বামপন্থী আন্দোলন ক‍রতে গিয়েই জেল খাটা, তবু বামেরা বলেছিল সিআইএ-র দালাল

তথাকথিত আমোদগেঁড়ে বাজার সংস্কৃতির সঙ্গে দিললাগি করতে পারেননি। বিরুদ্ধতায়, ঝগড়ায়, ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তামাম ভালো থাকার সোহাগি আকাঙ্ক্ষা।


তখনও জরুরি অবস্থা থেকে দেশ রেহাই পায়নি। রাজনৈতিক নয়া উত্তাপে ফুঁসছে সারা দেশ। পশ্চিমবঙ্গেও তখন আর্ত-সময়ের চাপা নিঃশ্বাস। এইরকম একটা বেকার-বখাটে সময় কাটানোর জন্য বঙ্গসংস্কৃতির মেলায় ঢুকে পড়ি পাঁচ-ছয়জন চ্যাংড়া ছোকড়া। সেখানে তখন কেষ্টবিষ্টুদের আধিপত্য। অনেকটা তাদের মাপতেই যেন সে মেলায় ঢোকা। এরা প্রতিষ্ঠানের লোক, এরা দক্ষিনের মদতদাতা, এরা মালিকের নোকর। আমাদের তখন বেপরোয়া বামপন্থী মনমর্জির আত্ম-উদ্বুদ্ধ অন্বেষণে দিল কাবার। ফলে যা দেখছি, তাই যে বাঁকা চোখের সমালোচনামূলক হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। মেলায় এদিক-সেদিক ঘুরছি, কোথাও সস্তার চা খুঁজছি। এমন সময় দেখি এক ভদ্রলোক একমুখ দাড়ি, ঝাঁকড়া ঘন চুল আর রোগা-পাতলা ছোটখাটো চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পিঠে মস্ত এক ব্যাগ। দেখে মনে হচ্ছিল, এই বোধহয় কোনও দূর প্রান্ত থেকে ঘুরে এলেন।

তো তাকে ঘিরে তৎকালীন বহু লেখক-শিল্পীর ভিড়। ওই যাদের পরবর্তীকালে না পড়লে পিছিয়ে পড়তে হবে। সেই বৃত্তের কাছাকাছি যেতে জানতে পারি, সেদিন মূল মঞ্চে ওই ভদ্রলোক গান গাইবেন তাঁর বন্ধুদের অনুরোধে। একদম পাত্তা দিইনি। কিন্তু ভদ্রলোকের বাজখাঁই কণ্ঠস্বরটি আকর্ষণ করেছিল। সে যাই হোক, শেষমেষ কোনও কারণে বা অকারণেই আমরা মঞ্চের কাছে যাই।

তখন উনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে। মাইক ঠিক করা চলছে। তারপর শুরু করলেন খানিক সংক্ষিপ্ত কথা বলে। সেকথা ছিল অনেকটা এইরকম (স্মৃতি থেকে),

আমি গ্রিসে ছিলাম। সেখানে রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে আমজনতা পথে নামলে প্রশাসন মিলিটারি নামিয়ে দেয়। তখন সেখানে যুদ্ধ ট্যাঙ্কের সামনে জনতা সমবেতভাবে গান শুরু করে দেয়। দেখা যায়, মানুষের দিকে তাক করা ট্যাঙ্কের নলগুলি উর্ধমুখী হয়ে যায়।

এরপর গান ধরেন, 'এরে ভিখারি সাজায়ে কী রঙ্গ তুমি করিলে, হাসিতে আকাশ ভরিলে...।'

আরও পড়ুন: ‘সত্যজিৎ রায়ের ক্যামেরাম্যান’ হয়ে রয়ে গেলেন, যে সুব্রত মিত্রকে চিনল না বাঙালি

সে এক দুর্ধর্ষ খালি গলার দরাজ পরিবেশন।

মনে রাখতে হবে, তখন 'এমারজেন্সি' চলছে।

প্রকৃতপক্ষে সেই কারণেই কিছুটা খোঁজখবর নিতে গিয়ে জানতে পারি, ইনি দীপক মজুমদার, একজন কবি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বন্ধু।

ব্যস! এইটুকুই। কিন্তু সত্যি বলতে, মনে ধরেছিল সেই কথা আর গান। এরপরে নানা বামপন্থী দাদা-বন্ধুদের কাছে জানতে চেয়েছি এই কবির সম্পর্কে। অনেকে অনেক কিছু বলেছে, যার সিংহভাগ তার বদনাম। অধিকাংশ বলেছে, ও তো সিআইএ-র দালাল। এই সিআইএ-র ভূত দেখার একটা রেওয়াজ ছিল বামপন্থীদের মধ্যে। আমার বাবা বলতেন, মাঝেমধ্যে মনে হয়, সিআইএ যেন আমাদের পাজামার দড়ি আর ধুতির কোঁচা নিয়ন্ত্রণ করছে। আসলে যে কোনওরকম আমেরিকান যোগাযোগ ছিল তখন নিন্দনীয়। তা সে পড়াশোনা, গবেষণা, চাকরিবাকরি- যাই হোক না কেন!

ক্রমে জানতে পারি, বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন করতে গিয়ে জেল-খাটা এই কবিই বাংলা কবিতার অন্যতম মাইলস্টোন 'কৃত্তিবাস' পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। পড়েছি তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত এই পত্রিকার ভাবনা। তাঁরই ভূমিকা ছিল বেশি। এসব সুনীলের লেখা থেকেই আবিস্কার করেছি। দীপক মজুমদার শঙ্খ ঘোষের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'দিনগুলি রাতগুলি' প্রকাশ করেন। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র দীপক বুদ্ধদেব বসু-কৃত তুলনামূলক সাহিত্যের প্রথম বছরেই যাদবপুরে ভর্তি হন। পরবর্তী জীবন প্রসঙ্গে এই কবি লেখেন,

১৯৬৫ সালে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য পড়ানো ছেড়ে ফুলব্রাইট বৃত্তি নিয়ে আমেরিকায় যাই এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ওখানেই ভিয়েৎনাম যুদ্ধ-বিরোধী ও বর্ণ-বিদ্বেষ-বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ি। তারই সূত্র ধরে সেনাপতিশাসিত গ্রীসে মুক্ত নাট্যপ্রচেষ্ঠায় কাটে পাঁচবছর। ইতিমধ্যে তিনবার স্থলপথে তুরস্ক, ইরান ও আফগানিস্তান হয়ে ১৯৭২-এ মাসখানেকের জন্য কলকাতা। প্রায় গন্ধে গন্ধেই একযুগ ধরে সাদা, কালো ও বাদামি প্রান্তিকতা সাঁতরে অবশেষে ১৯৭৫-এ ঘরের ছেলে ঘরে বেঘোরে, প্রবাদ-পীড়িত কলকাতায়।

পাঠক ওঁর ভাষামহিমার এই নমুনাটি নিশ্চয়ই লক্ষ করবেন।

এছাড়াও দীপক মজুমদার ছিলেন একজন অন্যতম নাট্য-বিশেষজ্ঞ। যিনি সংযোগশাস্ত্রের উৎসভূমি হিসেবে লোকজ্ঞানের সমসাময়িক তাৎপর্য অনুধাবনে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। কাজ করেছেন শম্ভু মিত্র, হাবিব তানভির, নাসিরুদ্দিন শাহ, জের্সি গ্রোটস্কি ও পিটার ব্রুকের মতো দিকপালদের সঙ্গে। কিন্তু লিখেছেন অত্যন্ত কম। তার সেই রক্ত-ছেটানো গদ্য ও কবিতা সামান্যই স্থান পেয়েছে ছাপা অক্ষরে। দেশে ফিরে কিছুদিন 'চিত্রবাণী' নামক একটি সংস্থায় কাজ করেছেন। এই শহরে তিনি আর কাজ খুঁজে পাননি। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। নানা সময় আশ্রিত থেকেছেন বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে, ভক্তদের আনুকুল্যে। কখনও লেখক বন্ধু সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি, কখনও চিত্রকর হিরণ মিত্রর বাড়ি, কখনও সংগীতজ্ঞ গৌতম চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ি, কখনও গৌরখ্যাপার বাড়ি, এমনকী, এই অধমের বড়িতেও তাকে বাধ্যতামূলক থাকতে হয়েছে কিছুদিন। মূলধারার বঙ্গসংস্কৃতি তাঁর দিকে ফিরেও তাকায়নি। সেটাই হয়তো হওয়ার কথা ছিল। কেননা, তিনি তথাকথিত আমোদগেঁড়ে বাজার সংস্কৃতির সঙ্গে দিললাগি করতে পারেননি। বিরুদ্ধতায়, ঝগড়ায়, ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিলেন তামাম ভালো থাকার সোহাগি আকাঙ্ক্ষা।

সাতের দশকের শেষভাগে (৭৮) নানা সূত্রে দীপক মজুমদারের সঙ্গে আমার পরিচয়। ক্রমে ঘনিষ্ঠতা। তার ব্যক্তিগত জীবনের ছন্দপতনের শব্দ খুব কাছ থেকে শুনেছি (পতনের কি শব্দ হয়!)। তা নিয়ে আপাতত লিখতে কোনও রুচি নেই আমার। বরং একজন ম্যারাথন টকার, একজন গ্লোবট্রটার, একজন নয়া-নৈরাজ্যবাদী, একজন কালচারাল অ্যাক্টিভিস্ট, একজন লোকজ্ঞানী, একজন সমর্পিত ভাষা অনুসন্ধানীকে নিয়ে কথা হোক। তাঁর সম্পর্কে চর্চা কেন জারি থাকবে না? দীপকদার শত্রু যেমন ছিল, তেমন ভক্তকুল নেহাত খাটো ছিল না। অথচ চর্চা হলো না। নবনীতা দেবসেনের লেখায় পড়েছি যে, "দীপক আমাদের মধ্যে সবচাইতে মেধাবী ছাত্র ছিল, দীপক অনেক বড় কবি।" আর শঙ্খ ঘোষ তাঁর 'ঘুমিয়ে পড়া এলবাম'-এ একটা লেখাই দীপকদাকে নিয়ে লিখেছেন। সে লেখায় আছে যে, তিনি আমেরিকায় গিয়ে শুনেছেন, ওখানকার লেখক-কবিরা দীপকদাকে দার্শনিক-গুরু বলে সম্বোধন করছে।

Deepak Majumder

ছবি সৌজন্য: লেখক

আমাদের হয়তো বারবার সেই গুটিকতক লেখাতেই ফিরে যেতে হবে। দীপকদা নেশা করতেন কি কর‌তেন না সেটা কোনও প্রসঙ্গ নয়, ওঁর দ্বারা আমরা অনুপ্রাণিত হয়েছি কি না তা কোনও বিষয় হতে পারে না। বরং তাঁর বারুদ-পোষা জীবনবৈচিত্রের অতল গভীরে যে 'সংগ্রাম-সাধনা'-র চিহ্ন আঁকা ছিল, তা খুঁজে দেখতে পারি।

এছাড়া আর কী করতে পারি?

More Articles