নিমতলা শ্মশানে বসেছিল আদালত! ১১৯ বছর আগের এই দুর্ঘটনা কাঁপিয়ে দিয়েছিল কলকাতাকে

Car Accidents of Old Kolkata: বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় কলকাতায় এমন এক পথ দুর্ঘটনা ঘটেছিল যার ফলে নিমতলা শ্মশানে করোনারস কোর্ট বসেছিল।

এক যে ছিল প্রাচীন কলকাতা। বর্তমান মহানগরীর সঙ্গে তার বিস্তর ফারাক কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই দুই কলকাতার মধ্যে রয়েছে অনেক মিল। আশ্চর্য একটি মিল রয়েছে সেকালের কলকাতার দুর্ঘটনা আর একালের কলকাতার দুর্ঘটনার মধ্যে। দুর্ঘটনা বলতে মূলত সড়ক দুর্ঘটনাই। পাঠক ভাবতেই পারেন যে, পুরোনো কলকাতা মানে আমরা কথা বলছি ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকের সময়ের, সেই সময়ে রাস্তায় এত যানবাহনই বা কোথায় ছিল যে পথ দুর্ঘটনা ঘটবে? হয়তো সেই সময়ে বর্তমানের মতো হইহই করা যানবাহন ছিল না কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটত এবং বহু ক্ষেত্রেই তার কারণ বর্তমান সময়ে ঘটে চলা পথ দুর্ঘটনার কারণের সঙ্গে মিলে যায়। সেই সময়ের বহু দুর্ঘটনার খবর সংবাদপত্র অথবা ডায়রিতে স্থান পেত। সেই সব খুঁজে পেলে দেখা যায় যে, কলকাতা বহুলাংশে বদলে গেলেও অনেকাংশে একইরকম থেকে গিয়েছে।

কলকাতায় ব্রিটিশ শাসনের শুরুর দিকে জেন্টলম্যান অ্যাটর্নি হিসাবে পরিচিত ছিলেন উইলিয়াম হিকি। আগেই জানিয়ে রাখি যে, উইলিয়াম হিকি পেশায় উকিল ছিলেন। বেঙ্গল গেজেট জেমস হিকির সংবাদপত্র ছিল। তাঁর সামাজিকতা এবং ভোজসভার কারণে তিনি খুব ভালো নিমন্ত্রণকর্তা হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর স্মৃতিকথা থেকেই এক পথ দুর্ঘটনার কথা জানতে পারা যায়। তাঁর আয়োজিত এক নৈশভোজে আকণ্ঠ মদ্যপান করে সবাই যখন প্রায় বেহুঁশ, তখন তিনি পার্টিতে উপস্থিত ক্যাপ্টেন হেফারম্যানকে নিয়ে নিজের ফিটন গাড়ি চেপে ঘুরতে বেরোলেন। যেহেতু হেফারম্যান শারীরিক কারণেই আর মদ্যপান করতে পারছিলেন না তাই উইলিয়ামের বিশ্বাস ছিল যে গাড়ি চেপে হাওয়া খেয়ে এলে তাদের শরীর চাঙ্গা হয়ে উঠবে।

আরও পড়ুন-ইয়াস, আমফানের চেয়েও বীভৎস! ১০০০ জনের সলিল সমাধি হয় কলকাতার যে ঘূর্ণিঝড়ে

মদ্যপ অবস্থায় ফিটন চালানোই হোক অথবা বর্তমানের যানবাহন চালানো, পরিণতি একই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। উপরন্তু, পুরোনো কলকাতায় মদ্যপ অবস্থায় ফিটন চালানো নিষেধ জাতীয় কোনও বিধিনিষেধও হয়তো ছিল না। প্রথম আধঘণ্টা সামলাতে পারলেও তারপরে গলা অবধি মদ্যপান করা উইলিয়াম ঘোড়া সামলাতে পারলেন না। দিক ভুল হয়েছে কিনা জানতে চাওয়া হেফারম্যানকে সত্যি জানালেও ঠিক পথে যাওয়ার আগেই ঘোড়া বেলাগাম হয়ে গেল এবং গাড়িসমেত দু'জনই এক বিশাল গর্তের মধ্যে পড়লেন। সেই গর্ত থেকে কোনওক্রমে নিজেকে উদ্ধার করে সাহায্যের খোঁজ করতে গিয়ে উইলিয়াম অপর একটি গর্তের মধ্যে পড়লেন। খানিক সময় পরে কিছু স্থানীয় মানুষের সহযোগিতায় তারা হাসপাতালে পৌঁছেছিলেন। ঘোড়া দু'টি এবং হেফারম্যানের তুলনায় উইলিয়াম বেশি চোট পেয়েছিলেন। এই ঘটনার পরে হেফারম্যান জানিয়ে দেন যে তিনি ভবিষ্যতে কোনও মদ্যপ গাড়োয়ানের গাড়িতে চড়বেন না।

১৮৪৩ সালের ২৯ মে, সমাচার চন্দ্রিকাতে মত্ত অবস্থায় এক ব্যক্তির পথ দুর্ঘটনায় মৃত্যুর খবর জানা যায়। চিনেবাজারের কাছে এক ব্যক্তি মত্ত অবস্থায় রাস্তা পার হতে গিয়ে দ্রুতগতিতে আসা চেরেট গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়েছিলেন। এই চেরেট আসলে এক ধরনের ঘোড়ার গাড়ি।

১৮৪৩ সালে ৩ অগাস্ট, সমাচার চন্দ্রিকাতেই এক হৃদয় বিদারক দুর্ঘটনার কথা জানা যায়। সেই সংবাদ অনুযায়ী, রাতের বেলা পথের ধারে এক মা তার মেয়েকে নিয়ে ঘুমোচ্ছিলেন। ঘুমন্ত অবস্থায় মেয়েটির মাথার উপর দিয়ে ঘোড়ার গাড়ির চাকা চলে যাওয়ায় মেয়েটির মৃত্যু হয় কিন্তু মা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকার কারণে পরের দিন সকাল অবধি এই ঘটনার কথা জানতেই পারেননি।

আরও পড়ুন- দক্ষিণ কলকাতার ব্যস্ততম রাস্তা! হরিশ মুখার্জি রোডের নেপথ্যের মানুষকে চিনলই না বাঙালি

১৮৪৩ সালেই ২১ সেপ্টেম্বর, সমাচার চন্দ্রিকার সংবাদ অনুযায়ী, ভোরবেলা কয়েকজন কৃষক সবজি এবং ফল কলকাতায় বিক্রি করতে যাচ্ছিলেন। রাস্তার মধ্যে এক সাহেবের ঘোড়ার গাড়ির চাকায় এক কৃষকের পা পিষ্ট হয়। পরিস্থিতি দেখে কৃষককে সাহায্য করার পরিবর্তে সাহেব তার কৌচম্যানকে তাড়াতাড়ি গাড়ি চালিয়ে সেই এলাকা থেকে পালিয়ে যেতেই বলে।

বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় কলকাতায় এমন এক পথ দুর্ঘটনা ঘটেছিল যার ফলে নিমতলা শ্মশানে করোনারস কোর্ট বসেছিল। ১৯০৪ সালে ডিসেম্বর মাসে এক বিকেলে কলকাতার স্বর্ণ ব্যবসায়ী প্রেমসুকরায় ঝুনঝুনওয়ালা তাঁর গাড়িতে চেপে বাড়ি ফিরছিলেন। সেই সময়ে তাঁর গাড়ির সঙ্গে ঘোড়ায় টানা ট্রামের সংঘর্ষ ঘটে এবং ঘটনাস্থলে তাঁর মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় কলকাতার মারোয়াড়ি সমাজ বড়লাট কার্জনের কাছে গিয়ে বিনা ব্যবচ্ছেদে শব ছেড়ে দেওয়ার অনুমতি চেয়েছিল। বড়লাট বিনা ব্যবচ্ছেদে শব ছেড়ে দেওয়া এবং শ্মশানে করোনারস কোর্ট বসার অনুমতি দিয়েছিলেন। সেই কারণেই প্রথম এবং শেষবারের মতো শ্মশানে আদালত বসেছিল।

 

তথ্য ঋণ- ৩০০ বছরের কলকাতা : পটভূমি ও ইতিকথা- ডাঃ অতুল সুর, কলকাতা শহরের ইতিবৃত্ত (প্রথম খণ্ড)- বিনয় ঘোষ

More Articles