তুবড়ি থেকে ফানুস, আতসবাজির সেই উন্মাদনা হারিয়েছে কালীপুজোর কলকাতা?
Kalipuja 2023: কোম্পানির আমল থেকেই বলতে গেলে দীপাবলীর উৎসবের সমারোহে যোগ হল আতসবাজি। তখন অবশ্য বাংলায় তেমন বাজি তৈরির চল ছিল না।
"ফুটফাট দুমদাম শুনে লাগে খটকা"- পরিবেশ দূষণের এমন ভ্রূকূটি তো আর বরাবর ছিল না। সে সময় কালীপুজোর রাত মানেই পটকা ফাটার শব্দ, ফুলঝুড়ির জ্বলন্ত তারা কিংবা রংমশালের রশনাই। তার দিন কয়েক আগে থেকেই শুরু হয়ে যেত প্রস্তুতি। বাজি কেনা, সেসব বাজি রোদ্দুরে শুকোতে দেওয়া, উল্টে পাল্টে দেওয়া, বিস্তর কাজ। কেউ কেউ আবার পছন্দ করতেন নিজে হাতে বাজি বানাতে। বাজির মশলা তৈরি, সেইসব খোলে ভরে দুর্ধর্ষ তুবড়ি বানানো, তার উত্তেজনাই আলাদা।
কালীপুজোর সঙ্গে আলোর সম্পর্ক চিরকালীন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতে আসার আগে পর্যন্ত মাটির প্রদীপ দিয়ে ঘর আলোকিত করা। সেই মাটির প্রদীপে কখনও ব্যবহার করা হত কখনও সরষের তেল তো কখনও রেড়ির তেল, কখনও আবার ঘি। ক্রমে সেই মাটির প্রদীপের জায়গা নিল গ্যাসের বাতি। তখনকার অভিজাতপনার সবচেয়ে বড় প্রমাণ ছিল কে কত আলোয় বাড়ি সাজাতে পারে। আলোকসজ্জার সমারোহে কে কত টাকা ব্যয় করলেন, এ নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলত। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জলসাঘর গল্পে শুকতারার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা হালের বড়লোক গাঙ্গুলীবাবুদের বাড়ির সেই বহুশক্তিবিশিষ্ট বিজলি বাতিটিকে নিশ্চয়ই ভুলিনি আমরা।
আরও পড়ুন: দেবীর স্বপ্নাদেশ! গ্রামের বিলে সালঙ্কারা ভাসান যান ঋষিপুরের ডাকাতকালী
তবে ব্রিটিশ আমলের আগে এই মাটির প্রদীপ দিয়ে ঘর সাজিয়ে তোলা, ঘরকে আলোকিত করে তোলাই ছিল দীপাবলীর একমাত্র শর্ত। ক্রমে তার সঙ্গে এসে মিশল আতসবাজির দ্যুতি। প্রথমদিকে অবশ্য ভদ্রবাড়িতে তেমন বাজি পোড়ানোর প্রথা ছিল না। কলকাতার তেমন পয়সাওয়ালা বাবুরা বারবনিতাদের বাড়িতে গিয়ে শখ করে বাজি পোড়াতেন। পতিতাপল্লীর অন্য বাবুদের সঙ্গে রেষারেষি চলত তুবড়ি জ্বালিয়ে। যাঁর তুবড়িতে যত মশলা, যাঁর তুবড়ি যত আকাশছোঁয়া, তিনি ততই ধনীতম।
কোম্পানির আমল থেকেই বলতে গেলে দীপাবলীর উৎসবের সমারোহে যোগ হল আতসবাজি। তখন অবশ্য বাংলায় তেমন বাজি তৈরির চল ছিল না। বাজি আসত বাংলার বাইরের বিভিন্ন জায়গা থেকে। বাজি আমদানি সবচেয়ে বড় কেন্দ্র ছিল তখন লখনউ। পলাশি যুদ্ধ মানে ১৭৫৭ সালের পরবর্তী সময়ের কথা। মইনুদ্দি নামে এক বাজিওয়ালা কোম্পানিক কাছ থেকে বাজি তৈরির লাইসেন্স আদায় করেন। কালীচরণ সিংব নামেও এক প্রসিদ্ধ বাজিওয়ালার কথা শোনা যায় সে সময়। তখনকার বেশিরভাগ বাজিকারিগররাইাউ নাকি ছিলেন মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা। শুধু কি দীপাবলী, সেসময় কলকাতার দেশিবিদেশি বিভিন্ন ভোজসভা থেকে অনুষ্ঠানে, বিনোদনের জন্য আলোকসজ্জা ও বাজি পোড়ানোর রীতি ছিল।
পুরনো কলকাতার ইতিহাস খুঁটিয়ে ঘাটলে জানা যায়, মেনউইক নামে এক সাহেবের বাগানবাড়ি ছিল সে সময় গার্ডেনরিচে। তাঁর সেই বাগানবাড়িতে বসত বিরাট মেলা। আর সেই মেলার প্রধান আকর্ষনই ছিল হরেক রকম আতসবাজির কসরত ও প্রদর্শনী। পলাশির যুদ্ধের পর থেকে বাজি তো এল কলকাতায়। কিন্তু সে সময়ে তুবড়ির যত রমরমা ছিল, ততটা হাউই বাজির রমরমা ছিল না। কারণ সে সময়ে কলকাতার বেশিরভাগ বাড়িতেই ছিল খড়ের ছাউনি। হাউই বাজির দৌলতে যে কোনও সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে, তাই হাউই ছিল নিষিদ্ধ। শিমুলিয়ায় চড়কের মাঠে বিক্রি হত তুবড়ির খোল। কালীপুজোয় কয়েকদিন আগে থেকেই ওই মাঠে শুরু হত বাজি পোড়ানো। তার সঙ্গে ওড়ানো হত ফানুস। হরেক রঙের হরেক আকারের ফানুস। সে কারিগরদের হাতের গুণ ছিল এমনই যে রাতের আকাশে বিভিন্ন জীবজন্তুর চেহারা নিত ওই ফানুস। কখনও বা আলোর লেখনীতে আকাশের গায়ে লেখা হত নানা কথা। পরে অবশ্য সেই তালিকায় ঢুকে পড়ত হাউইও। রীতিমতো প্রতিযোগিতাও শুরু হয়।
আরও পড়ুন:বাড়তে চলছে চকলেট বোমার রমরমা, বঙ্গবাজারে এই কালীপুজোয় পাওয়া যাবে যে যে বাজি
সে ছিল এক উৎসব। অভিজাত পরিবারগুলির তরফে রীতিমতো অর্ডার দিয়ে তৈরি করা হত নানা ধরনের বাজি। মফস্সল থেকে ছুটে আসতেন মানুষ শুধু ওই বাজি পোড়ানো দেখতে। আসলে বাজি পোড়ানোর এই চল কিন্তু বাংলা রপ্ত করেছে উত্তর ভারত থেকে। উত্তর ভারতের দেওয়ালির উন্মাদনাকে মাত দেওয়া কঠিন এ রাজ্যের কালীপুজোর। ১৯৪০-র দশকে রমরমিয়ে উঠেছিল শিবকাশীর বাজির কারবার। সেই বাজির বাজার অবশ্য এখনও বিখ্যাত। বাংলায় বাজির এই যে ছোঁয়াচে চল, তার পিছনে কিন্তু বড় হাত ওই শিবকাশী বাজির বাজারের। দিনে দিনে বাড়তে থাকে বাজির অত্যাচার। কালীপটকা থেকে চকলেট বোম, শব্দবাজির অত্যাচারে ভিরমি খেতে শুরু করে কলকাতা। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে দূষণের প্রকোপ। ক্রমে বাজি পোড়ানোর উপর চড়তে থাকে নানা ধরনের নিয়মকানুন, নিষেধাজ্ঞা। বাজির থেকে মন কিছুটা হলেও উঠে যায় আমবাঙালির। আজও কালীপুজো জুড়ে বাজির দাপট রয়েছে। তবে সেই উন্মাদনা কিছুটা যেন কমেছে। বাচ্চারা যেন আতসবাজিতে আর তেমন মজা পায় না। অন্তত সুপ্রিম কোর্ট তো তেমনই বলছে। কিন্তু সত্যিই কি তাই! পরিবেশের খাতিরে হোক বা আকাশছোঁয়া দাম, সত্যিই কি আতসবাজির নস্টালজিয়া থেকে সরে আসছে বাংলা? উত্তরটা অবশ্য সন্ধ্যে থেকে বাইরে কান পাতলেই পেয়ে যাবেন।