতে, আর একটি প্রোজেক্ট যেন। এখানেই মনে হয়েছে, নোলান ওপেনহাইমারকে সিঁধ কেটে পালিয়ে যেতে দিয়েছেন, খেলা ঘুরিয়ে দিয়ে, ওপেনহাইমারের বিরুদ্ধেই, খোদ রাষ্ট্রকে প্রতিদ্বন্দ্বী বানিয়ে। ওপেনহাইমার এইবার রাষ্ট্রের কাছে মার খাবেন, অপমানিত হবেন, হেরে তো যাবেনই আর অমনি আমাদের মন গিয়ে পড়বে ওপেনহাইমারের ক্ষতবিক্ষত পরাণ-পাশে! ছাই থেকে ফিনিক্সের ন্যায় উঠে আসবে এক ট্র্যাজিক হিরো, ওপেনহাইমার, রাইট মিস্টার নোলান? রাষ্ট্রকে ছিছিক্কারে ভরাব আমরা, অমন জিনিয়াস এক মাইন্ডকে হাতের পুতুল বানিয়ে, দরকার শেষে ছিবড়ে করে ফেলে দেওয়ার জন্যেও ধিক দেব সেই রাষ্ট্রকে কিন্তু নোলানদা, হাতের পুতুল হতে চেয়েছিল ঠিক কে, শুনি? নাকি আপনি বলছেন, রাষ্ট্র চাইলে সব্বাইকেই হাতের পুতুল হতেই হয়? তা হলে সেটাও অন্তত খোলসা করতেন না হয়। আপনি যেনতেনপ্রকারেণ ওপেনহাইমারকে গ্লোরিফাই করলেন এবং করলেন, ওই বোমা বানানোর জন্যেই। আমার কোনও সমস্যা নেই (আর থাকলেই বা কী!) আপনি হিরোশিমা বা নাগাসাকি, বা কোনও জাপানিকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখাননি বলে। ওপেনহাইমারের মন যখন তোলপাড় হয়, তাই-ই আমার কাছে এনাফ। কিন্তু সে তোলপাড় এত বুড়ি ছোঁয়া টাইপ?

কই আপনি কেন একবারও বললেন না যে, ওপেনহাইমারের গুরুস্থানীয় নিল্‌স বোর যাকে ‘কমপ্লিমেন্টারিটি’ বলছেন, (অর্থাৎ পদার্থবিজ্ঞানে একই সঙ্গে দু'টি ফলাফলই সত্যি হতে পারে, নির্ভর করছে কী যন্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে ও কে কোন জায়গা থেকে বিষয়টি দেখছে) সেটি ওপেনহাইমার এই বোমা তৈরি ও ব্যবহারের ক্ষেত্রেও যখন লাগু করছেন, তা মানুষটিকে আদতে ঘোর যুদ্ধবাজ করে তোলে? এই যে তাঁদের ‘নিউক্লিয়ারিজম’-এর তত্ত্ব, যা বলে একটি মৃত্যুর হাতিয়ার তৈরি, শেষমেশ মানবজাতির বৃহত্তর কল্যাণ হেতুই, তা যে কী মারাত্মক ও চূড়ান্ত আজগুবি এক ভাবনা, সে প্রশ্ন বা কমেন্ট, কই শ্রী ক্রিস নোলান?

আর হাইড্রোজেন বোমার গোটা প্রোজেক্টটি যে তাঁর দখলে থাকত না, সেটিই কি আরও তিক্ত করেছিল ওপেনহাইমারকে? হ্যাঁ, আপনি বলতে পারেন, পোস্ট হিরোশিমা-নাগাসাকি, হাত পুড়িয়ে তিনি বুঝেছিলেন, আরও বড় এক বোমায় কী বিধ্বস্ততা আসতে পারে, কিন্তু ইতিহাস বলে, তাও তো তিনি বার্ট্র্যান্ড রাসেল, আইনস্টাইন, জিলার্ডের মতো অ্যান্টি-নিউক্লিয়ার স্ট্যান্ডপয়েন্ট থাকা মানুষদের মতো যুদ্ধবিরোধী পাবলিক স্টেটমেন্ট করেননি। আবার বলছি, তাও তিনি নাই করতে পারেন কিন্তু সিনেমা-বায়োগ্রাফার সে দিকটিও ফিরে দেখলেন না?

আরও পড়ুন- ওপেনহাইমারকে ‘গোপন চিঠি’ পাঠিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু! কী ছিল ওই চিঠিতে?

নোলান পই পই করে দেখাতে চাইলেন আমাদের ওপেনহাইমারের অন্তরমহল কিন্তু হাতে একটি বাইনোকুলার ধরিয়ে এও ফিসফিস করে বলে দিলেন, যেমন বলছি তেমন দেখো, তাতে তোমারই শান্তি। ফলে ম্যানহাটান প্রোজেক্ট পরবর্তী ক্ষণ তো বটেই, আমি জানতে পারি না, ওপেনহাইমার ও স্ত্রী কিটি’র মধ্যে ঠিক কী কথা হয়েছিল, যখন বাড়ি ফিরে ওপেনহাইমার দেখেছিলেন, সন্তান একা কাঁদছে আর কিটি তা উপেক্ষা করে টেবিলে মদের গ্লাস নিয়ে বসেছিলেন। ওপেনহাইমার বলেন স্ত্রীকে, তোমার বোধ হয় ওর কাছে যাওয়া উচিত, কিটি তখন উত্তর দেন, সারাদিন তাই ছিলাম, আর পারছি না। ওপেনহাইমার এরপরে, সন্তানকে দিয়ে আসেন এক বন্ধুর কাছে এই বলে যে, আমরা সন্তানপালনে ‘অক্ষম’। অমন একটা সাংঘাতিক মুহূর্ত যে আমার অধরা রয়ে গেল! এমন আরও খান পাঁচেক মুহূর্ত আমি লিস্ট করতে পারি, যা সম্ভবত শ্রদ্ধেয় নোলান সাহেবের খোপকাটা খাতায় ফিট করছিল না, তাই কার্পেটের তলায় সুন্দর করে চালান করা হলো।

তবে হ্যাঁ, সে খেদ জমিয়ে মেটালো ‘বার্বি’। গ্রেটা গারউইগ, আপনি যে কত কিছুকে (ওপেন)হাই-মারো মারো টান করলেন এবং কী ক্যাজ্যুয়ালভাবে, তা মুগ্ধ করে। কেউ কেউ বলছেন, ফেমিনিজমের পাঠ, পিতৃতন্ত্রকে কী অপূর্ব খানখান করেছেন ইত্যাদি, আমি দেখেছি আরও অনেক কিছু। কর্পোরেট কালচারের তলপেটে সপাটে লাথি, ক্রিয়েটরকে নিজ যুক্তি বোঝাচ্ছে তার ক্রিয়েশন, উল্টে ক্রিয়েটর ক্রিয়েশনকে বলছে, কে বলে আমি তোমায় চালনা করি? একেবারেই না। ক্রিয়েশন তখন ক্রিয়েটরকে জিজ্ঞেস করে, আমর কি কোনও অন্ত ভেবেছেন আপনি? ক্রিয়েটর বলে, তুমি ভাববে? তার পর সে ক্রিয়েশন, অর্থাৎ বার্বি, শুরু করে এক নতুন পথচলা। নোলানও দেখুন, এক ক্রিয়েটর ও তার ক্রিয়েশনের কথাই বললেন ছবিতে এবং দু’জনের ক্ষেত্রেই ক্রিয়েশন ক্রিয়েটরের হাত ছেড়ে বেরল, তফাৎ শুধু একটাই। নোলানের ক্রিয়েটর ক্রিয়েশনকে ছেড়ে বেরতে পারলেন না আর গ্রেটা’র ক্রিয়েটর নিজ ক্রিয়েশনকেই হাত ধরে নতুন রাস্তার বাঁকে এনে ফেললেন। সেখানে দাঁড়িয়ে বার্বি’র ক্রিয়েটর রুথ হ্যান্ডলার বার্বিকে বলেন…"মায়েরা একটা পর্যায় অবধি মেয়ের সঙ্গে হাঁটেন, তার পর থেমে যান। কেন জানো? যাতে মেয়ে সেখান থেকে বেশ কিছুটা এগিয়ে পেছন ফিরে তাকিয়ে বুঝতে পারে, সে একাই কত দূর চলে এসেছে…"

গ্রেটা’র ছবি এখানেই অন্য পর্যায়ে গেল। আর নোলান আসলে থেমে গিয়ে শুধুমাত্র ক্রিয়েশনকে একা এগিয়ে যেতে দিতে পারলেন না, কন্ট্রোল ফ্রিক ওপেনহাইমারের মতোই।

More Articles