জঙ্গলমহল আগলে রাখত মালতী-সরস্বতীরা
স্মৃতি সবসময়ই ব্যক্তিজীবনের প্রলাপ নয়। তা কখনও কখনও ইতিহাসের প্রচ্ছায়ায় ও সমাজ-সংকীর্তনের ধারায় বিস্তৃতি পায়। পুরনোকে নতুন করে পাওয়ার এক গলিপথও বলা যায়। তেমনই কোনও বাঁকের মুখে ফেলে আসা দিন-রাত্রি, কাজ-কাম, বোঝাপড়া আর দেখাশোনার মধ্য দিয়ে খণ্ড জীবনের ছেঁড়া পাতা কিংবা নষ্ট ফ্রেমের কথা মনে পড়ে। যা শুধু ব্যক্তিগত স্মরণ নয়। তা একটা আস্ত সংগ্রাম-সাধনা আর সমাজ-বাস্তবতার মিলিত ক্ষেত্রফল। তার ডাকনাম আমরা স্মৃতি থেকে ইতিহাস, যা খুশি দিতে পারি। আসল উপজীব্য হলো, সেই কথা-ছবি-লেখা কোনও নির্দিষ্ট অবস্থার দিকনির্দেশন করতে পারছে কি না। সেটাই, সেটাই আদতে কথা।
হয়তো কিছুটা বেফিকির দার্শনিকতার মুদ্রাদোষে ভারী শব্দ আর জটিল বাক্যবিন্যাসে খানিকটা দুরূহ মনে হতে পারে। কিন্তু না, এভাবে ছাড়া শুরু করা যাচ্ছিল না বলেই এমত লেখা। আসলে, একটা গল্প বা ঘটনা প্রকাশ করতে গেলে একটা ভাবনার প্রেক্ষাপট চাই। আর তা লঘু হলে চলবে কেন? তাই এই গুরুত্বপূর্ণ লেখার শুরু হবে অনন্যসাধারণ এক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে। তিনি বিনয়কৃষ্ণ চৌধুরী। একজন গান্ধীবাদি স্বাধীনতাসংগ্রামী। যিনি পরবর্তীতে কমিউনিস্ট রাজনীতিতে দীক্ষিত হবেন, হবেন পশ্চিমবঙ্গের অন্যতম বিশিষ্ট মন্ত্রী।
পারিবারিক সূত্রেই বিনয়বাবুর সঙ্গে আলাপ-পরিচয় ছিল। ছোটবেলা থেকেই তার গল্প শুনেছি। সমাজবিজ্ঞাননির্ভর তার বৌদ্ধিক ভাবনাচিন্তার আমি ছিলাম ভক্ত, অনুরক্ত। মিডিয়ায় কাজ করার সুবাদে পরবর্তীকালেও তার সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত থাকে। প্রায়শই দেখাসাক্ষাৎ হত। তাঁর অসাধারণ রাজনৈতিক বিশ্লেষণের আমি ছিলাম গুণমুগ্ধ শ্রোতা। পশ্চিমবঙ্গের ভূমিসংস্কারের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা, পার্টি লাইনের বিরুদ্ধে না গিয়েও অকপট থাকা, আর অতি-সাধারণ জীবনযাপন আমাকে মুগ্ধ করেছিল। এরকম অসংখ্য গুণাগুণের অধিকারী এক ক্রান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন বিনয়কৃষ্ণ চৌধুরী, সেসব আর বিশদে লিখতে চাই না।
আরও পড়ুন: রোমের এক কমিউনিস্ট পানশালা আর এক অমঙ্গলময়তার গল্প
তা আমার সেসময় মনে হলো, একটা ছবি করব বিনয়বাবুর ওপর। ততদিনে তিনি 'বিনয়দা' হয়ে উঠেছেন আমার কাছে। অকুতোভয় আমি, প্রস্তাবটা একদিন পেড়েই ফেললাম। বিনয়দা শুনে বললেন, "তা কখনও হয় না কি? আমাদের পার্টিতে এসব হয় না।"
আমি খানিকটা ঢোক গিলে বলার চেষ্টা করলাম, বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের মৃত ও জীবিত নেতাদের নিয়ে যত ছবি হয়েছে... আমার কথায় বিন্দুমাত্র আমল না দিয়ে বললেন, "ওঁরা নেতা, পথিকৃৎ। আমরা কর্মী। পার্টির প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা আছে। যা করছি, তা দলেরই দেওয়া কাজ।"
আমি খানিকটা হতোদ্যম! ও প্রশ্নে আর যাওয়াই যাচ্ছে না। কিন্তু না, উনিই প্রশ্ন করলেন, অমুক দিন কী করছি?
বললাম, তেমন কিছু না। বিনয়দা বললেন, বাঁকুড়ার ঝিলিমিলিতে চলে এসো। আমি তোমাকে সিনেমার গল্প দেখাব।
আর বেশি কথা হয়নি। কিন্তু নির্ধারিত দিনে পৌঁছে গেছি ঝিলিমিলি। বিনয়দা আগেই পৌঁছেছেন। দেখি, একজনের দাওয়ায় বসে লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরে গ্রামের মেয়েদের সঙ্গে মিটিং করছেন। সামনে রয়েছে ধামায় ভরা মুড়ি এবং নারকেল। আমি পৌঁছতে সেখানেই বসতে বললেন। বললেন, "মিটিংটা সেরে নিয়ে তোমার সাথে কথা বলব। মিটিংটা শোনো, তোমার কাজে লাগবে।"
সেখানেই আমি শনাক্ত করি দু'জন নেত্রীকে। তাঁদের কথায় আসছি। এই মিটিংয়ে দেখলাম, সমস্ত মহিলা মন্ত্রীকে তুই বলছে আর একই সম্বোধনে মন্ত্রীও কথা বলে চলেছেন। তা সে মিটিং শেষ হলো। এবার বিনয়দা আমাকে সিনেমার গল্প দেখাতে চেয়ে শুরু করলেন তাঁর কথা।
সেই দীর্ঘ কথালাপের পুঙ্খানুপুঙ্খ আজ আর সবটা মনে পড়ে না। কিন্তু বিনয়দার গল্প আসলে ওই মিটিং থেকে উঠে আসা ওই মহিলাদের গল্প, লড়াইয়ের গল্প। আজ এরা অনেকটাই ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু এমন দিন ছিল না তখন। এখানকার আদিবাসীদের পেটের দায়ে অপেক্ষাকৃত ধনী জেলাগুলিতে নামাল খাটতে যেতে হত চাষের মরশুমে। সেখানে উদয়াস্ত খেটে পেত এক খালি (ছোট বাটি) চাল, সামান্য তেল আর এক টাকা পঁচিশ পয়সা নগদ। বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চাদের ঘরে রেখে দরজার সামনে কাঁটা দিয়ে যেত নামাল খাটতে। ফিরে এসে সবাইকে জীবিত দেখত না। কিন্তু যেত, ফি বছর যেত।
এই গ্রামের দুই লড়াকু মহিলার নেতৃত্বে দীর্ঘদিনের সংগ্রাম-সাধনায় তা বন্ধ হয়েছে।
মালতী আর সরস্বতী এখানেই থেমে থাকেননি।
তাঁরা মহিলাদের জঙ্গল রক্ষীবাহিনী তৈরি করেন। নিজেদের সংগঠনের উদ্যোগে বাবুই দড়ি ও শালপাতা থালাবাটি তৈরি করে শহর অবধি তা পৌঁছে দেন। সেসময় তাঁরা গ্রামীণ মহিলাদের জন্য নানা ধরনের মডেল প্রকল্প তৈরি করেছিলেন। যার ফলে মালতী আর সরস্বতী ব্রাজিলের রিও ডি জেনেরিও-তে ডাক পান। ডাক পান আমেরিকা ও ইউরোপের নানা দেশ থেকে, ওঁদের কর্মকীর্তির অভিজ্ঞতা শোনাতে। মোটামুটি এরকম একটা সাফল্যের কাহিনির প্রেক্ষাপটে এক কঠিন বাস্তবের টাঁড় মাটিতে বিনয়দা আমাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। বিনয়দা তাঁর গল্প উপস্থাপন করলেন সেইসব মহিলাদের উপস্থিতিতে, তাঁদেরই সঙ্গে গল্প করতে করতে। আমাকে গল্প দেখালেন।
একটা সময় বিনয়দা সরাসরি বললেন, "এদের ওপর ছবি করো। সর্বত্র দেখাও। তবেই তো এই পৃথিবীর নানা প্রান্তে থাকা প্রান্তিক মানুষ জানতে পারবে, বুঝতে পারবে, কাকে বলে লড়াই, কাকে বলে দিকনির্দেশ। সত্যি বলছি, বিনয়দার সেই তাৎপর্যপূর্ণ সীমিত বক্তব্যে মনে হলো, এখনই কিছু একটা করে ফেলতে হবে।"
না, সঙ্গে সঙ্গে পারিনি। কিন্তু দীর্ঘদিন ওঁদের সঙ্গ করে পরবর্তী সময় দু-দুটো ছবি করেছিলাম। একটি তথ্যচিত্র, আরেকটি কাহিনিনির্ভর।
দু'টি ছবিরই নাম ছিল 'দুই কন্যা'!