বয়স সাড়ে তিনশো পার! জানেন কলকাতার প্রাচীনতম গঙ্গার ঘাট কোনটি?

Oldest Ghat of Ganga: পুরনো কলকাতার গঙ্গার ঘাটের নাম সংক্রান্ত আলোচনায় চাঁদপাল ঘাটের নাম উঠে আসতে বাধ্য।

ভূপেন হাজারিকা গেয়েছিলেন,

  বিস্তীর্ণ দু'পারের, অসংখ্য মানুষের
  হাহাকার শুনেও
  নিঃশব্দে নীরবে - ও গঙ্গা তুমি
  ও গঙ্গা বইছ কেন?

গঙ্গার শাখা হুগলি গঙ্গার সেই চরিত্র বজায় রেখেছে। যুগ যুগ ধরে সে বহু ঘটনার সাক্ষী। সেই সব ঘটনা, চেনা ঐতিহাসিক চরিত্র থেকে শুরু করে অচেনা মানুষের গল্প যেন বুকের মধ্যে জমিয়ে রেখেছে এই নদী। কলকাতার বাবুদের নৌকা করে মাহেশের রথযাত্রা দেখতে যাওয়া থেকে খড়দহের রাসের মেলা দেখতে যাওয়া, ওলন্দাজদের কুঠি নির্মাণ থেকে, কলকাতার বুকে জোব চার্ণকের পদার্পণ, গোবিন্দরাম মিত্রের তৈরি নবরত্ন মন্দিরের চূড়া থেকে ব্রিটিশ জাহাজের ঘাটের অবস্থান নির্ধারণ, সিরাজ-উদ-দৌলার কলকাতা আক্রমণের ভয়ে জাহাজে নৌকায় চেপে সাহেব-মেমদের পলায়ন, অতিমারির প্রকোপে লাশের মিছিল- সবকিছুর গল্প যেন তার জল-তরঙ্গ, সব কিছুই জানে নদীর উপরে বয়ে যাওয়া বাতাসেরা। আর জানে তার দু'পাশে গড়ে ওঠা অসংখ্য ঘাট। সেই ঘাটগুলো মানুষের খুবই পরিচিত কিন্তু বেশিরভাগ মানুষ ভুলতে বসেছে সেই ঘাটগুলোর এবং তাদের নামের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিচিত্র ইতিহাস।

যখন পুরনো কলকাতা এবং গঙ্গার ঘাট নিয়ে গল্প শুরুই হলো তাহলে গোড়া থেকেই বলা যাক। কলকাতার প্রাচীনতম গঙ্গার ঘাট কোনটি? এই প্রশ্নের উত্তরে কলকাতার সবচেয়ে পুরনো ঘাটের দাবিদার হিসাবে আমরা তিনটে ঘাটের নাম পাই। চাঁদপাল ঘাট, সুতানুটি ঘাট এবং পুরনো কেল্লার পিছনের ঘাট (যাকে উডের মানচিত্রে ওল্ড ফোর্ট ঘাট হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে)। যদিও কলকাতার উপকণ্ঠে থাকা একটি ঘাট এই প্রাচীনত্বের দৌড়ে চাঁদপাল ঘাট এবং সুতানুটি ঘাটকে টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। বরাহনগরের সেই ঘাটের নাম কুঠিঘাট।

আরও পড়ুন- মানিকতলার ‘মানিক’ আসলে কে? কীভাবেই বা এল হেদুয়ার নাম?

১৬০২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ ভারতে ওলন্দাজদের আগমন ঘটে। সময়ের সঙ্গে বাংলার দিকে অগ্রসর হয়ে সম্ভবত ১৬৫৯ খ্রিস্টাব্দে বরাহনগরের গঙ্গার কাছে তারা একটি কুঠি স্থাপন করে। ওলন্দাজদের কুঠির কাছে গঙ্গা পারাপারের জন্য ব্যবহৃত ঘাটের নাম হয় কুঠির ঘাট যা কালক্রমে কুঠিঘাট নামে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি পায়। পুরনো ঘাটটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হওয়ার ফলে বর্তমান ঘাট তৈরি হয়েছে যদিও ওলন্দাজদের আমলের সেই ঘাটের নিদর্শন এখনও কিছুটা থেকে গিয়েছে। এইবার সময়টা ২৭ বছর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাক। ১৬৮৬ সালের ডিসেম্বর মাসে সুতানুটির ঘাটে জাহাজ থেকে নামেন জোব চার্ণক। যদিও সুতানুটির কোন ঘাটে জোব চার্ণক জাহাজ থেকে নেমেছিলেন সেই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। তবুও একটা কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, রথতলা ঘাট এবং আহিরীটোলা ঘাটের মধ্যবর্তী কোনও স্থানে সুতানুটি ঘাট ছিল। জোব চার্ণকের লেখা থেকে জানা যায়, সেই ঘাটে এক প্রকাণ্ড বট গাছ ছিল। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, সেই সময়ে আহিরীটোলা ঘাট বলতে অন্য একটি ঘাট বোঝানো হতো যার বর্তমানে কোনও অস্তিত্ব নেই। ব্রিটিশদের তৈরি পুরনো কেল্লার পিছনের ঘাট যথেষ্ট পুরনো।

১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৯ জুন যখন সিরাজ-উদ-দৌলা কলকাতা আক্রমণ এবং পুরনো কেল্লা অবরোধ করেন সেই সময়ে কেল্লায় উপস্থিত ব্রিটিশরা কেল্লার পিছনের ঘাট থেকে নৌকা এবং জাহাজে চেপে ফলতায় পালিয়ে গিয়েছিল। পুরনো কলকাতার গঙ্গার ঘাটের নাম সংক্রান্ত আলোচনায় চাঁদপাল ঘাটের নাম উঠে আসতে বাধ্য। ব্রিটিশ এবং অন্যান্য ইউরোপিয়দের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় এই ঘাটের নামের উৎস ছড়িয়ে আছে মানুষের গল্পকথায়। কথিত আছে, ঘাটের পাশেই চন্দ্রনাথ পাল অথবা চাঁদ পাল নামে এক ব্যবসায়ী নিত্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসের ব্যবসা করতেন। তার নাম থেকেই চাঁদপাল ঘাট নিজের নাম পেয়েছে। ১৭৫৩ এবং ১৭৭৪ সালের নথিপত্রে এই ঘাটের অস্তিত্ব জানতে পারা যায়। ব্রিটিশদের এই ঘাটটি যে বিশেষ পছন্দের ছিল, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুপ্রিম কাউন্সিলের সদস্য থেকে বড়লাট লর্ড কর্ণওয়ালিশের এই ঘাটে প্রথম অবতরণের মধ্যে দিয়ে তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

আরও পড়ুন- ধর্মতলার নাম ধর্মতলা হলো কেন! মনোহর পুকুরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোন ইতিহাস?

হিন্দুদের কাছে নিমতলা ঘাট মহাশ্মশান হিসাবে পরিচিত হলেও পুরনো কলকাতায় হুগলির তীরে বড় এবং ব্যস্ত শ্মশান হিসাবে কাশী মিত্র ঘাটের নাম নিমতলা ঘাটের সঙ্গে সমান গুরুত্ব পেয়ে এসেছে। কাশী মিত্র গোবিন্দরাম মিত্রের বংশের মানুষ। গোবিন্দরাম মিত্র ছিলেন কলকাতার প্রথম কালো জমিদার। প্রচুর অর্থ উপার্জনের সঙ্গে তিনি এক বিশাল নবরত্ন মন্দির তৈরি করেছিলেন যা সেই সময়ের বিদেশি নাবিকদের কলকাতার আশেপাশের এলাকা নির্ধারণে সাহায্য করত। বর্তমানে আমরা যেমন করোনা অতিমারির প্রকোপ সহ্য করেছি ঠিক সেইভাবেই প্রায় একশো বছর আগে অতিমারির আকার নিয়ে মানুষের সর্বনাশ ডেকে এনেছিল স্প্যানিশ ফ্লু। মানুষের কাছে যুদ্ধজ্বর নামে পরিচিত হওয়া সেই রোগের প্রকোপে বহু প্রাণহানি ঘটে। সেই সময়ে কাশী মিত্র ঘাটে সৎকার করতে নিয়ে আসা দেহের লাইন প্রায় বাগবাজার স্ট্রিট অবধি পৌঁছে গিয়েছিল। নিমতলা মহাশ্মশানের তিনবার স্থান পরিবর্তন হয়েছে।বর্তমান আনন্দময়ী কালী মন্দিরের স্থানে প্রথম নিমতলা শ্মশানের অবস্থান ছিল। পুরনো কলকাতায় এক সময় স্ট্র্যান্ড রোডের এলাকা দিয়ে গঙ্গা প্রবাহিত হতো। কালক্রমে গঙ্গা পশ্চিমদিকে সরতে শুরু করলে শ্মশানের স্থান পরিবর্তন করা হয়।

কলকাতার গঙ্গা এবং গঙ্গার এক একটি ঘাট আস্ত গল্পের খনি। যুগ যুগ ধরে এই ঘাটেরা মানুষের গল্প সঞ্চয় করে ঝুলি ভরে। কলকাতার ঘাটের কথা শুধু গল্প নয়, ইতিহাসের আস্ত দলিল।


তথ্য ঋণ : গঙ্গার ঘাট : ডা: শিশুতোষ সামন্ত, ৩০০ বছরের কলকাতা : পটভূমি এবং ইতিকথা : ডা: অতুল সুর, পুরনো কলকাতা।

More Articles