সবচেয়ে ধনী ভারতীয় কে? আম্বানি-আদানিরা নন, জেনে নিন তাঁর পরিচয়

সবথেকে ধনী ভারতীয় কে? আপনি নিশ্চয়ই আম্বানি, আদানি, বিড়লা অথবা টাটাদের নিয়ে মনে মনে এক দীর্ঘ তালিকা বানিয়ে ফেলেছেন। মাঝে মাঝেই এঁদের সম্পত্তি বৃদ্ধির খবর সংবাদের হেডলাইন হয়ে ওঠে।কিন্তু সম্পত্তির নিরিখে এঁদের সকলকেই কয়েক গোল দিতে পারেন এমন ভারতীয় ব্যক্তির কথা বোধহয় আমাদের জানা নেই।এমনকি বিশ্বের ধনী ব্যক্তিদের সাথে পাল্লা দিতে পারে তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ।অথচ এই ময়দানে তিনি অনেক পুরোনো খেলোয়াড়।পাঠকেরা নিশ্চয় এটা জেনে অবাক হচ্ছেন যে সত্যিই কি এমন ভারতীয় আছেন যাঁর সম্পত্তি পাল্লা দিতে পারে দেশের অন্যতম ধনী ব্যবসায়ীদের! হ্যাঁ আছেন যাঁর সম্পত্তির বর্তমান মূল্য আম্বানির আদানিদের থেকেও বেশি। ইতিহাসের পাতা উল্টে সামান্য এগিয়ে গেলেই মিলবে সেই ব্যক্তির দেখা। স্বাধীনতার পরবর্তী ভারতেও বেশ কিছুদিন পর্যন্ত বহাল তবিয়তেই কাটিয়েছেন বিলাসবহুল জীবন। এখনকার আম্বানি-আদনিদের কাছে নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণা তিনি। চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই ভারতীয়ের পরিচয় ও তাঁর বিলাসবহুল জীবনের কিছু অজানা তথ্য। 

কে ভারতের ধনীতম ব্যক্তি? 

নাম মীর ওসমান আলি খান। তিনিই অবিভক্ত হায়দরাবাদের সর্বশেষ নিজাম। মীর ওসমান ১৯১১ সাল থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত মোট ৩৭ বছর রাজত্ব করেন। যে সময় সিংহাসনের বসেছিলেন ওসমান আলি তখন রাজ্যের রাজকোষ প্রায় শূন্য হতে চলেছিল। পিতার উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের কারণেই এমন করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়। তবে ওসমানের হাতে ক্ষমতা আসতেই ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। ৩৭ বছরের শাসনকালে রাজকোষ ফুলেফেঁপে ওঠে। 

১৯৩৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন  সংখ্যার কভারে ছাপা হয় নিজামের ছবি, তলায় লেখা ' দ্য রিচেস্ট ম্যান ইন দ্য ওয়ার্ল্ড'। তবে শোনা যায় তিনি নাকি অত্যন্ত কৃপণ স্বভাবের ছিলেন। তাঁর পুরনো পোশাক অল্টার করে আবার পড়তে হতো বাড়ির কিশোরদের। ছিঁড়ে বা ফেটে না গেলে মিলত না নতুন জুতো জোড়া বা জামা। জিনিস কেনার সময়ও নাকি রীতিমতো দরদাম করে তবেই কিনতেন। তাঁর আর্দালিদের কেউ কোনোদিন নাকি সিকি পয়সা বকশিস পায়নি। সিগারেটও খেতেন সবচেয়ে সস্তা কোম্পানির। তবে তাঁর মৃত্যুর পর বিশাল সম্পত্তির খোঁজ মেলেনি।  

নিজামের সম্পত্তির পরিমাণ 

সম্প্রতি একটি রিপোর্ট বলছে, ওসমান আলির সম্পত্তির বর্তমান বাজার মূল্য ১৭.৪৭ লক্ষ কোটি বা ১,৭৪,৭৯,৫৫,১৫,০০,০০০ কোটি, ডলারের হিসেবে যা  ২৩০ বিলিয়ন ডলার। এই সম্পত্তি বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি ইলন মাস্কের সম্পত্তির কাছাকাছি।  ধনকুবের ইলন মাস্ক বর্তমানে ২৫০ বিলিয়ন ডলার সম্পত্তির মালিক। 

কৃপণ স্বভাবের হলেও তাঁর বিলাসিতার কথা শুনলে অবাক হবেন। পেপার ওয়েট হিসেবে টেবিলে ব্যবহার করতেন হীরা।তাও আবার যে সে হীরা নয়, পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম হীরা,১৮৫ ক্যারেটের জ্যাকব ডায়মন্ড ছিল তাঁর টেবিলে। বর্তমানে যার বাজার দর হাজার কোটি টাকারও বেশি। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি রোলস রয়েসের ৫০ টি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতো তাঁর গ্যারেজে।শোনা যায় তাঁর কাছে যত পরিমাণ মুক্তো ছিল তা দিয়ে নাকি অলিম্পিকের সাইজের সুইমিং পুল পুরো ভর্তি হয়ে যেত।

দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছুদিন আগেই লন্ডনের ওয়েস্ট মিনস্টার ব্যাঙ্কে ১ কোটি ডলার জমা করেছিলেন নিজাম। ৭১ বছর সেই টাকায় হাতও দেননি তাঁর পরিবারের সদস্যরা। কিছু বছর আগে যা সুদে আসলে হয়ে দাঁড়ায় ৩০৬ কোটি টাকা। ২০১৯ সালে এক ব্রিটিশ বিচারক রায় দেন যে নিজামের পরিবারের সদস্যরা যেন সেই টাকা সংগ্রহ করে নেন সেখানের জাতীয় ব্যাঙ্ক থেকে। 

রানি এলিজাবেথের বিয়েতে কয়েক কোটি টাকার হিরের নেকলেস উপহার দিয়েছিলেন নিজাম। এটি আজও রানির ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় 'নিজাম নেকলেস' নামে রাখা আছে। ২০০৮ সালে ফোর্বসের ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে নিজাম ওসমান আলিকে সর্বকালের সেরা পাঁচ ধনী ব্যক্তির তালিকায় রাখা হয়েছিল।সেই সময় তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ২১০.৮ বিলিয়ন ডলার।

১৯৪৮ সালে অপারেশন পোলোর মাধ্যমে ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয় হায়দরাবাদ।  এরপর ১৯৬৫ সালে ভারত চীন যুদ্ধের সময় দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে ওঠে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী নিজামকে অনুরোধ করেন দেশকে আর্থিক সাহায্য প্রদান করার জন্য। কী দিয়েছিলেন নিজাম অনুদান হিসেবে? ৫০০০ হাজার কেজি সোনা এবং নগদ ৭৫ লক্ষ টাকা। চমকে উঠেছিল বিশ্ব! এখনও পর্যন্ত ভারতের আর্থিক তহবিলে দেওয়া সবচেয়ে বড় অঙ্কের অর্থ এটি। তবে অনেকেই বলে এই কথা সত্য নয় এবং প্রমাণস্বরুপ দেখান একটি আরটিআইয়ের উত্তর। 

নিজামের জনহিতকর কাজ

ওসমান আলি ব্যক্তিগত জীবনে কৃপণ হলেও রাজ্যের উন্নতিতে অর্থ খরচ করে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করতেন না। তিনি শিক্ষা, বিজ্ঞান ও উন্নয়নের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। ৩৭ বছরের রাজত্বকালে বিদ্যুৎ,রেলপথ, সড়ক,সেচ ব্যবস্থা,বিমান ব্যবস্থা চালু করেন। এমনকী রাজ্যের চুক্তভিত্তিক শ্রমিকদের জন্য আইন চালু করেছিলেন। নিজামসাগর হ্রদ খনন করান। তুঙ্গভদ্রা নদীতে সেচ ব্যবস্থা চালু করেন।

হায়দরাবা শহরের প্রায় সব সরকারি ভবন যেমন উসমানিয়া জেনারেল হাসপাতাল, হায়দ্রাবাদ উচ্চ আদালত, আসাফিয়া লাইব্রেরী (বর্তমানে স্টেট সেন্ট্রাল লাইব্রেরি), টাউন হল (বর্তমানে এসেম্বলি হল), জুবিলি হল, হায়দ্রাবাদ জাদুঘর (বর্তমানে স্টেট মিউজিয়াম), নিজামিয়া অবজারভেটরি এমন উল্লেখযোগ্য নির্মাণ তাঁর আমলেই। বাজেটের ১১% করতেন শিক্ষাখাতে। ১৯১৮ সালে তাঁর হাতেই উসমানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।এই বিশ্ববিদ্যালয়েই ভারতে প্রথম উর্দু ভাষায় পঠনপাঠন চালু হয়।প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হয় এবং দরিদ্রদের জন্য তা বিনামূল্যে প্রদান করা হয়। 

১৯৪১ সালে রাজ্যের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক হিসেবে হায়দরাবাদ স্টেট ব্যাঙ্ক তৈরি করেন। ২০১৭ সালে এই ব্যাংক ভারতীর স্টেট ব্যাংকের সাথে মিলিত হয়।রাজ্যের আলাদা মুদ্রাও চালু ছিল তাঁর শাসনকালে । এককথায় নিজাম ওসমান আলি খান ছিলেন আজকের আধুনিক হায়দরাবাদ নির্মাণের কারিগর।

More Articles