নদী-জঙ্গল-পাহাড় পেরিয়ে প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছচ্ছেন ওষুধ! কে এই প্রভাসিনী?
Odisha Health Service: প্রভাসিনী লক্ষ্য করেন, এই সম্প্রদায়ের মহিলারা এবং কিশোরীরা সাধারণত সামাজিক বিধিনিষেধের কারণেই পরিবারের সঙ্গে, বিশেষ করে পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে নিজেদের স্বাস্থ্য সমস্যার কথা মোটেও বলতে চায় না।
ইচ্ছে আর দায়িত্ববোধ! বোধ যদি জাগ্রত হয়, নানা অজুহাত, অনীহা, প্রতিকূলতা মিহি বালির মতো উড়ে যায় দিগন্তে। জেগে ওঠে লড়াইয়ের গল্প, জেগে ওঠে হার না মানার জেদ। এমনই এক জেদের নাম প্রভাসিনী। নদীর তীব্র স্রোত, মাইলের পর মাইল কষ্টসাধ্য পথ- কোনও কিছুই তাঁকে আটকে রাখতে পারেনি নিজস্ব আরামে। ওড়িশার কান্ধমাল জেলার উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিত করেছেম প্রভাসিনী বাটাকার, প্রতিদিন এই প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে গড়ে তুলেছেন সচেতনতার আবহ। ইতিমধ্যেই তিনি গ্রামে অপুষ্টি-মুক্তি প্রকল্পে কাজ শুরু করেছেন। এর ফলে প্রায় ২১০০০-এরও বেশি গ্রামবাসী প্রত্যেক্ষ পরোক্ষ ভাবে উপকার পেয়েছেন।
কান্ধমাল ওড়িশা রাজ্যের একটি প্রত্যন্ত জেলা, যা শহর থেকে প্রায় ১৫৬ মাইল দূরে অবস্থিত। এমনই প্রত্যন্ত অঞ্চল, যেখানে স্বাস্থ্য পরিষেবা সোনার পাথরবাটিই। ফলত স্বাস্থ্য সমস্যা নিরাময়ের ব্যবস্থা করাও যথেষ্ট কঠিন কাজ। কিন্তু প্রভাসিনী বাটাকার বলছেন, “চার দেওয়াল মহিলাদের চমকপ্রদ হওয়া থেকে আটকাতে পারে না এবং ইতিমধ্যে এমন অনেকেই আছেন যাঁরা লড়াই করে নিজেদের জায়গা তৈরি করে নিয়েছেন।” ৩৩ বছর বয়সী প্রভাসিনী এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য পরিষেবা অবস্থার উন্নত ঘটাতে রাতদিন এক করে দিচ্ছেন। কান্ধামাল জায়গাটি পাহাড়ি। ফলে এখানকার বেশিরভাগ উপজাতিরাই পাহাড়ি অঞ্চল অথবা বনাঞ্চলেই বাস করেন। বলাইবাহুল্য, এই এলাকার ভৌগোলিক অবস্থার কারণে রাস্তা এবং টেলিফোন সংযোগের সঠিক পরিকাঠামোও গড়ে ওঠেনি। সুতরাং সমস্ত রকম প্রয়োজনীয় সুবিধা, ব্যবস্থা থেকে ক্রমাগত বঞ্চিত হয়ে এসেছেন এই এলাকার বাসিন্দারা।
আরও পড়ুন- ছিল কুষ্ঠরোগীদের নিরাময়ের স্থল, এখন তাক লাগানো সমুদ্র! কলকাতার কাছেই রয়েছে এই খাজানা
তবে এসব কিছুই প্রভাসিনীর কাছে অজানা নয়। গোড়া থেকেই সবটা জানেন তিনি। এমন প্রত্যন্ত গ্রামে রোজ গিয়ে কাজ করা যথেষ্ট কঠিন একথা জেনেই মাঠে নামেন তিনি। এলাকার মানুষের এমন চরম দুর্দশা সহ্য করতে না পেরেই বাঁচার মৌলিক অধিকারের প্রয়োজনের কথা মাথায় রেখেই কাজ করে চলেছেন প্রভাসিনী। তবে উপজাতীয় সম্প্রদায়গুলির মধ্যে প্রবলভাবে জড়িয়ে রয়েছে কঠোর সামাজিক-সাংস্কৃতিক রীতি। এই জগদ্দলসম ধ্যান ধারণা যে তাঁর স্বাস্থ্যপরিষেবা প্রসারণের কাজে বাধা সৃষ্টি করবে, এমনটা আগেই বুঝেছিলেন তিনি।
এরই মধ্যে গ্রাম জুড়ে দেখা দেয় মহামারি! উপজাতি-সহ অন্যান্য প্রান্তিক সম্প্রদায়ের অনেক মানুষ ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েন। আর এই স্বাস্থ্য সংকটের মূলে রয়েছে অপুষ্টি। প্রভাসিনী জানিয়েছেন, তিনি কাজে নামার পর থেকেই এই সম্প্রদায়গুলির কল্যাণের স্বার্থে তিনি অনেক ব্যবস্থাপনাই নিয়েছেন যেমনটা তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। প্রভাসিনীর এই সফর শুরু হয় ২০১৮ সালে। ‘অপুষ্টি-মুক্ত গ্রাম’ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হন। তারপর থেকে হেলথ-কিট ইন্টারভেনশনের অধীনে ‘স্বাস্থ্য অ্যানিমেটর’ হিসাবে কাজ করছেন তিনি। আসলে এটি একটি সম্প্রদায়-মালিকানাধীন মডেল, যার উদ্দেশ্য প্রশিক্ষিত গ্রাম-ভিত্তিক স্বাস্থ্যকর্মীর মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রাথমিক প্রতিরোধমূলক ওষুধ সরবরাহ করা এবং রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারা প্রকল্পিত স্বাস্থ্য প্রকল্পগুলির সঙ্গে তাদের যোগসূত্র স্থাপন করা ।
প্রভাসিনীর এই স্বাস্থ্য পরিষেবা প্রদানের সম্পূর্ণ ইচ্ছা থাকলেও কোথাও একটা পিছুটান হয়ে থেকে গিয়েছিল নিজের পরিবারের প্রতি তাঁর দায়িত্ব। তবে এত কিছুর পরেও সমস্ত বাধাকে উপেক্ষা করেই কাজের সূত্রে তিনি প্রতিদিন প্রায় ২-৩ টি গ্রামে ঘুরতেন। এইভাবে তিনি তুমুদিবান্ধা ব্লকের ৭৬ জন পুরুষ এবং ৩৭ জন মহিলাকে স্বাস্থ্যসাথী প্রকল্পের পর্যবেক্ষণের জন্য বেছে তৈরিও করে নিয়েছিলেন।
প্রভাসিনী লক্ষ্য করেন, এই সম্প্রদায়ের মহিলারা এবং কিশোরীরা সাধারণত সামাজিক বিধিনিষেধের কারণেই পরিবারের সঙ্গে, বিশেষ করে পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে নিজেদের স্বাস্থ্য সমস্যার কথা মোটেও বলতে চায় না। ফলে কোনও শারীরিক সমস্যা হলে স্রেফ না বলার দ্বিধা থেকেই চিকিৎসাও গ্রহণ করতে পারে না। মহিলা বলেই প্রভাসিনীর কাছে অবশ্য নিজেদের শারীরিক সমস্যার কথা খোলসা করতেন গ্রামের মহিলারা। এই বিষয়টি কোথাও না কোথাও প্রভাসিনীকে তাঁর কাজে সাহায্যও করে, প্রেরণা জোগায়।
আরও পড়ুন- কেউ বলেন ‘হিরো’, কেউ ’রাস্তার গুন্ডা’! আসলে কে এই বিতর্কিত গোপাল পাঁঠা?
ধীরে ধীরে গ্রামবাসী এবং জনপ্রতিনিধিদের কাছেও নির্ভরতার এক নাম হয়ে উঠেছেন প্রভাসিনী। অনেক গ্রামবাসীই জানিয়েছেন, আগে সামান্য জ্বর বা মাথাব্যথার চিকিৎসার জন্য, সরকার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছতে তাঁদের প্রায় ৮ থেকে ১০ কিলোমিটার যেতে হত। যাতায়াত অনেক ব্যয়বহুল এবং অনেক সময়সাপেক্ষও ছিল। পরিবহন ব্যবস্থার বিশেষ সুবিধা না থাকার কারণে তাঁদের প্রতিবার ২০০ থেকে ৫০০ টাকা খরচ করতে হতো। অনেকবার এমনও হয়েছে, হাসপাতালে পৌঁছনোর আগেই চিকিৎসক বেরিয়ে গেছেন। কিন্তু প্রভাসিনী এবং তাঁর দলের সুবাদে এখন এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে না আর।
গুমা গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান সুস্মিতা মাঝির কথায়, “রাজ্য সরকারেরও উচিত এই সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্য চাহিদাগুলিকে নজরে রেখে এলাকায় পরিষেবা ও পরিবহন ব্যবস্থার উপর কাজ করা।” প্রভাসিনী যে কেবল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়েই কাজ করেছেন এমন নয়। বাল্যবিবাহ, ঋতুচক্রের স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কেও মানুষকে সচেতন করেছেন। গ্রামের বিভিন্ন পরিবারে পুষ্টির চাহিদা মেটাতে বাড়ির পিছনে কিচেন গার্ডেন তৈরি করতেও গ্রামবাসীদের উদ্বুদ্ধ করছেন।