গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় প্রথম গানেই কিস্তিমাত, কেন হারিয়ে গেলেন ‘গায়িকা’ সুচিত্রা সেন
Suchitra Sen : স্টারডাম, আভিজাত্যের সঙ্গে সততা, আত্মবিশ্বাস এমন বৈচিত্র্যময় স্বভাবে রহস্যময়ী রমণীসত্ত্বার ঘেরাটোপ বরাবরই বজায় ছিল তাঁর।
‘মিসেস’ সেন। স্ত্রীর পরিচয় থেকে কখনই বেরোননি সুচিত্রা। অথচ অভিনয় দক্ষতায় তিনি কী ভীষণ সাবলীল। অবিবাহিতা তরুণী থেকে পরিণত প্রেমিকা সব চরিত্রেই তিনি অনবদ্য। নায়িকা তকমাকে অতিক্রম করে তিনিই মহানায়িকা। উত্তমের সঙ্গে জুটি বেঁধে অভিনয় তাঁকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল ঠিকই তবে মহানায়িকা হতে গেলে এটুকুই যথেষ্ট নয়। রুপোলি জগতে তিনি যখন পা দেন তখন পরিচয় বলতে নিছক একটা ঘরোয়া মেয়ে, দেখতে শুনতে ভালো তাই নায়িকা হিসেবে বাছলেন পরিচালক নির্মল রায়। অন্যদিকে উত্তম কুমারও তখন নিতান্ত নবাগত। নায়ক সুলভ চেহারা বলতে ঠিক যা বোঝায় তখনও তার ধারে কাছে পৌঁছননি তিনি। ১৯৫৩ সালের ছবি সাড়ে চুয়াত্তর। বক্স অফিসে দারুণ হিট। উত্তমের পাশে এ ছবিতে আলাদাভাবে নজর কাড়লেন সুচিত্রা। ভাঙবে তবু মোচকাবে না’ গোছের এক রুচিশীলা তরুণীর ছবি এঁকে দিলেন দৃশ্যে। রুপোলি পর্দায় প্রেমিকা মূর্তির সার্থক প্রতিচ্ছবি তিনিই।
রমা দাশগুপ্ত থেকে সুচিত্রা সেন। বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ‘ম্যাডাম’ এবং অতঃপর মহানায়িকা খেতাব – এ এক বিরাট জার্নির আখ্যানবলয়। একের পর এক খ্যাতির সিঁড়ি চড়তে চড়তে আত্মপরিচয়কে সুস্পষ্ট করে দিয়েছেন ব্যক্তিত্বময়ী নারী। আপোষ করা তাঁর ধাতে ছিল না কোনওদিনই। বেপরোয়া, সাহসী, অত্যন্ত বাকপটু সুচিত্রার নানা গল্প বাতাসে ভেসে বেড়ায় আজও। স্টারডাম, আভিজাত্যের সঙ্গে সততা, আত্মবিশ্বাস এমন বৈচিত্র্যময় স্বভাবে রহস্যময়ী রমণীসত্ত্বার ঘেরাটোপ বরাবরই বজায় ছিল তাঁর। তার সঙ্গে ছিল ব্যক্তিগত জীবনের দোলাচল। সবকিছু সামলে তবুও অভিনয়ে ডুবে থেকেছেন। নিজের পরিচয় তৈরির এক অকৃত্রিম লড়াই লালন করেছেন অন্তরে। সুচিত্রা সেন, নামটাই কাফি। যেন আস্ত একটা ব্র্যান্ড। আর এ সবকিছুই নিজের স্বাতন্ত্র্যে। এমনকী হঠাৎ অন্তর্ধান, সেও তো একেবারে স্বেচ্ছায়। এমনটাই ছিলেন নায়িকা। ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আট বছর আগে আজকের দিনেই চিরতরে চলে যান মহানায়িকা।
আরও পড়ুন - সুচিত্রা বলতেন ‘দুষ্টু ছেলে’, ডার্লিং মুনের প্রেমে খড়কুটোর মতো ভেসে গিয়েছিলাম আমি…
‘সপ্তপদী’ সিনেমার সেই অমোঘ দৃশ্য। উত্তমের বাইকের পিছনে সুচিত্রা। বিখ্যাত সেই গান, “এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলো তো”। দৃশ্যে ক্যামেরা খুব কাছ থেকে ধরেছিল সুচিত্রার মুখ। প্রতিটা “তুমি বলো” শুনলে রীতিমত থমকে দাঁড়াতে হয়। লিপ দিচ্ছেন নাকি সত্যি সত্যিই গাইছেন গুলিয়ে যায় নিমেষে। “লা লা লাআআআ...” শুনেও মনে হয় হবহু যেন নায়িকার কণ্ঠ। এমনই রহস্যময়ী নারী সুচিত্রা। তবে রহস্যের জাল ছিঁড়তে পেরেছিলেন মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানির কর্ণধার কমল ঘোষ। সুচিত্রা সেনের কণ্ঠে রেকর্ড করা হল গান। ১৯৫৯ সালে বাজারে এল সেই রেকর্ড। রেকর্ডের ওপর জ্বলজ্বল করছে ‘গায়িকা’ সুচিত্রা সেনের নাম। ইতিমধ্যে নায়িকা হিসেবে অবশ্য যথেষ্ট পরিচিতি অর্জন করে নিয়েছিলেন সুচিত্রা। ফলে প্রিয় নায়িকার এমন নতুন পরিচয় সামনে আসতেই হতবাক দর্শক! রীতিমত হইচই পড়ে গেল সেই রেকর্ড নিয়ে। দোকানে আসতে না আসতেই হট কেক, মুহূর্তের মধ্যে সব সেল।
গ্রামাফোন রেকর্ডের সুরে স্বর মিলিয়ে সুচিত্রা গাইছেন “আমার প্রথম গানের নিমন্ত্রণে...”, আর সেই নিমন্ত্রণ পেয়ে মোহিত বাংলা। শোনা যায়, এর আগেও সুচিত্রা সেন মেকাপ রুমে গুনগুন করে প্রায়ই গান করতেন কিন্তু তাই বলে একেবারে রেকর্ডের গান, এ যেন তাক লাগায়! গবেষক দেবদত্ত গুপ্ত বলেন, ‘সঙ্গীতচর্চা ওঁর মধ্যে অবশ্যই ছিল। মনে রাখতে হবে, তখনকার দিনে বাংলার ঘরে ঘরে গান-নাচ শেখার একটা চর্চা ছিল। বিশেষ করে বাড়ির মেয়েদেরকে একটু গান বা নাচের তালিম দেওয়া হত। সেই ব্যাপারটি সুচিত্রা সেনের ক্ষেত্রেও যে ঘটবে, তাতে আশ্চর্য নেই। পরবর্তীকালে দেখেছি, তাঁর সঙ্গে শান্তিনিকেতনেরও যোগ ছিল। সুচিত্রা সেনের বোন স্বয়ং কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে সঙ্গীত ভবনে গান শিখেছেন। কাজেই, একটা রেওয়াজ তো ছিলই পরিবারে। অভিনেত্রী হওয়ার পর রেকর্ডিংয়ের যোগাযোগটা তাঁর কাছে আসে।’
আরও পড়ুন - ইস্টবেঙ্গলের জার্সি পরতে বাধ্য হলেন মহানায়ক, নেপথ্যে ছিল সুচিত্রা সেনের ‘দুষ্টুমি’!
একটা মাত্র গান তাতেই কিস্তিমাত! বাজারের চাহিদা বুঝিয়ে দিল কেবল নায়িকা নয় গায়িকা হিসেবেও যথেষ্ট যোগ্য ছিলেন সুচিত্রা সেন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় আবারও গান বাঁধলেন সুচিত্রা। ‘বনে নয় আজ মনে হয়’ গানটিও সমান জনপ্রিয় হ সেই সময়। বিক্রিও হল মারাত্মক। একটা গোটা যুগ সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে চিনেছিল সুচিত্রা সেনের অনবদ্য লিপে, কিন্তু নায়িকা নিজেও যে চাইলে দুকলি গাইতে পারতেন তা অনেকেই জানতেন না। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নিজেও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছিলেন, “প্রতিটি গানেই লিপের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সিরিয়াস ছিলেন সুচিত্রা। ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ গানটির ‘মিতা মোর কাকলি কুহু’ কথাগুলো যেখানে আসছে, ওই জায়গাগুলোয় লিপ দেওয়া কিন্তু ভীষণ কঠিন। বিশেষ করে ‘কুহু’ শব্দের আন্দোলনের যে বৈচিত্র্য তা পর্দায় এমন ভাবে লিপ দেন সুচিত্রা যা দেখে দর্শকরা আনন্দে আপ্লুত হয়েছিলেন।” তাই গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় যখন সুর দিলেন রবীন চট্টোপাধ্যায়, তখন কণ্ঠে সুচিত্রা সেন যেন আদপেই যথার্থ রূপে আত্মপ্রকাশ করলেন। সে যেন আস্ত একটা ম্যাজিক। নতুন করে রূপকথা রচনা করলেন ‘নায়িকা’।
তবে অমন চূড়ান্ত স্বীকৃতির পরেও কেন হারিয়ে গেলেন গায়িকা সুচিত্রা সেন? কেন ওই প্রথম আর ওই শেষবার গান রেকর্ড করলেন তিনি? কেন আজও যতবারই চর্চা হয় তাঁকে নিয়ে কেবল তাঁর অভিনয় জীবনেই আলোকপাত করা হয়? সেই সময় নায়িকার জনপ্রিয়তা মাথায় রেখেও কেন সুরকাররা এগিয়ে এলেন না? নাকি নাকি পর্দার সামনের অমন স্টারডমকে কোনও ভাবেই হারাতে চাননি নায়িকা নিজেই? হয়তো প্রকৃতই রাশ টানতে জানতেন তিনি। কোন দিকে ঠিক কতদূর এগোবেন সেটা ভেবে নিতেন। তাই অমন বিতর্ক সত্বেও ব্যক্তিগত জীবনেও শক্ত করে রাশ ধীরে রাখতে পেরেছিলেন তিনি। গায়িকা হিসেবে পথ চলতে গিয়ে মহানায়িকা খেতাবের সঙ্গে আপোষ করার বিন্দুমাত্র সুযোগ হয়তো দিতে চাননি খোদ নায়িকাই। তবে এইসব প্রশ্নের উত্তর আজও ধোঁয়াশা। ঠিক তাঁর অন্তর্ধান রহস্যের মতোই।