এবার ভারতে হানা নরোভাইরাসের! কতটা ভয়াবহ এই ভাইরাস, কীভাবে সংক্রমণ?

নরোভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর শারীরিক অবস্থা যদি খুব খারাপ না হয়, সেক্ষেত্রে বাড়িতেই শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের চিকিৎসা করা যায়।

৫ জুন কেরলের তিরুবনন্তপুরমে দুই শিশু নরোভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। নরোভাইরাসে আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ডায়েরিয়া-সৃষ্টিকারী রোটাভাইরাসের মতো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য, দু'টি ভাইরাস আলাদা হলেও, পৃথিবীজুড়ে শিশুদের মধ্যে গ্যাস্ট্রোএনটেরাইটিসের অন্যতম কারণ এই দু'টি ভাইরাস। গ্যাস্ট্রোএনটেরাইটিস হলে ক্ষুদ্রান্ত্রে প্রদাহ হয়, যার ফলস্বরূপ পেটে ব্যথা ও ডায়েরিয়ার মতো সমস্যা দেখা দেয়। 

সারা পৃথিবীতে, বিশেষ করে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া দেশগুলিতে ডায়েরিয়া শিশুমৃত্যুর অন্যতম কারণ। রোটাভাইরাসের তুলনায় নরোভাইরাস কম ক্ষতিকর এবং তুলনামূলকভাবে হাসপাতালে ভর্তির হার নরোভাইরাসের ক্ষেত্রে কম হলেও, প্রতি বছর সারা বিশ্বে ৬৮৫ মিলিয়ন মানুষ নরোভাইরাসে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় দুই লাখ মানুষ মারা যান।

২০১৬ সালে ভেলোর ক্রিশ্চান কলেজের গবেষিকা গগনদীপ কংগ-এর তত্ত্বাবধানে PLOS One জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণায় জানা যাচ্ছে, দক্ষিণ ভারতে শিশুদের মধ্যে গ্যাস্ট্রোএনটেরাইটিসের একটি অন্যতম কারণ হলো নরোভাইরাস। দক্ষিণ ভারতে এই রোগের প্রকোপ কম হলেও, শিশুদের মধ্যে এই রোগে একাধিকবার সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে।

আরও পড়ুন: মানসিক চাপ, অভ্যেস… কীভাবে ছাড়বেন ধূমপান?

নরোভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ কী কী?
শিশু ছাড়াও নরোভাইরাসে যে কোনও বয়সের মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের তরফ থেকে জানা যাচ্ছে, নরোভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার এক থেকে দুই দিনের মধ্যেই সাধারণত রোগের লক্ষণগুলো দেখা যায়।

ডায়েরিয়া ও পেটে ব্যথা ছাড়াও নরোভাইরাসের অন্যতম লক্ষণ হল বমি, মাথা যন্ত্রণা, শরীরের বিভিন্ন অংশে ব্যথা, জ্বর হওয়া ইত্যাদি। নরোভাইরাস-সংক্রমিত কোনও রোগীর সংস্পর্শে এলে, তার শরীরের কোনও অংশে লেগে থাকা ভাইরাস থেকেও সংক্রমণ হতে পারে। তার মানে কিন্তু এই নয়, এটি ছোঁয়াচে রোগ।

নরোভাইরাস সংক্রমণের ফলে বারেবারে বমি ও মলত্যাগের ফলে শরীরে ইলেকট্রোলাইট ভারসাম্য (Electrolyte balance) ব্যহত হয়ে ডিহাইড্রেশন দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে ইলেকট্রোলাইট সলিউশন, যেমন ORS, স্যালাইন ইত্যাদি প্রয়োগ করা প্রয়োজন হতে পারে। পাশাপাশি ডিহাইড্রেশন রুখতে প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে জল ও ফলের রস পান করা।

কীভাবে ছড়ায় নরোভাইরাস?
কেরলের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভিনা জর্জ সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নরোভাইরাস খুব সহজে ছড়িয়ে পড়ে এবং এর সংক্রমণ রুখতে গেলে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি।

এই ভাইরাস মূলত সংক্রমিত হয় জল এবং খাবার থেকে। তাই এদের জলবাহী (Waterborne) ও খাদ্যবাহী (Foodborne) ভাইরাস বলে। স্বাভাবিকভাবেই সঠিক স্বাস্থ্যবিধি না মেনে চললে, নরোভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা বাড়বে। তবে জল ও খাবার ছাড়াও, কোনও বস্তুর পৃষ্ঠতল থেকেও এই ভাইরাস ছড়াতে পারে (Surface contamination)। অর্থাৎ, নরোভাইরাস উপস্থিত যেখানে, সেইরকম কোনও জিনিসে হাত দেওয়ার পর, সেই হাত যদি মুখে যায়, সেক্ষেত্রেও সংক্রমণের সম্ভাবনা প্রবল।

জানা যাচ্ছে, কেরলের এই দুই শিশুর অবস্থা এখন স্থিতিশীল। তাদের নরোভাইরাস সংক্রমণের কারণ হিসেবে অস্বাস্থ্যকর খাবারই দায়ী, এমনই জানা গেছে একটি সরকারি গবেষণাগার থেকে খাদ্যের নমুনা পরীক্ষা করে দেখার পর। সেই খাবার এই শিশুদু'টি স্কুলেই খেয়েছিল বলে জানানো হচ্ছে গবেষণাগারটির তরফ থেকে।

নরোভাইরাস কত প্রকার ও কী কী?
২০১৩ সালে নেদারল্যান্ডের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ পাব্লিক হেলথ অ্যান্ড দ্য এনভায়রনমেন্ট-এর (National Institute of Public Health and the Environment) প্রকাশিত একটি গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, জিনগত গঠনের পার্থক্যের জন্য নরোভাইরাসকে কতগুলি গোষ্ঠী বা গ্রুপে ভাগ করা যায়। জিনের গঠনের তারতম্যের জন্যই এই গোষ্ঠীগুলিকে জেনোগ্রুপ (Genogroup) বলা হয়। নরোভাইরাসকে পাঁচটি জেনোগ্রুপে ভাগ করা যায়। এগুলি হলো জেনোগ্রুপ I (G I), G II, G III, G IV, এবং G V।

বিশ্বজুড়ে, এদের মধ্যে সব থেকে বেশি আধিক্য দেখা যায় G II-এর, আর তারপরেই G III -এর। তবে কেরলের এই দুই শিশু নরোভাইরাসের কোন জেনোগ্রুপে আক্রান্ত, তা এখনও জানা যায়নি।

নরোভাইরাস প্রতিরোধের জন্যে কী কী করণীয়?
কেরলের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর মতে, নরোভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধ করা যেতে পারে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজি়জ় কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (Centre for Disease Control and Prevention) বা সিডিসি-র (CDC) তরফ থেকে জানা যাচ্ছে, নরোভাইরাস প্রতিরোধ করার জন্য সবার আগে প্রয়োজন, হাত ঘনঘন পরিষ্কার করা এবং পরিশ্রুত পানীয় জল বা অন্তত ফোটানো জল গ্রহণ করা। ফল এবং সবজি পরিশ্রুত জলে ধুয়ে তবেই খাওয়া প্রয়োজন।

এর পাশাপাশি শৌচালয় ব্যবহার করার পর ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার প্রয়োজনীয়তার কথাও উল্লেখ করা হচ্ছে। যেহেতু এটি জলবাহিত রোগ, বাড়িতে নরোভাইরাসে আক্রান্ত রোগী থাকলে, শৌচালয় পরিষ্কার রাখা বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। 

নরোভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ দেখা দিলে, অন্তত দুই দিন বাড়িতে বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। এবং সংক্রমিত ব্যক্তি যাতে কোনওমতেই অন্যের জন্য খাবার না তৈরি করেন, সেই দিকে নজর রাখা।

নরোভাইরাসে সংক্রমিত হলে কী চিকিৎসার প্রয়োজন?
ব্রিটেনের ন্যাশাল হেলথ সার্ভিসের (National Health Service or NHS) তরফ থেকে জানা যাচ্ছে, নরোভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর শারীরিক অবস্থা যদি খুব খারাপ না হয়, সেক্ষেত্রে বাড়িতেই শিশু ও প্রাপ্তবয়স্কদের চিকিৎসা করা যায়। তার জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণে জল, ফলের রস, ইলেক্ট্রোলাইট সলিউশন পান করা।

তবে শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। অবস্থার অবনতি ঘটতে শুরু করলে, যত দ্রুত সম্ভব নিকটবর্তী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে রোগীকে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন।

সাধারণত দুই থেকে তিনদিনের মধ্যেই নরোভাইরাসে আক্রান্ত রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন।

More Articles