ফাঁসি হলো না সঞ্জয় রায়ের! কেন আরজি কর ধর্ষণকাণ্ড বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা নয়?
Sanjay Roy Punishment: শেষবার বিচারক জানতে চান, "আপনি নির্দোষ ছাড়া কিছু বলতে চান?” জবাবে সঞ্জয় রায় আবারও বলেন, “যে কাজটা করিনি তাতে দোষী বলা হচ্ছে।"
হয় ফাঁসি নয় যাবজ্জীবন জেলের আঁধারে। এই দুই ছিল সম্ভাব্য পথ। আদালত আরজি করের তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দিল একমাত্র দোষী সাব্যস্ত হওয়া সঞ্জয় রায়কে। সোমবার শিয়ালদহ আদালতে আবারও সঞ্জয় বললেন, তিনি যা করেননি তার সাজা পাচ্ছেন। বিচারক বলেছেন, এই ঘটনা বিরলের মধ্যে বিরলতম নয়। তাই ফাঁসি হবে না এই অপরাধে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৬৪, ৬৬ এবং ১০৩ (১)— ধারায় দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়। সিবিআইয়ের আইনজীবী মৃত্যুদণ্ডের হয়ে সওয়াল করলেও আমৃত্যু কারাদণ্ডের নির্দেশ দেন বিচারক অনির্বাণ দাস। পাশাপাশি সঞ্জয় রায়কে ৫০ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। জরিমানার অর্থ দিতে না পারলে আরও পাঁচ মাসের কারাদণ্ড।
সোমবার আদালতে বিচারক অনির্বাণ দাস খুন ও ধর্ষণের দায়ে সাজার বিষয়ে আসামি সঞ্জয়ের বক্তব্য জানতে চান। তখনই সঞ্জয় আবারও বলেন, "আমি খুন বা অন্য কাজ কিছুই করিনি। আমি কোনওটাই করিনি। আমাকে ফাঁসানো হচ্ছে। আমি আগের দিনও বলেছি। যেটা আমি শুনেছি, এত (প্রমাণ) কিছু নষ্ট হয়েছে। আমি জানতাম না। আগের দিনই বলেছিলাম, আমার গলায় রুদ্রাক্ষের মালা ছিল। সেটা নষ্ট হয়নি। আমি নির্দোষ। আপনাকে আগেও বলেছি যে কীভাবে আমাকে মারধর করা হয়েছে, যার যা ইচ্ছে করেছে। অত্যাচার করা হয়েছে, সাইন করানো হয়েছে। যেখানে বলেছে সাইন করেছি। সিবিআই হেফাজতে নেওয়ার পর আমাকে মেডিক্যালের জন্য নিয়ে যায়। প্রথমে জোকার নিয়ে যাবে বলে কমান্ডের দিকে নিয়ে চলে যায়। তার পর এখানে, বিআর সিং (হাসপাতাল) নিয়ে চলে এল।"
আরও পড়ুন- ধনঞ্জয়কে ফাঁসি দিয়ে ভেঙে পড়েছিলেন নাটা মল্লিক! কেমন হয় জল্লাদের জীবন?
সঞ্জয় যা বলছেন, তার সত্যতা প্রমাণ করবেন কীভাবে? সঞ্জয় দীর্ঘ জবানবন্দি দিয়েছেন। দীর্ঘ জেরায় যা সাক্ষ্য মিলেছে, যা তথ্য প্রমাণ উদ্ধার করা গেছে, তার ভিত্তিতেই সিবিআই সঞ্জয়ের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়। বিচারক অনির্বাণ এদিন আদালতে বলেছেন, "আপনার থেকে ভালো কেউ জানে না সেদিন কী হয়েছে। আমি কেবল বিচার করতে পারি। ৩ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আপনার শাস্তির বিষয়ে কিছু বলার থাকলে বলুন। আপনার বাড়ির বাড়ির লোক কি আপনার সঙ্গে মামলা চলাকালীন যোগাযোগ করেন?" উত্তরে সঞ্জয় বলেছিলেন, কেউই যোগাযোগ করেনি। শেষবার বিচারক জানতে চান, "আপনি নির্দোষ ছাড়া কিছু বলতে চান?” জবাবে সঞ্জয় রায় আবারও বলেন, “যে কাজটা করিনি তাতে দোষী বলা হচ্ছে।"
সিবিআইয়ের আইনজীবী বারেবারেই এই ঘটনাকে বিরলের মধ্যে বিরলতম ঘটনা বলে এসেছেন। তাঁর যুক্তি হচ্ছে, নির্যাতিতা চিকিৎসক তখন কর্তব্যরত ছিলেন। মানুষের প্রাণ বাঁচানোর মতো কাজ তিনি করেন। ফলে শুধু সন্তানের মৃত্যু দেখেনি নির্যাতিতার পরিবার, সম্ভাবনাময়ী একজন চিকিৎসককেও হারিয়েছে সমাজ। তাঁর কথায়, এই ঘটনা সমস্ত কন্যাসন্তানের মা-বাবাকেই উদ্বিগ্ন করেছে। অন্যদিকে সঞ্জয় রায়ের আইনজীবী বলেছেন, প্রথমেই মৃত্যুদণ্ড নয়, সংশোধনের সুযোগ দিতে হবে। যেখানে সংশোধনের সুযোগ নেই সেক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। কিন্তু বিচারক বলছেন এই ঘটনা বিরলের মধ্যে বিরলতম নয়। কেন?
আরও পড়ুন- ধনঞ্জয়-সঞ্জয় একই মুদ্রার দুই পিঠ? ৩৪ বছর আগের ঘটনা কেন এত প্রাসঙ্গিক?
দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ড ছিল বিরলের মধ্যে বিরলতম। ওই ঘটনার বীভৎসতা ছিল অভাবনীয়। এই মুহূর্তে বিশ্বের ১০৪টি দেশ সম্পূর্ণরূপে মৃত্যুদণ্ড রদ করেছে। আরও ২৯টি দেশ এটি বাতিল করেছে অর্থাৎ গত ১০ বছরে কোনও ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়নি। ভারতে মৃত্যুদণ্ড রদ হয়নি এখনও তবে বলা হয়েছে, কেবল 'বিরলের মধ্যে বিরলতম' ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড হতে পারে৷ এই 'বিরলের মধ্যে বিরলতম' বা 'রেয়ারেস্ট অফ রেয়ার' বিষয়টি প্রথম উঠে আসে বচ্চন বনাম পঞ্জাব রাজ্যের একটি মামলায়। বিরলের মধ্যে বিরলতম অপরাধ কাকে বলা হবে?
এই অপরাধের মানদণ্ড বিশ্লেষণ করা হয় বিভিন্ন বিষয় মাথায় রেখে।
১. হত্যাকাণ্ডের পদ্ধতি - যদি হত্যাটি অত্যন্ত নৃশংস, অমানবিক, বীভৎস বা নিন্দনীয় পদ্ধতিতে সংঘটিত হয় যাতে তীব্র এবং চরম ক্ষোভ জাগিয়ে তোলা যায়; উদাহরণস্বরূপ,
ক নির্যাতিতকে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারার অভিপ্রায়ে তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
খ. নির্যাততকে হত্যার জন্য অমানবিক উপায়ে নির্যাতন করা হয়।
গ. নির্যাতিত ব্যক্তির দেহ বিকৃত বা টুকরো টুকরো করা হয়।
২. হত্যার উদ্দেশ্য - যদি হত্যার নেপথ্যে হীন এবং নিষ্ঠুর কারণ থাকে; উদাহরণস্বরূপ,
ক একজন ভাড়াটে খুনি শুধুমাত্র টাকা লোভে হত্যা করলে।
খ. উত্তরাধিকারসূত্রে সম্পত্তি বা অন্য কোনও স্বার্থপরতা বা লাভের জন্য ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হলে।
৩. অপরাধের সামাজিকভাবে ঘৃণ্য প্রকৃতি - যখন অনগ্রসর শ্রেণির কোনও ব্যক্তিকে হত্যা করা হয়। পণের জন্য স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারাও এর মধ্যে রয়েছে।
৪. অপরাধের মাত্রা - যদি অপরাধের অনুপাত ব্যাপক হয়। একাধিক খুনের ক্ষেত্রে এই শাস্তি হতে পারে।
৫. হত্যার শিকার হওয়া মানুষের প্রকৃতি - একজন নিষ্পাপ শিশু, একজন অসহায় মহিলা বা বৃদ্ধ বা রোগীর হত্যা হলে।
এই ধরনের অপরাধ ঘটলে বিচারব্যবস্থা বারেবারে প্রশ্ন করে যে, এই অপরাধে এমন কী আছে যা খুব অস্বাভাবিক? এই অপরাধে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দিলে তা কেন অপর্যাপ্ত হবে? মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা ছাড়া আর কোনও বিকল্প না থাকলে, তবেই সেই পথে যান বিচারকরা। আরজি করের ঘটনা ভয়াবহ ঠিকই, তবে তা এই মাপকাঠিতে বিরলতম হচ্ছে না। যে কারণে আজীবন কারাদণ্ড পেলেন সঞ্জয় রায়।