এ মনে চির-হেমন্তের বাস
Late Autumn, Seoson of Melancholy: ফাঁকা দেউলের দ্বারে হেমন্ত এসে দাঁড়ায়। ওর গায়ে জড়ানো থাকে ক্ষণিক উৎসব-বিরতির চাদর। চাদরের গায়ে বিষাদের নকশাকাটা।
হেমন্ত আপাতভাবে এক বিষাদময় ঋতু। হয়তো শুধু আমার কাছেই অথবা আমার মতো আরও অনেকের কাছেই...
প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে দূরপাল্লার ট্রেনটা যখন স্টেশন চত্বর ছেড়ে যায়, তখন যে বিষাদের জন্ম হয় তার রঙ আর গন্ধ অনেকটা হেমন্তের মতো। উষ্ণতা ছেড়ে যায়, হিম নামে বুকে। শুধু একলা হতে মন চায়। নিভে আসা লালচে বিকেলে ভাতঘুম ভেঙে আমি আর একাকীত্ব পাশাপাশি বসি। মুখর নীরবতা আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে। হৃদয় খুঁড়ে মনখারাপিয়া কথা খুঁজে বের করি। কেন এমনটা হয় তার সদুত্তর পাই না। বিকেলটা প্রাণপণে ধরে রাখব বলে আলোর সুতো মুঠোয় নিয়ে ছাদের আলসে ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। ওই দূরে ঘোষ পাড়ার দুর্গা মণ্ডপটা দেখা যায়। আমার মতোই একলা। ক'দিন আগেকার আনন্দ চিহ্নের লেশমাত্র নেই। হঠাৎ-ই হারিয়ে গেছে যেন।
শেষ বিকেলে বিধু ঘোষের নাতবউ ফাঁকা দেউলে একখানা প্রদীপ জ্বেলে দিয়ে যায়। তাতে অবশ্য ঝলমলে উৎসব মরসুমের রোশনাই ফিরে আসে না, খানিক আঁধার কাটে। মেঝেতে ছড়ানো রাংতা কুচোয় টুকরো টুকরো আলো খেলে যায়। বেদির পিছনে পড়ে থাকে ভাঙা চালচিত্তির, ‘কৈলাসী পটলেখা’র গায়ে জেগে থাকে ভাসানের জলছাপ। সেই একবিন্দু প্রদীপের আলোর দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থাকি। একটু উষ্ণতার আশায়। তখন ফাঁকা দেউলের দ্বারে হেমন্ত এসে দাঁড়ায়। ওর গায়ে জড়ানো থাকে ক্ষণিক উৎসব-বিরতির চাদর। চাদরের গায়ে বিষাদের নকশাকাটা। ওর সঙ্গে চোখাচোখি হলে মৃদু হাসি ছড়িয়ে হেমন্ত হাঁটতে থাকে। আমার মফসসলি পাড়ার অলিতেগলিতে ওর পায়ের শব্দ শোনা যায়। আমি মুঠো আলগা করি। আলোর সুতোয় ঢিল দিই। বিকেলটা দূর দেশে ভেসে যায়, হিম হিম মৃদু কুয়াশামাখা রাতের হাত ধরে নিঃশব্দ বিষাদ ডানা মেলে বসে। রোশনাই শেষে ছায়া ছায়া আঁধারের মতো…
আরও পড়ুন: হেমন্তে ছিল আলো তৈরির পাঠশালা! কালীপুজোর প্রদীপ যেভাবে তৈরি হত হাতে হাতে
গাছের ডালে আঁকা হয় পরিপূর্ণ রিক্ততার ছবি। রুক্ষ পথ ছেয়ে থাকে হলুদ পাতার দল। এমন কালে বুকের ভিতর শুধু শব্দেরা জাগে। উঁচু ছাদের টঙে ঝুলতে থাকা আকাশ প্রদীপের মতো। জন্ম-মৃত্যুর বিভেদ রেখা মুছে কোনও কোনও পূর্বপুরুষ পৃথিবীতে নেমে আসেন। তাঁদের ঘরে ফেরার টান ছড়িয়ে দেয় মন খারাপের গুঁড়ো। আঁচলের খুটে বাঁধা চাবির ছুনছুন শব্দ কানে আসে, কে যেন ঘোরন সিঁড়ি দিয়ে নেমে যায়। ছাদের ওই কোণ থেকে ভেসে আসে তামাক-গন্ধ। শিরদাঁড়া বেয়ে চোরা হিমস্রোত খেলে যায়। আকাশদীপের দিকে তাকিয়ে বলি, 'ফিরে যাও ফিরে যাও'। মনে পড়ে জীবনানন্দের কবিতায় যখন জন্মান্তর হয় তখনও তিনি আঁকড়ে ধরেন হেমন্তকে। তাঁর মতো করে এই ঋতুকে কে-ই বা চিনেছে?
মুঠোফোন বেজে ওঠে। দূর দেশের ডাকে বিষাদ ভাবনা ছেঁড়ে। যে ফেরার কথা দিয়েও ফিরতে পারেনি, সে প্রতি সন্ধ্যায় এসে ফেরার আকুতি জানিয়ে যায়।
- কী করিস? আজও বুঝি ছাদে? এই আঁধারে কী দেখিস?
- আমি মৃদু হেসে উঠি , বলি আঁধারেই সব থেকে ভালো দেখতে পাই। যা দেখতে চাই…
- আজও ডুবে আছিস বিষাদে?
- হেমন্ত যে, এমন দিনে আর কী-ই বা করি বল…
ওপারে সে হাসে, ‘হেমন্ত’ শব্দটা বার দু'য়েক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উচ্চারণ করে। জানিস, শহরে আর হেমন্ত আসে না, কতকাল দেখাই হয়নি। কাচ ঢাকা কেবিনে কর্পোরেট ঋতুর বাস, যেমন দেখায় তেমন দেখি। এখনো ভোরবেলায় ‘টহলদারে’রা বৈতালিক গাইতে আসে?
- আসে তো, রোজ ভোরবেলায়। আমি শুয়ে শুয়ে শুনি- “গোঁসাই নিয়ম করে সদাই গায়, জয় রাধে গোবিন্দ।” ভোরের বিছানা, একলা থাকার আক্ষেপ সে কেমন করে যেন টের পায়।
- ওপারে নীরবতা। ‘যখন ঝরিয়া-যাবো হেমন্তের ঝড়ে/ পথের পাতার মতো তুমিও তখন/ আমার বুকের পরে শুয়ে রবে?’
- জীবনানন্দকে তোর এমন করে মনে আছে? এতকাল পরেও। দূর দেশ তবে সব কিছু ছিনিয়ে নেয়নি?
- নাহ, নিতে দিইনি। শহরে হেমন্ত আসে কাব্যের হাত ধরে। কংক্রিটের জঙ্গলে জন্ম নেয় কনক আভা লাগা ধানক্ষেত। ‘কার্ত্তিকের নীল কুয়াশা’ নেমে আসে, ‘শ্যামাপোকা’ ওড়ে, ডেকে ওঠে ‘লক্ষ্মীপ্যাঁচা’।
- শুধু জীবনানন্দকেই তোর মনে পড়ে? রবি ঠাকুর, জসীমউদ্দীন, মুকুন্দরাম এঁদের ? কাব্যের ভিন্ন আবেগ, ভিন্ন আদল নিয়ে কিছু তর্ক হয়, কিছু সমঝোতা। ও রবি ঠাকুরের কবিতা পাঠ করে-
‘আজি হেমন্তের শান্তি ব্যাপ্ত চরাচরে/ জনশূন্য ক্ষেত্র মাঝে দীপ্ত দ্বিপ্রহরে/ শব্দহীন গতিহীন স্তব্ধতা উদার/ রয়েছে পড়িয়ে শ্রান্ত দিগন্ত প্রসার/ স্বর্ণশ্যাম ডানা মেলি।’
কবিতার হাত ধরে আমি বিষাদ ভেঙে উঠে বসি। ওর হাতের পরশ পাই। চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বলে - “ছুটি জমেছে, এবার ঠিক আসব। মন খারাপ করিস না। সব আনন্দের শেষেই বিষাদ আসে আর বিষাদ শেষে আনন্দ। এ এক নিরন্তর ধারা…” অলক্ষ্যে কে যেন বিদ্রুপের হাসি হেসে ওঠে।
ঘোষপাড়ার দূর্গা মন্ডপের প্রদীপটা বহুক্ষণ আগেই নিভেছে। সেখানে এখন নিকষ আঁধার। সেই আঁধার আমাকে হলুদ ধানক্ষেত দেখায়। হাওয়াতে মাথা দোলায় পাকা ধানশিষ, শেষ হয় দরিদ্র চাষির ‘মঙ্গার মাস’- অনটনের কাল। বাতাসে নবান্নের সুঘ্রাণ ভেসে আসে।
‘হেমন্তের ধান ওঠে ফলে
দুই পা ছড়ায়ে বোসো এইখানে পৃথিবীর কোলে।’
আরও পড়ুন: এ পৃথিবী একবার পায় তারে
ছাদ থেকে নেমে আসি। বিছানায় শুয়ে শুয়ে ‘পিপাসার গান’ গাই -
‘এ দেহ অলস মেয়ে
পুরুষের সোহাগে অবশ
চুমে লয় রৌদ্রের রস
হেমন্ত বৈকালে
উড় পাখপাখালির পালে
উঠানের পেতে থাকে কান, শোনে ঝরা শিশিরের ঘ্রাণ
অঘ্রাণের মাঝরাতে।’
যে দূর দেশে থাকে সে জানে না, প্রেমে-কামে-প্রেমহীনতায় জীবনানন্দ’ই আমার বিষাদ সঙ্গী। আমার মনে চির-হেমন্তের বাস।