নতুন অসুখ অনলাইন গেমে আসক্তি, নেশা কাটানোর উপায় কী?
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনও ভার্চুয়াল মিডিয়ামে আসক্তির ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্বাভাবিক কথাবার্তা কমে আসে, শিশু-কিশোরেরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
মাঠে গিয়ে ধুলো-কাদা মাখা হয় না আর এখন। ঘেমেনেয়ে বিকেলে খেলা-শেষে বাড়ি ফেরার চিরাচরিত দৃশ্যটা আজকাল যেন হারিয়ে যাচ্ছে। পাড়ায় পাড়ায় খেলার জায়গার অভাব, পড়ার চাপ, বাইরে গেলে খারাপ হওয়ার ভয়- কতই না অভিযোগ অভিভাবকদের! তার বদলে অভিভাবকরা বিনোদনের নামে যা তুলে দিচ্ছেন ছেলে-মেয়েদের হাতে, তার ক্ষতির পরিমাণ তাঁদের ধারণারও বাইরে। বিশেষ করে এই চিত্র দিন দিন ক্রমেই মারাত্মক হয়ে উঠছে। পশ্চিমের বিশ্বের মতো আমাদের অনেক পরিবারে বাবা-মা দু-জনেই কর্মব্যস্ত। উভয়েই ছুটছেন ‘কেরিয়ার ও সফলতা’ নামক সোনার হরিণের পিছনে। এদিকে সন্তান বড় হচ্ছে প্রায় একা একা। অনেক অপরিণামদর্শী অভিভাবকই শিশুকে খাবার খাওয়াতে, তার কান্না থামাতে টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল ফোন ও ভিডিও গেমসের অভ্যাস করাচ্ছেন।
অন্যদিকে শহরের ইট, পাথর আর কংক্রিটের আড়ালে আটকা পড়ছে শিশুদের রঙিন শৈশব। গ্রামের শিশুরা খেলাধুলোর কিছুটা সুযোগ পেলেও শহরের শিশুদের সেই সুযোগ কম। বড়দের মতো শিশুদের মধ্যেও ভর করছে শহুরে যান্ত্রিকতা। ফলে তারা খেলাধুলার আনন্দ খুঁজে পাচ্ছে মাউসের বাটন টিপে, কম্পিউটারের পর্দায় গেমস খেলে, কিংবা মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে। অনেক সময় তাদের এই আকর্ষণ চলে যাচ্ছে আসক্তির পর্যায়ে। ধীরে ধীরে তারা নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে কম্পিউটার-মোবাইল-ট্যাব গেমসের ওপর। এজন্য প্রথমেই বলা যায়, ভিডিও গেমস প্রকৃত শৈশব-কৈশোর কেড়ে নিচ্ছে।
কী এই গেমিং ডিজঅর্ডার
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইদানিং কমবয়সি অর্থাৎ ১৪ থেকে ২৪ বছর বয়সিদের মধ্যে ইন্টারনেটে ডুবে থাকার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। যুক্তরাজ্যে এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১৩-১৭ বছর বয়সি শিশুদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি শিশু সপ্তাহে ৩০ ঘণ্টার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করে ভিডিও গেমস, কম্পিউটার, ই-রিডার্স, মোবাইল ফোন ও অন্যান্য স্ক্রিনভিত্তিক প্রযুক্তি ব্যবহারের পিছনে। উইকিপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, ভিডিও গেমসের আবিষ্কার হয় চারের দশকে যুক্তরাষ্ট্রে। তারপর সাত ও আটের দশকের মধ্যে এটি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছয়। সর্বপ্রথম বাণিজ্যিকভাবে নির্মিত আর্কেড টাইপের ভিডিও গেম-এর নাম ছিল কম্পিউটার স্পেস। এরপর অ্যাটারি কোম্পানি বাজারে আনে বিখ্যাত গেম পং। তারপর ধীরে ধীরে অ্যাটারি, কোলেকো, নিনটেনডো, সেগা ও সোনির মতো ব্যবসায়ী কোম্পানিগুলো নানা উদ্ভাবন ও প্রচার চালিয়ে কয়েক দশকের মধ্যে পৃথিবীর আনাচকানাচে মানুষের ঘরে পোঁছে দেয় পুঁজিবাদী সভ্যতার এই বিনোদন-পণ্য।
আরও পড়ুন: বেছে বেছে বাদ যিশু থেকে টিপু সুলতান, কর্ণাটকের বিকৃত সিলেবাস চেনাচ্ছে বিজেপির ‘জাত’
২০০০ সালে সোনি কোম্পানি দেখেছিল যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি চারটি বাড়ির একটিতে একটি করে সোনি প্লে স্টেশন আছে। ২০০৯ সালের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শতকরা ৬৮ ভাগ আমেরিকানের বাড়ির সব সদস্যই ভিডিও গেম খেলে। তারপর সময় বদলেছে। কম্পিউটার এবং ভিডিও গেমস ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠেছে বিশ্বের অন্যতম লাভজনক ও দ্রুত বর্ধনশীল শিল্প ইন্ড্রাস্ট্রি। বিশ্বজুড়ে আজ মহামারীর মতো ছড়িয়ে পড়েছে ভিডিও গেম এবং গেমার।
সাম্প্রতিক এক সমীক্ষা অনুযায়ী সারা পৃথিবীতে প্রায় ২২০ কোটি মানুষ নিয়মিত বা অনিয়মিতভাবে ভিডিও গেম খেলে থাকে। যাদের অধিকাংশই হচ্ছে অল্পবয়সি শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণী। এদের দৌলতে গ্লোবাল ভিডিও গেম বাজারের আর্থিক মূল্য দাঁড়িয়েছে ১০৮.৯০ মিলিয়ন ডলার! এর মধ্যে ‘মোবাইল গেমিং’-ই হচ্ছে সবচেয়ে বেশি আয় করা সেক্টর। স্মার্টফোন ও ট্যাবলেটে গেমিং প্রতি বছর ১৯ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী গেমসের প্রতি তীব্র নেশা যে পাবজি গেম থেকে শুরু হয়েছে তা নয়। ইতিপূর্বে ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যান, মনস্টার হান্টার ওয়ার্ল্ড, ডটা টু, ভাইস সিটি এবং হাঙ্গার গেম-সহ নাম না-জানা অসংখ্য গেমে মানুষের ভীষণ আসক্তি ছিল।
কল্পনার জগতে গিয়ে গেমের প্রিয় চরিত্রের নায়কের সাক্ষাৎলাভের জন্য ২৪ তলা ভবনের ছাদ থেকে কিশোরের লাফিয়ে আত্মহত্যা করা, অতিরিক্ত গেম খেলায় বাবার বকুনি খেয়ে অভিমানী তাইওয়ানি কিশোরের নিজেকে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া, একটানা ২৪ ঘণ্টার লাইভ ভিডিও গেম খেলতে খেলতে ২২ ঘণ্টার মাথায় যুবকের মৃত্যুবরণ, অনলাইন ভিডিও গেমের জন্য টাকা জোগাড় করতে ১৩ বছরের ভিয়েতনামি কিশোরের ৮১ বছরের বৃদ্ধাকে রাস্তায় শ্বাসরোধ করে হত্যা করে তাঁর মানিব্যাগ চুরি এবং লাশ মাটিতে পুঁতে ফেলা, চিনা দম্পতির কম্পিউটার গেমের অর্থের জন্য নিজেদের তিন সন্তানকে ৯ হাজার ডলারে বেচে দেওয়া- এরূপ হৃদয়বিদারক গেমাসক্তির ঘটনা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রচুর ঘটেছে। এর বাইরে গেমসের কারণে বিশ্বব্যাপী বিবাহবিচ্ছেদ, চাকরি হারানো, মারমুখী আচরণ, বাবা-মার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার, অল্পতেই ধৈর্যহারা হয়ে পড়া, ইন্টারনেট না থাকলে অথবা মোবাইল বা কম্পিউটারের চার্জ ফুরিয়ে গেলে অস্থির-আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ার ঘটনা তো অহরহই ঘটছে।
এসব দৃষ্টান্ত প্রমাণ করে দিয়েছে যে, নেশা মানেই শুধু মদ বা মাদক নয়। নেশা বা মাদকাসক্তি কেবল মদ-গাঁজা, আফিম-হেরোইন ও বিড়ি-সিগারেটের সেকেলে পরিসরে আবদ্ধ নেই। কালের পরিক্রমায় প্রযুক্তির কল্যাণে এবং পুঁজিবাদী সভ্যতার বদান্যতায় নেশার পতিত অঙ্গনেও লেগেছে ডিজিটালের ছোঁয়া! ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ও ধ্বংসাত্মক ভিডিও গেমসে বুঁদ হয়ে থাকার ফলে বিশ্বব্যাপী মানুষ এমন নেশায় আক্রান্ত হচ্ছে, যা থেকে নিস্তার পাওয়া কঠিন।
ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস-ঘটিত এই আসক্তিকে মনোবিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘ডিজিটাল মাদক’! সম্প্রতি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (World Health Organization) ভিডিও গেমসের প্রতি তীব্র আসক্তিকে বিশেষ এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই অসুখের নাম দেয়া হয়েছে ‘গেমিং ডিজঅর্ডার’ বা ‘গেমিং রোগ’। বিভিন্ন ধরনের রোগের সমীক্ষার তথ্যভান্ডার ইন্টারন্যাশনাল ক্ল্যাসিফিকেশন অব ডিজিজেস বা ‘আইসিডি’-র ১১তম সংস্করণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভিডিও গেমিংয়ের প্রতি আসক্তিকে বিশেষ মানসিক রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
বস্তুত এ হচ্ছে পুঁজিবাদী সভ্যতার বিনোদন। যা শুধু টাকার বিনিময়ে কথিত আনন্দ দিয়েই ছাড়ে না। উপরি পাওনাস্বরূপ কেড়ে নেয় সময়, সম্পদ, মেধা, সুস্থতা-সহ অনেক কিছু! এই ধরনের ছেলে-মেয়েরা বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ডিজিটাল এক কল্পজগতে বাস করতে শুরু করে। বদলে যায় তাদের মানসিক গঠন। তাদের চিন্তাভাবনার মধ্যেও যান্ত্রিকতার ছাপ দেখা যায়। কম্পিউটার আর ইন্টারনেটের মাঝেই তারা জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা ও সমস্যার সমাধান খুঁজে বেড়ায়। ফলে তাদের সঠিক মানসিক বিকাশ হয় না। নিজের অজান্তেই স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতায় আক্রান্ত হয় তারা।
অনুকরণপ্রিয় স্বভাবের কারণে ছোটরা যা-ই দেখে, তা-ই অনুকরণ করতে পছন্দ করে। দেখা যায়, গেমের সুপারম্যান চরিত্র দেখে সে ছাদ থেকে লাফ দেওয়ার চেষ্টা করে। কারও ওপর রাগ হলে হাতকেই বন্দুক বানিয়ে গুলি করা শুরু করে। সারাদিন বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক খেলা খেলতে খেলতে তাদের আচরণও ক্রমশ আক্রমণাত্মক ও মারমুখী হয়ে ওঠে। দিনের একটা বড় সময় এসব খেলায় কাটানোর ফলে তাদের কাছে ওই জগৎটাই বাস্তব বলে মনে হয়। সাম্প্রতিককালে ব্লু হোয়েল-সহ বিভিন্ন গেম খেলে বহু কম বয়সি শিশু-কিশোরের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে। ভিডিও গেমসে বিদ্যমান রক্তাক্ত হামলা, সহিংসতা, চুরি, যৌনতা ও প্রতারণা শিশুদের অন্যায় ও অপরাধে মারাত্মকভাবে উৎসাহিত করছে। ভিডিও গেমসের মধ্যে প্রতি মুহূর্তে রংবেরঙের দৃশ্যপট পরিবর্তন, সারাক্ষণ অবিশ্বাস্য গতিতে ছোটাছুটি, জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে থাকা- এসব শিশুদের মানসিকতায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। দেখা যাচ্ছে, কোনওকিছুতেই তাদের স্থিরতা থাকছে না। সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তারা তাড়াহুড়ো করছে। অযথা সন্দেহ-অবিশ্বাস তাদের মধ্যে জেঁকে বসছে। অল্পতেই তারা ধৈর্যহারা হয়ে পড়ছে। বাস্তব জীবনেও নিজের পরাজয়কে তারা মেনে নিতে পারছে না। আর এসব প্রবণতা শিশুদের ক্রমেই নেতিবাচক ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
আসক্তি থেকে প্রতিরোধের উপায়
যেহেতু গেমিং আসক্তি এখন খুবই নতুন মানসিক রোগ, তাই আপাতত এর কোনও কাট অ্যান্ড ড্রাই চিকিৎসার পরিকল্পনা নেই। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্য সব অ্যাডিকশনের মতোই এই রোগের প্রাথমিক চিকিৎসা শুরু করা যেতে পারে। তাঁদের মতে:
শিশুকে সময় দিন। মা-বাবা নিজেরাও যদি প্রযুক্তির প্রতি আসক্ত থাকেন, তবে সবার আগে নিজের আসক্তি দূর করুন। পরিবারের সবাই মিলে ক্যারম, লুডো, দাবা, মনোপলি ইত্যাদি খেলার চর্চা করুন। নিয়ম করে সবাই মিলে বেড়াতে যান। মাঠে খেলার প্রতি উৎসাহ দিন।
নিরাপত্তামূলক অনেক সফটওয়্যার আছে। সেগুলো ব্যবহার করুন, যাতে আপনার ইন্টারনেট থেকে কোনও নিষিদ্ধ ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা না যায়। এই বিষয়ে আপনার ইন্টারনেট সংযোগদাতা বা প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে পারেন।
গ্যাজেট আর ইন্টারনেট ব্যবহার করতে দিলে তার একটি সময়সীমা বেঁধে দিন। সন্তানের সঙ্গে চুক্তিতে আসুন, যাতে নিয়মগুলো পালন করে। সময় মেনে চলতে উৎসাহিত করুন।
ইন্টারনেট বা গেম আসক্তি কিন্তু মাদকাসক্তির মতোই একটি সমস্যা। প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিয়ে এই আসক্তি দূর করুন।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে কোনও ভার্চুয়াল মিডিয়ামে আসক্তির ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্বাভাবিক কথাবার্তা কমে আসে, শিশু-কিশোরেরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভিডিও গেমের প্রতি কম সময় ব্যয় করা সম্ভব হলে, সম্পূর্ণভাবে এই গেমিং থেকে সরে এলে তবেই ‘গেমিং ডিজঅর্ডার’ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।