পুরনো বই সমানভাবে ছেপে যাওয়াই মূল মন্ত্র
Kolkata Bookfair 2025: এই সময়ে মানুষের কাছে বিভিন্ন 'বিকল্প' রয়েছে। বই কেনই বা পড়বেন? প্রকাশকের দরকার পাঠকের কাছে খবরটা দেওয়া।
কলকাতা বইমেলা সমাগত। শেষ পর্যায়ে দিবারাত্র এক করে তোলপাড় চলছে ছাপাখানাগুলিতে। পত্রিকা দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল অবভাস। বইপ্রকাশনার জগতে এক অন্য মাত্রা জুড়েছে এই প্রকাশনা। মণীন্দ্র গুপ্ত, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের লেখার পাশাপাশিই তৈরি হচ্ছে নতুন লেখকগোষ্ঠীর নতুন পাঠকমহল। কেন অন্যধরনের বই অবভাসের মূল শক্তি, এবারের বইমেলায় কোন কোন নতুন বই প্রকাশ পাচ্ছে? ইনস্ক্রিপ্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় অবভাস প্রকাশনার পার্থ চক্রবর্তী।
মধুরিমা- অবভাসের শুরু কীভাবে?
পার্থ- অবভাসের যাত্রা শুরু পত্রিকা দিয়ে। সাল ১৯৯৯। প্রকাশনা শুরু ঠিক তার বছরখানেক পর থেকেই। ২০০২ সালে প্রথম অবভাস বই প্রকাশ করে। তপোব্রত ঘোষের বই 'গোরা আর বিনয়' আমাদের প্রথম বই। তখন পত্রিকা আর প্রকাশনা অবশ্য একইসঙ্গে চলেছে। কয়েকছর পর পত্রিকা বন্ধ হয়ে যায়। অবভাসের পত্রিকা কিন্তু নিছক গল্প-কবিতার পত্রিকা নয়। গল্প-কবিতা থাকতই না। যে ধরনের বই আমরা প্রকাশ করি, সেই ধরনেরই পত্রিকা ছিল।
মধুরিমা- লিটল ম্যাগাজিন থেকে প্রকাশনায়, তাও এমন অন্যতর লেখালিখির। সিরিয়াস কাজের পাঠক কি হ্রাসমান নয়?
পার্থ- আমাদের পরিকল্পনা ছিল, যে ধরনের পত্রিকা আমরা করি, যে ধরনের লেখালিখির চর্চা করি, তেমনই প্রবন্ধের বা বিশেষ ধরনের লেখার বই-ই করব। এই ধরনের কাজের পাঠকগোষ্ঠী কিন্তু আছে। আমরা রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের বই প্রকাশ করেছি। রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যকে তো দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি বলা যায়। তাঁর দর্শনের বইগুলি অবভাস প্রকাশ করেছে। মার্ক্সীয় নন্দনতত্ত্ব দুই খণ্ড, জিজ্ঞাসা গ্রন্থমালা। তবে, এই ধরনের বই অবভাস কেন নির্বাচন করল, সেই প্রশ্ন উঠতেই পারে।
আমরা বিশ্বাস করি, বাংলায় দীক্ষিত পাঠকের অভাব নেই। আমরা ঠিকমতো 'সিরিয়াস পাঠকের' উপযুক্ত বই অনেকসময় দিতে পারি না। দিতে পারলেই পাঠক আছে। আমাদের সব বই পুনর্মুদ্রিত হয়। অর্থাৎ সমস্ত বই ছাপা হয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়, পড়ে থাকে না। অনেক প্রকাশনাতে তাই হয়। অনেক বই-ই আর ছাপা হয় না কারণ তা আর বিক্রি হবে না। বাজার আর নেই। আমাদের তা হয় না। আমরা যখন পত্রিকা করতাম তখনই দেখেছি যে, এই বিশেষ কাজগুলির বিশেষ পাঠকমহল আছে। তাই আমরা এই কাজগুলিই নির্বাচিত করি। আমাদের প্রকাশনায় গল্প বা কবিতা তাই নেই বললেই চলে। মণীন্দ্র গুপ্তর সমস্ত গদ্য যেহেতু আমাদের কাছে আছে, তাই মণীন্দ্র গুপ্তর উপন্যাস সমগ্রও আমাদের কাছে আছে।
আরও পড়ুন- লেখক কম, প্রকাশকে গিজগিজ করছে বাংলার বইবাজার : সুমন চট্টোপাধ্যায়
মধুরিমা- অনেক লিটল ম্যাগাজিনই নিজস্ব একটা লেখকগোষ্ঠী তৈরি করতে পারে। অবভাসের শুরুটাও সেভাবেই খানিক। প্রকাশনাতে এসেও অবভাস নিজস্ব লেখকমণ্ডলী গড়তে পেরেছে। অজয় গুপ্ত, পরিমল ভট্টাচার্যের মতো ভিন্ন ঘরানার লেখকের বই আপনারা প্রকাশ করছেন, কেন এই নির্বাচন?
পার্থ- আমাদের লেখক পরিমল ভট্টাচার্য যে ধরনের লেখালিখি করেন তা মূলত ফিকশন এবং নন-ফিকশনের মিশেল- দার্জিলিং, শাংগ্রিলার খোঁজে, সত্যি রূপকথা! সাম্প্রতিক প্রকাশ হয়েছে তাঁর একদম অন্যরকমের একটি বই। ঐতিহাসিক পটভূমিকায় একটি উপন্যাস, সাতগাঁর হাওয়াতাঁতিরা। এই কিছুদিন আগে প্রকাশ হয়েছে, এরই মধ্যে যা সাড়া পাচ্ছি, তাতে আমরা অভিভূত। অজয় গুপ্তর বইও একেবারে ভিন্ন মাত্রার। তাঁর স্মৃতিকথা তো আছেই। এছাড়া গতবছর প্রকাশ হয়েছিল কৃষ্ণপ্রসন্নর খেরোর খাতা এবং মৃত্যুর জবানবন্দি। এটা মৃত্যু নিয়ে লেখা। অজয় গুপ্তর অভিজ্ঞতা তো বিশাল, ওঁর দেখা মৃত্যুগুলির গল্প আছে প্রথম অংশে। কৃষ্ণপ্রসন্নের খেরোর খাতা একটা অংশ, আর মৃত্যুর জবানবন্দি আরেকটি অংশ। তাতে আছে রূপকার্থে যমরাজের সঙ্গে মৃত্যুর কথোপকথন। আমাদের সভ্যতা, সমাজ, পরিবেশ সমস্তটা নিয়ে আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে, আমাদের ভবিষ্যৎ কী— এই নিয়েই পুরো বইটা। এই লেখার পাঠক তো আছেই। কিছু স্মৃতিকথামূলক বইও রয়েছে আমাদের। পুরনো স্মৃতিকথা যেমন সারদাসুন্দরী দেবী, শরৎকুমারী দেবী— এই বইগুলি অবভাস প্রকাশ করেছে।
মধুরিমা- এই সমস্ত লেখারই নির্দিষ্ট পাঠক রয়েছে তবে?
পার্থ- প্রত্যেক বইয়েরই কিন্তু সমান সমান পাঠক আছে। পাঠকের কাছে পৌঁছনোই আসল ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যতই সিরিয়াস বই করি না কেন, পাঠকের কাছে কীভাবে সেই বই নিয়ে পৌঁছব এই নিয়ে ভাবনা ভীষণ জরুরি। এই সময়ে মানুষের কাছে বিভিন্ন 'বিকল্প' রয়েছে। বই কেনই বা পড়বেন? প্রকাশকের দরকার পাঠকের কাছে খবরটা দেওয়া। এখন তো খবর দেওয়ার মাধ্যম বিভিন্ন। আমরা শুরুর দিকে বই প্রকাশ হলেই পোস্টকার্ড পাঠাতাম আর ফোনে এসএমএস করতাম 'বুক অ্যালার্ট' বলে। যতজন পাঠকের নম্বর আমাদের কাছে থাকত, তাঁদের সবাইকে এই মেসেজ পাঠাতাম, পোস্টকার্ড পাঠাতাম, কিছুজনকে মেল করা হতো। এখন তো মাধ্যম অনেক। সমাজমাধ্যম তো আছেই, ২০১৫ সাল থেকে আমাদের ওয়েবসাইটও আছে। সেখানে প্রচার হচ্ছে। সারা ভারতে বই পৌঁছে যাচ্ছে। প্রচারের কথা না ভাবলে সিরিয়াস বই করেও লাভ নেই।
আরও পড়ুন- পাঠকের সামনে ভালো বই তুলে ধরতে চায় প্রতিক্ষণ
মধুরিমা- এবারের কলকাতা বইমেলায় অবভাসের কোন কোন বই প্রকাশ পাচ্ছে?
পার্থ- এবারের বইমেলায় নতুন বই বেরচ্ছে চারটে। সারাবছর আমদের বিপুল পরিমাণ বই প্রকাশ হয় না। নির্বাচন করে কয়েকটা বই করি। এবার পরিমল ভট্টাচার্যের সাতগাঁর হাওয়াতাঁতিরা বইটা থাকছে। বিন্দু থেকে সিন্ধুতে: ৮টি সেরা গল্পের জন্মকথা বইটি প্রকাশ হচ্ছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৮টি গল্প কোথা থেকে এল? এর পরিকল্পনা, রূপায়ন অজয় গুপ্তের। আরেকটি হচ্ছে চিকিৎসা- বিজ্ঞান/কাণ্ডজ্ঞান। এই বইটি লিখেছেন চিকিৎসক বিষাণ বসু। খুবই অন্যধরনের কাজ এটি।
মধুরিমা- পাঠক তো সঠিক সিরিয়াস কাজ খুঁজেই নেন। নতুন কাজের পাশাপাশি পুরনোই বইগুলোরও কি সন্ধান করেন আজও পাঠক?
পার্থ- পুরনো বইয়ের সন্ধান তো আছেই। এখনও বিপুল বিক্রি হয় অক্ষয় মালবেরি। এর পাঠক নিয়মিত তৈরি হয়। শাংগ্রিলার খোঁজে, দার্জিলিং এই ধরনের বই কিছু নতুন পাঠক তৈরি করে। এই লেখকদের নিজস্ব পাঠকগোষ্ঠীও তৈরি হচ্ছে। পাঠক তৈরি হওয়ার নেপথ্যের মূল চাবিটি হলো লেখার জোর। তারপরেই হলো লেখাকে পাঠকের কাছে পৌঁছনো। পাঠক তারপরেই খুঁজে নেন পরিমল ভট্টাচার্যের আর কী বই আছে, মণীন্দ্র গুপ্ত আর কী লিখেছেন, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য আর কী কী ভাবছেন! যখন লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে অবভাস প্রকাশ হতো, তখনও আমাদের পত্রিকাকেন্দ্রিক লেখকদের একটা গোষ্ঠী তো তৈরি হয়েইছে। সেই লেখকদের পাঠকগোষ্ঠীও সমানভাবে গড়ে উঠেছে।
বছরে অল্প বই হোক, কিন্তু পুরনো বইও সমানভাবে ছেপে যাওয়া কিন্তু আমার কাছে কোনও প্রকাশনার গুরুত্বপূর্ণ একটা দিক। আমরা পেপারব্যাক বই তৈরি করি। এটাই আমাদের লক্ষ্য। আধুনিক যোগাযোগ ও প্রচারব্যবস্থাকে প্রকাশকদের ব্যবহার করতে হবে সিরিয়াস কাজ সঠিক পাঠকের কাছে পৌঁছনোর জন্য। তাহলেই, গুরুত্বপূর্ণ কাজ সঠিক কদর পাবে।