বাড়ির পাশে ব্যান্ডেল, মন্দির থেকে চার্চ, রঙিন যে ইতিহাস আজও জেগে আছে

Bandle Tour : কলকাতা থেকে দিনের দিন গিয়ে দিব্যি সন্ধের মধ্যে বাড়ি ফিরে আসা যায় এই জায়গা থেকে

ভ্রমণ প্রেমীদের জন্য বছর মাস দিন এসব থাকে না। সুযোগ পেলে বেরিয়ে পড়াই তাঁদের ধর্ম। কম খরচে বেশ অনেকগুলো স্থান ঘোরা যায়, এমনই এক জায়গার কথা বলব এই প্রতিবেদনে। এক সময়ে বাণিজ্যের প্রাণ কেন্দ্র 'বন্দর ' বা বান্দার, আজকের পরিচিত নাম ব্যান্ডেল। কলকাতা থেকে দিনের দিন গিয়ে দিব্যি সন্ধের মধ্যে বাড়ি ফিরে আসা যায় এই জায়গা থেকে। তাই একদিনের ভ্রমণের পরিকল্পপনা করলে পরেরবার ব্যান্ডেলকে রাখুন তালিকায়।

ব্যান্ডেল কীভাবে যাবেন?

হাওড়া শিয়ালদহ, বর্ধমান, কাটোয়া সব দিক থেকেই ট্রেনে করে ব্যান্ডেল আসা যায়। হাওড়া থেকে প্রায় প্রতি ১৫ মিনিট অন্তর ব্যান্ডেল লোকাল থাকে। টিকিট মূল্য ১০ টাকা। ব্যান্ডেল আসার পর ব্যান্ডেল স্টেশন থেকে অটো বা টোটো করে চলে যাওয়া যায় দর্শনীয় স্থান গুলিতে।

কী কী দেখবেন?

কোড়লা কালীবাড়ি - দেবানন্দপুরের কোড়লা গ্রামে প্রায় ৪০০ বছরের এক জাগ্রত কালীবাড়ি। কথিত আছে, ঘোষাল সর্দার নামক এক ডাকাত সর্দার স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন মা সিদ্ধেশ্বরী পুস্করিণীতে আছেন, সেখান থেকে তাঁকে উদ্ধার করে প্রতিষ্ঠা করতে। নির্দেশ অনুযায়ী পুকুরের পাশেই মায়ের মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। বর্তমানে কোড়লার এই মন্দিরে রয়েছে বড় আকারের মাতৃ মূর্তি এবং তার বাম দিকে আজও প্রতিষ্ঠিত ঘোষাল সর্দারের সেই প্রাচীন মূর্তি। মন্দিরের দুই পাশে দুই বাড়ি, যা এলাকায় বড়ো বাড়ি ও ছোট বাড়ি নামে পরিচিত। মন কাড়বে এখানকার মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং আম বাগানের ভিতর দিয়ে এগিয়ে চলা বেশ রোমাঞ্চকর লাগবে।

আরও পড়ুন - ব্যান্ডেল চিজ, যে সুতোটা বেঁধেছে বাংলা আর পর্তুগালকে

লাহিড়ী বাবার আশ্রম - ব্যান্ডেলের রাজহাট গ্রামে লাহিড়ী বাবা আশ্রম অবস্থিত। লাহিড়ী বাবার আশ্রমের কম্পাউন্ডে ঢোকার পরে চোখে পড়বে একটি সুন্দর বাগান। এই বাগানের ভিতরে রয়েছে বিভিন্ন রকমের ফুল গাছ। একটি কংক্রিটের রাস্তা দিয়ে কিছুটা হেঁটে যাওয়ার পরেই মূল মন্দির। মন্দিরটি একটি ছোট্ট পুকুরের উপর অবস্থিত। মন্দিরে পৌঁছানোর সময় ছোট একটা ব্রিজের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হবে পুকুরটি পেরোনোর জন্য। লাহিড়ী বাবার আশ্রমে একটি মন্দির নয় এর ভিতরে একাধিক ছোট ছোট মন্দির রয়েছে। সমস্ত মন্দির প্রাঙ্গণ জুড়ে মহাদেব, নারায়ন, শ্রীকৃষ্ণ, মা দুর্গা থেকে বুদ্ধ, মাদার মেরি এবং যীশুখ্রিস্টের মত বিগ্রহ রাখা আছে যা মানবজাতিকে বলে দেয় ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে থাকতে, বলে দেয় সবাইকে একসাথে হাতে হাত রেখে একে অপরকে সাহায্য করার কথাও। কারণ ঈশ্বরের কাছে সব থেকে বড় ধর্ম হল সেবা। প্রধান মন্দিরে ঢোকার পর নিচের দিকে বিভিন্ন আসনে হাতের প্রতীক দেওয়ালে খোদাই করা রয়েছে এবং সেই চিহ্ন গুলির মাঝে লাহিড়ী বাবার এক বিগ্রহ আছে।

এই আশ্রমে প্রবেশ করার বিশেষ এক নিয়ম রয়েছে : মহিলাদের জন্য মন্দিরে ঢোকার আগে মাথায় অবশ্যই একটি চাদর বা শাল ঢাকা দেওয়া আবশ্যক এবং হাটুর উপরে কোনো বস্ত্র পরা একেবারেই অনুমতি দেওয়া হয় না। পুরুষদের নিজের মাথা ঢেকে রাখা চলবে না। মন্দিরের ভেতরে কোন রকম ছবি তোলা যাবে না। লাহিড়ী বাবার আশ্রমে ঢোকার জন্য কোনও এন্ট্রি ফি লাগে না। লাহিড়ী বাবার আশ্রমে থেকে প্রসাদ নেওয়ার সময় দুপুর ১২টার পর। ভোগের জন্য কুপন কাটতে হয় অফিস কাউন্টার থেকে।

কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি - ব্যান্ডেল স্টেশন থেকে চার কিলোমিটার দূরে দেবানন্দপুর গ্রামে ১৮৭৬ সালে ১৫ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেছিলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। বর্তমানে কথাশিল্পীর জন্ম ভিটে সুন্দর ভাবে রক্ষণ করা আছে। এই বাড়ির কাছেই রয়েছে শরৎচন্দ্র স্মৃতি পাঠাগার ও সংগহশালা। সাহিত্যিকের জীবনের অনেক স্মারক ও ঘটনাপ্রবাহ খুব সুন্দর ভাবে গোছানো আছে সংগহশালায়। রয়েছে আরাম কেদারা, মানপত্র ইত্যাদি।

ইমামবাড়া - ইমামবাড়া হুগলি জেলার বহু ইতিহাসের সাক্ষী। শুধু তার স্থাপত্য বা ভাস্কর্যই নয়। এর অন্যতম আকর্ষণ হল পৃথিবী বিখ্যাত ঘড়ি। ইমামবাড়ার প্রবেশদ্বারের উপর রয়েছে একটি বড় চূড়া। যার উচ্চতা প্রায় ১৫০ ফুট। সেই চূড়ায় ওঠার জন্য দুইদিকে রয়েছে দুটি সিঁড়ি।সেই চূড়ার মাঝ বরাবর অবস্থিত একটি বিস্ময়কর ঘড়ি। ঘড়িটি থেকে সময় জানার পাশাপাশি ঘণ্টার মাধ্যমে আওয়াজ শোনা যায়।

ব্যান্ডেল চার্চ - ব্যান্ডেল এর অন্যতম এবং প্রধান আকর্ষন ব্যান্ডেল চার্চ। ১৫৯৯ সালে হুগলি নদীর তীরে একটি গির্জা স্থাপন করা হয়, সেটাই পশ্চিমবঙ্গের প্রথম গির্জা বর্তমানের ব্যান্ডেল চার্চ।

আরও পড়ুন - রাশিয়ান চার্চের সঙ্গে মিল, তান্ত্রিক মতে তৈরি হংসেশ্বরীর তুলনা ভূ-ভারতে নেই

হংসেশ্বরী মন্দির - দেবী কালীর একটি রূপ হংসেশ্বরী এখানে প্রতিষ্ঠিত। রাজা রামেশ্বর রায়ের প্রণাম প্রপৌত্র নৃসিংহদেব রায় বাঁশবেড়িয়া হংসেশ্বরী মন্দির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। পরবর্তীতে ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরে ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করা হয়। কিন্তু ১৮০২ খ্রিস্টাব্দে মন্দিরের কাজ অসম্পূর্ণ রেখে নৃসিংহদেব মারা যান। ১৮১৪ খ্রিস্টাব্দে নৃসিংহদেবের দ্বিতীয় স্ত্রী রাণী শঙ্করী অসমাপ্ত কাজটি সম্পন্ন করেন। মন্দিরটি তৈরীর জন্য উত্তর প্রদেশের চুনার থেকে পাথর এবং রাজস্থানের জয়পুর থেকে কারিগরদের নিয়ে আসা হয়েছিল।

অনন্ত বাসুদেব মন্দির - হংসেশ্বরী কালীমন্দিরের পাশেই অবস্থিত একটি কৃষ্ণ মন্দির। ১৬৭৯ সালে রাজা রামেশ্বর দত্ত এই মন্দিরটি নির্মাণ করান। মন্দিরটি তার দেওয়ালের কারুকাজের জন্য বিখ্যাত। এই মন্দির এখন বন্ধ থাকে।

বাঁশবেড়িয়া রাজবাড়ি - হংসেশ্বরী মন্দির ও অনন্ত বাসুদেব মন্দিরের সামনেই এই রাজবাড়িটি রয়েছে। তবে এখানে প্রবেশ করা যায় না বর্তমানে।

হুগলি জেল - বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে এখানে আটকে রাখা হয়েছিল। এখানে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে তাঁর একটি মূর্তিও স্থাপন করা হয়েছে।

এছাড়াও ব্যান্ডেলে রয়েছে হাজী মুহম্মদ মুহসীন এর কবরস্থান, গায়ত্রী আশ্রম। এই সবগুলো স্থান একদিনে ঘুরে সহজেই আবার বাড়ির পথে রওনা দেওয়া যায়।

More Articles