মানুষের বাসস্থান মিশে যাচ্ছে সমুদ্রগর্ভে, কতটা বিপদ আছে সামনে?

ভারতের সমুদ্রতটবর্তী অঞ্চলে প্রায় দেড়শো মিলিয়ন লোকের বাস বর্তমানে। জনবিস্ফোরণের প্রভাবে আগামী বছরগুলিতে সেই সংখ্যা বাড়ার প্রবণতাই বেশি। স্বাভাবিকভাবেই সমুদ্রতীরবর্তী বাসিন্দাদের ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নের মুখে।

ন্যাশানাল সেন্টার ফর কোস্টাল রিসার্চ (National Centre for Coastal Research) বা এনসিসিআরের (NCCR) সাম্প্রতিকতম পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যাচ্ছে, ভারতের সমুদ্রতটবর্তী অঞ্চলের এক তৃতীয়াংশ ইতিমধ্যেই
ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে তলিয়ে গেছে সমুদ্রগর্ভে।

 

 

ভারতের মূল ভূখণ্ডের সমুদ্র-উপকূলের মোট দৈর্ঘ্য ৬,৯০৭ কিলোমিটার। এবং মূল ভূখণ্ডে মোট নয়টি রাজ্য রয়েছে, যাদের বেশ কিছুটা অংশ সমুদ্র-উপকূলবর্তী অংশের মধ্যে পড়ে।

 

 

উপকূলবর্তী অঞ্চল সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যাওয়ার পেছনে দায়ী করা হচ্ছে প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া এবং মানুষের ক্রিয়াকলাপকে।

 

আরও পড়ুন: চোখ রাঙাচ্ছে অশনি, ঘূর্ণিঝড়ে কোন সতর্কতা নিতেই হবে

 

 

কতটা ক্ষতি?

২০১৮ সালে এনসিসিআর "ন্যাশানাল অ্যাসেসমেন্ট অফ শোরলাইন চেঞ্জেস অ্যালং ইন্ডিয়ান কোস্ট" (National
Assessment of shoreline changes along Indian coast) নামের একটি রিপোর্টে ভারতের উপকূলবর্তী অঞ্চল পরিবর্তিত হওয়া বিষয়ক তথ্য প্রকাশিত হয় ।

 

 

রিমোট সেন্সিং এবং জিওগ্রাফিক ইনফর্মেশন সিস্টেমের (জিআইএস) মাধ্যমে ভারতের উপকূলজুড়ে পর্যবেক্ষণ শুরু করে এনসিসিআর। কাজ শুরু হয় ১৯৯০ সালেই। তখন জানা যায় ভারতের উপকূলের এক তৃতীয়াংশ ইতিমধ্যেই ক্ষয় পেয়েছে।

 

 

ভারতের পূর্ব উপকূলের মোট দৈর্ঘ্য ৫৩৪.৩৫ কিলোমিটার। পূর্ব
উপকূলবর্তী রাজ্যগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে
পশ্চিমবঙ্গ। ১৯৯০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গেই সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল ৬০.৫ শতাংশ সমুদ্রের নীচে তলিয়ে গেছে । অন্ধ্রপ্রদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী যে অংশে গোদাবরী
নদী বয়ে গেছে, তার অর্ধেক বর্তমানে সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে গেছে ।

 

 

অন্যদিকে পশ্চিম উপকূলের সামগ্রিক দৈর্ঘ্য ৫৯২.৯৬ কিলোমিটার। পশ্চিম উপকূলে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে কেরালা। ৪৬.৪ শতাংশ ক্ষয়ের শিকার হয়েছে এই রাজ্যের উপকূল।

 

এদিকে ভূ-বিজ্ঞান মন্ত্রকের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী জানা
যাচ্ছে ভারতের মূল ভূখণ্ডের উপকূল ভাগের ৩৪ শতাংশ বর্তমানে সমুদ্রের তলায় চলে যাচ্ছে ক্রমাগত । অন্যদিকে
২৪ শতাংশ উপকূল ভাগ কিন্তু ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছে। বাকি ৪০ শতাংশ অপরিবর্তিত আছে।

 

সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল ক্ষয়ের কারণ কী? এক্ষেত্রে মানুষ কতটা দায়ী?

সমুদ্র উপকূল ক্ষয়ের প্রাকৃতিক কারণ হিসেবে দায়ী করা যায় সমুদ্রস্রোতের ক্রমাগত আঘাত, বায়ুর ক্রিয়াকলাপ এবং আবহবিকারকে। এই প্রক্রিয়াগুলির প্রভাবে সমুদ্রতটবর্তী পাহাড় ও পাথুরে জমিও ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং সমুদ্রগর্ভে তলিয়ে যায়। পাশাপাশি সমুদ্র উপকূলের ক্ষয়ের প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করেছে মানুষের ক্রিয়াকলাপ, বিশ্ব উষ্ণায়ণ, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়।

 

তাছাড়া বিগত কয়েক বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ঝড়ঝঞ্ঝার প্রাবল্য বেড়েছে। ক্রমাগত বিধ্বংসী হয়েছে
তাদের রূপ। ভয়াবহ ঝড়ের প্রভাবে তৈরি হওয়া বিধ্বংসী জলোচ্ছ্বাস যখন দিনের পর দিন আছড়ে পড়েছে সমুদ্রতটে, ক্ষয়িত হয়েছে সমুদ্রতীরবর্তী ভূমি।

 

 

বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে মেরু প্রদেশে গলেছে হিমবাহ। ফলস্বরূপ উচ্চতা বেড়েছে সমুদ্রপৃষ্ঠের। এবং এটিও সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলের সমুদ্রগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার পিছনে অন্যতম একটি কারণ।

 

 

এর পাশাপাশি তীরবর্তী অঞ্চলে বাধাহীন বৃক্ষচ্ছেদন, নগরায়ন, শিল্পায়নের মতো ঘটনাও সামগ্রিক অবস্থার অবনতি ঘটিয়েছে। সমুদ্র দূষণের ফলে সমুদ্রতটবর্তী জমিতে লবণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বেড়েছে সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে ভূমিক্ষয়ের হার।

 

 

বায়ুদূষণের ফলে বাতাসে ক্রমাগত বেড়েছে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ, সঙ্গে বেড়েছে কার্বন মনোক্সাইড।
কার্বন মনোক্সাইড বৃষ্টির জলের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বনিক অ্যাসিডে পরিণত হয়। যা বৃষ্টির জলের সঙ্গে সমুদ্রে মিশে সমুদ্রের অম্লতা বাড়িয়ে তুলছে।

 

 

আর সেই অম্ল জল সমুদ্রতীরবর্তী পাথরের সঙ্গে রাসায়নিক বিক্রিয়া করছে, ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে হচ্ছে উপকূলবর্তী অঞ্চলের পাথুরে জমি।

 

ভবিষ্যৎ কী?

আরএমএসআই-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ভারতের উপকূলবর্তী অঞ্চলে অবস্থিত বহু দর্শনীয় স্থান এবং গুরুত্বপূর্ণ শহর ২০৫০ সালের মধ্যেই সমুদ্রে তলিয়ে যেতে পারে। এই তালিকায় রয়েছে মুম্বই, ম্যাঙ্গালোর, কোচি, তিরুবনন্তপুরম, চেন্নাই, বিশাখাপত্তনম প্রভৃতি।

 

বান্দ্রা-ওরলি সি লিঙ্ক, হাজি আলি দরগা, ওয়েস্টার্ন
এক্সপ্রেস হাইওয়ে, এমনকি মুম্বাইয়ের মেরিন ড্রাইভেরও প্রবল আশঙ্কা আছে ২০৫০ সালের মধ্যে সমুদ্রে তলিয়ে যাওয়ার।

 

ভারতের সমুদ্রতটবর্তী অঞ্চলে প্রায় দেড়শো মিলিয়ন লোকের বাস বর্তমানে। জনবিস্ফোরণের প্রভাবে আগামী বছরগুলিতে সেই সংখ্যা বাড়ার প্রবণতাই বেশি। স্বাভাবিকভাবেই সমুদ্রতীরবর্তী বাসিন্দাদের ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নের মুখে।

 

বিপদের মুখে তাদের আশ্রয় এবং খাদ্যের জোগান। সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকলে সমুদ্রকেন্দ্রিক
জীবিকানির্বাহীদের ভবিষ্যৎও সংকটে পড়বে।

 

 

উপকূলবর্তী অঞ্চলের ক্ষয় রুখতে সঠিক পদক্ষেপ কি নিয়েছি আমরা?

ভারত সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে উপকূলের ক্ষয় রুখতে।ন্যাশনাল সেন্টার ফর সাস্টেনেবল কোস্টাল ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের হাত ধরে উপকূলবর্তী অংশ দীর্ঘস্থায়ীভাবে সংরক্ষণে জোর দিয়েছে ভারত সরকার। অন্যদিকে ইন্টিগ্রেটেড কোস্টাল জো়ন ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান নামের আরও একটি প্রকল্প
শুরু করা হয়েছে এই উদ্দেশ্যে।

More Articles