এক দেশ এক ভোট: কৌশলে যে উদ্দেশ্য সফল করতে চাইছে গেরুয়া শিবির
One Nation One Election: 'এক দেশ এক নির্বাচন' পরিকল্পনার নেপথ্যে যে যুক্তিগুলোকে সামনে আনা হচ্ছে একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, কতটা ফাঁপা সেইসব যুক্তি।
প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামানাথ কোবিন্দের ‘এক দেশ এক নির্বাচনে’র সুপারিশ যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা অনুমোদন করবে, তা একরকম প্রত্যাশিতই ছিল। আগামী লোকসভার শীতকালীন অধিবেশনে এই সংক্রান্ত রিপোর্টটি পেশ করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে। রাজ্যসভা এবং লোকসভায় যদি এই বিলটি পাশ হয়ে যায় এবং তারপরে যদি দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এটি বাধাহীন ভাবে বেরিয়ে যায়, তাহলে 'এক দেশ এক নির্বাচন' লাগু হওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা। এই বছরের স্বাধীনতা দিবসের দিন, লাল কেল্লা থেকে প্রধানমন্ত্রী যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সেই ভাষণেও 'এক দেশ এক নির্বাচন', অর্থাৎ বিধানসভা, লোকসভা ভোট একসঙ্গে করার কথা বলেছিলেন। বোঝাই যাচ্ছিল, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে যে কমিটি এই বিষয়টা দেখার জন্য গঠন করা হয়েছিল, তা একটি নামমাত্র কমিটি। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল প্রধানমন্ত্রী এবং আরএসএসের ভাবনায় সিলমোহর দেওয়া। আট সদস্যের ওই কমিটির রিপোর্ট দেখে মনে হয়, তাঁরা যেন উপায় খুঁজছিলেন কীভাবে এই রিপোর্ট পেশ করে সরকারকে তুষ্ট করা যায়। ওই ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যে ধ্বংস হতে পারে, সে কথা বারবার বলা সত্ত্বেও কেন সেই কমিটিতে একজনও আঞ্চলিক দলের প্রতিনিধি রাখা হল না?
ভারতীয় রাজনীতি নিয়ে নাড়াচাড়া করলেই দেখা যাবে, ১৯৫১ সাল থেকে ১৯৬৭ কিন্তু ভারতে নির্বাচন হত একসঙ্গেই। ১৯৫৭ সালে দেখা যায়, বেশ কিছু সরকার বাতিলের পরে সেই একসঙ্গে ভোট বিষয়টা কমে আসছে। ১৯৫৯ সালে কেরলের প্রথম নাম্বুদিরিপাদের সরকার ভেঙে দেওয়া হয় সংবিধানের ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে। তারপরে ১৯৬০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কেরলে আবার বিধানসভা নির্বাচন হয় এবং তারপর থেকে ক্রমশ বিধানসভা এবং লোকসভা নির্বাচন বিভিন্ন বছরে হয়ে আসছে। ১৯৭০ সালে এই নির্বাচন সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যায়। ১৯৯৯ সালে বাজপেয়ীর সরকারের সময় লালকৃষ্ণ আদবানি আবার এই প্রস্তাব সামনে আনেন। তাহলে এখন আবার নতুন করে এই আলোচনা সামনে আনা হচ্ছে কেন? ২০১৮ সাল থেকেই রাজনৈতিক মহলে এই আলোচনা ঘোরাফেরা করছিল কিন্তু রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ-সহ ৪টি বিধানসভায় বিজেপির ফলাফল খারাপ হতে পারে, এই আশঙ্কা করে তারা আবার এই “এক দেশ এক নির্বাচন” বিষয়টিতে জোর দিতে থাকেন। তাহলে কি নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর সরকার সামনের লোকসভা নির্বাচনে পরাজিত হতে পারেন বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ জোটের কাছে, এমন আশঙ্কা কোথাও থেকেই যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: ‘এক দেশ-এক ভোট’ নীতি: যুক্তরাষ্ট্র কাঠামো ধ্বংসের দিকে আরও এক ধাপ?
যে যুক্তিগুলোকে সামনে আনা হচ্ছে একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, কতটা ফাঁপা সেইসব যুক্তি। প্রথমে বলা হয়েছে, প্রতিটি রাজ্যে যদি প্রায় প্রতি বছর নির্বাচন হয় তাহলে যে নির্বাচনী বিধি লাগু হয় তার ফলে উন্নয়নের কাজ ব্যহত হয়। সুতরাং ৫ বছরে একবার যদি সমস্ত রাজ্য এবং কেন্দ্রস্তরে একবার নির্বাচন হয় তাহলে দেশের উন্নয়ন কে আটকায়? বলা হয়েছে, 'এক দেশ এক নির্বাচনে'র ফলে খরচ কমবে। গত লোকসভা নির্বাচনের দিকেইযদি তাকানো যায়, দেখা যাবে যারা এই নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি খরচ করেছে, উঁচু গলায় খরচের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলছে তারাই। সরকারি খরচ কম হলেও বহুক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলগুলি যে আকাশছোঁয়া খরচ ভোটের ময়দানে করে ফেলে, তা কার্যত প্রমাণ করে দেয় এই ভাবে খরচ কমানোর ভাবনা আসলে অর্থহীন। একদিকে খরচ কমানো আর অন্যদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর খরচ বেড়ে যাওয়া— এই দু'টোর মধ্যে কোনও সামঞ্জস্যই নেই। সুতরাং এই যে খরচ কমানোর যুক্তি সেটা একেবারেই খাটে না। যদি সংস্কার করতেই হয়, তাহলে সবার আগে রাজনৈতিক দলগুলির খরচে রাশ টানা প্রয়োজন,কিন্তু সেই সংস্কার করতে কি আদৌ রাজি কেন্দ্রের সরকার?
ভারত স্বাধীন হওয়ার সময় বা তার পরবর্তীতে সংবিধান গৃহীত হওয়ার প্রক্রিয়াতে সঙ্ঘ পরিবার যারা কিনা বিজেপির মূল রাজনৈতিক চালিকাশক্তি, তাঁরা কখনওই এই স্বাধীনতা এবং সংবিধানকে মেনে নিতে পারেনি। তারা মনে করে, এই সংবিধানের মধ্যে কোনও হিন্দুত্ব নেই। এই সংবিধান বিভিন্ন পশ্চিমি দেশ থেকে ধার
করা। গোলওয়ালকর যাকে এখনও সঙ্ঘ পরিবারের অন্যতম মাথা হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়, তিনি ১৯৪০ সালে নাগপুরে একটি ভাষণে বলেছিলেন, “আরএসএস এক পতাকা, এক আদর্শ, এক নেতৃত্ব, এক ধর্ম দেশের কোণায় কোণায় ছড়িয়ে দিতে চায়।” শুধু তা-ই নয়, তারা ভারতের জাতীয় পতাকাকেও মান্যতা দিতে রাজি নন। তাঁরা মনে করেন, যে ভারতের পতাকায় যে তিনটি রঙ আছে তা অশুভ এবং সত্যিকারের হিন্দুরা কখনওই এই পতাকাকে মন থেকে মেনে নেবেন না। একদিন পুরো ভারতবর্ষ তাঁদের গেরুয়া পতাকার কাছে মাথা নোয়াবে। ১৯৬১ সালে গোলওয়ালকর আরও বলেন যে ‘আজকের এই যে সরকারের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো তার মধ্যেই নিহিত আছে বিছিন্নতাবাদের সুত্র, এই যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কখনওই 'এক দেশ এক জাতি' এই ধারণাকে মান্যতা দেয় না, সুতরাং এই ধারণাকে সম্পূর্ণ ভাবে উপরে ফেলতে হবে, সংবিধানকে সংশোধন করতে হবে এবং এক দেশের ধারনা চালু করতে হবে’। বিভিন্ন বইতে গোলওয়ালকর এই সম্পর্কে লিখেও গিয়েছেন। সেই লেখাতেই পাওয়া যায়, তাঁর ইচ্ছে ছিল বিভিন্ন স্বাধীন এবং স্বশাসিত রাজ্যের পরিবর্তে তাঁরা একটি একীকৃত দেশ চান।
তার মানে ভারতের যে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো আছে তাকে সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলাটাই উদ্দেশ্য। 'এক দেশ এক নির্বাচন' হলে কেন্দ্র শক্তিশালী হবে আর অঙ্গরাজ্যগুলো ক্রমে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হবে। জিএসটির মধ্যে দিয়ে এই কাজটি শুরু হয়েছে। প্রথম যখন জিএসটি চালু হয়েছিল তখনও বিরোধীরা একই অভিযোগ তুলেছিলেন। প্রথমে যেটা বুঝে নেওয়া জরুরি, তা হল ভারতবর্ষ কি একটা পুরো দেশ নাকি সংবিধান অনুযায়ী এই দেশ কথাটার অন্য কোনও সংজ্ঞা আছে? যা ভারতের নাগরিকেরা জানলেও মেনে নিতে চান না বা বুঝতে চাইছেন না। আসলে অসাম থেকে গুজরাট কিংবা কেরল থেকে কাশ্মীরে যে বৈচিত্র আছে তাকে ধ্বংস করাটাই মূল উদ্দেশ্য। সারা দেশে যেভাবে এক ধর্ম এক আদর্শ চাপানোর চেষ্টা চলছে সবাইকে 'জয় শ্রী রাম' বলানো তারই অঙ্গ। আসলে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন সরকার মনে করে যে ভারত একটি অখণ্ড দেশ— যার খাওয়া, পরা, ধর্মাচারণ থেকে শুরু করে তাঁর নাগরিকত্ব কিংবা পরিচিতি সমস্ত কিছুর মধ্যেই একটা একীকরণের ছোঁয়া থাকবে। সেই জন্যই ইচ্ছের বিরুদ্ধে হলেও কাউকে নিরামিষ খেতে হবে বা 'জয় শ্রী রাম' স্লোগান বা আধারের মতো একটা পরিচিতি বহন করতে হবে। আসলে আমাদের কেন্দ্রীয় সরকার আমাদেরকে কোনওভাবে বোঝাতে চাইছে যে ভারতের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোটার আর কোনও
প্রয়োজনীয়তা নেই। কেন্দ্রে একটা শক্তিশালী সরকার থাকলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর যে মাধুর্য, একটা কেন্দ্রীভূত বলের সঙ্গে একটা অপকেন্দ্রিক বলের যে সুক্ষ্ম সমীকরণ আছে সেটাই আমাদের সংবিধান এবং আমাদের দেশকে গত ৭৫ বছর ধরে চলমান রেখেছে। এই সম্পর্ক কোনও ভাবে ধ্বংস হলে কোথাও একটা স্থিতিশীলতা চলে যায়।
সুতরাং যে যে যুক্তিগুলো আসছে সেগুলো নিয়ে নাগরিক পরিসরে আলোচনা চালানো জরুরি। শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্তরে আলোচনা করলেই এই সমস্যার সমাধান হবে না। ২০১৮ সালে আইন মন্ত্রকের তরফে বলা হয়েছিল, এই সাংবিধানিক কাঠামোতে ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ করানো সম্ভব নয়। তার জন্য সংবিধান সংশোধন শুধু নয়, ১৯৫১ সালের রিপ্রেসেন্টেশন অফ পিপলস অ্যাক্ট, লোকসভা এবং বিধানসভার কার্যপ্রণালী এবং আরও বেশ কিছু আইন বদল করতে হবে। কিন্তু প্রায়োগিক দিক বাদ দিলেও যে সমস্যার কথাটা মাথায় রাখা জরুরি তা হল, এই প্রস্তাব বাস্তবায়িত হলে বিভিন্ন রাজ্যের ছোট ছোট রাজনৈতিক দলের অস্তিত্বই সংকটে পড়ে যাবে। ধরা যাক, একটি অঙ্গরাজ্যের সরকার যে কোনও কারণে পাঁচ বছর টিকতে পারল না, সেক্ষেত্রে কি সেই রাজ্যে ফের নির্বাচন হবে? যদি সেটা এড়াতে হয়, তাহলে কি সেই রাজ্যে সে সময় রাজ্যপালের শাসন চলবে, অর্থাৎ ঘুরিয়ে রাষ্ট্রপতির শাসন চলবে? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া জরুরি।
আরও পড়ুন:খরচে কমানোই একমাত্র লক্ষ্য? ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ নীতির নেপথ্যে কোন পরিকল্পনা বিজেপির?
আরো একটি কথা আলোচনার জন্য রাখা যেতে পারে। কোনওদিন কি দেখা গেছে, আরএসএস বা বিজেপি তাঁদের নিজস্ব নেতা বাছার জন্য, কোনও আভ্যন্তরীণ নির্বাচন করেছে? এই তো কিছুদিন আগে, বিরোধী দল কংগ্রেস তাদের সভাপতি নির্বাচিত করেছে। কোনওদিন কি দেখা গিয়েছে, কেন্দ্রের এখনকার শাসকেরা তাঁদের নেতাকে নির্বাচিত করেছেন? উল্টে তাঁরা পছন্দমতো কাউকে দলের শীর্ষে বসিয়েছে। যে দলটির মধ্যে গণতন্ত্র শব্দটির অস্তিত্বই নেই, সেই দল যদি ‘এক দেশ এক নির্বাচন’ জাতীয় শব্দবন্ধ সামনে নিয়ে আসে, তখন খটকা লাগে না? আসলে এর মধ্যে দিয়ে, নরেন্দ্র মোদি তাঁর দলের মধ্যেই একটা একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে চাইছেন, যেখানে কোনও প্রশ্ন নেই, আছে শুধু আনুগত্য।
অনেকে বলে থাকেন, কেন্দ্রে একটা শক্তিশালী সরকার থাকুক, তা দেশের মানুষ চায়। যদি খেয়াল করা যায়, এই চিন্তাটিও আরোপিত। কার্যত কেন্দ্রে যখনই দুর্বল বা অস্থিতিশীল সরকার থেকেছে, আঞ্চলিক দলগুলো সাধারণ মানুষের দাবিদাওয়া কেন্দ্রের সরকারের থেকে বেশি আদায় করতে সক্ষম হয়েছে। তাহলে কি আমাদের 'এক দেশ', 'এক নেতা' 'এক আদর্শ', 'এক ধর্ম', 'এক স্লোগান'— এইগুলো নিয়েই বেঁচে থাকতে হবে? নাগরিক পরিসর থেকে এই বিষয়গুলো নিয়ে প্রতিবাদ উঠবে না? আরও একটা জরুরি কথা না বললেই নয়, বিরোধীরা যেভাবে ছন্নছাড়া হয়ে আছেন, তাতে কি তাঁরা আদৌ পারবেন এই লড়াইকে সামনে নিয়ে আসতে, নাকি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ দেখতে গিয়ে আমাদের স্বপ্নের ভারতবর্ষকে গেরুয়া পতাকার নীচে আত্মসমর্পণ করতে হবে, তা সময় বলবে। 'এক দেশ এক নির্বাচন' আসলে এক দেশ, এক নেতা, এক ধর্ম চালু করারই প্রাথমিক ধাপ ছাড়া আর কিছুই নয়।