জলপাই ক্ষেতে ছিটকে উঠল কৃষকের রক্ত, আর কত বিলালের নিথর দেহ দেখে থামবে ইজরায়েল?

Israel-Gaza War: হঠাৎ করেই ইজরায়েলি এক বসতিস্থাপনকারীর বন্দুক থেকে গুলি এসে ফুঁড়ে দিয়ে চলে গেল বিলালের বুক। মুহূর্তে লুটিয়ে পড়লেন বিলাল তাঁর সাধের জলপাই ক্ষেতে।

যে কোনও সময় মাটিতে মিশে যেতে পারে দেশ। নেই হয়ে যেতে পারেন সমস্ত বাসিন্দা। গাজায় এ সকলই এখন সত্য। মাথার উপর চক্কর কাটছে ইজরায়েলের বোমারু বিমান। যে কোনও মুহূর্তে রকেট হামলা নেমে আসতে পারে, ছাই করে দিতে পারে জাগতিক যা কিছু। তবু তার চেয়েও বড় সত্য বাঁচার আশা। যা মানুষকে এই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের মধ্যেও ফসলের ক্ষেতে নিয়ে যায়।

প্যালেস্টাইনে এ সময়টা জলপাইয়ের সময়। পরিবারের সকলে মিলে এ সময়টা নেমে পড়েন চাষবাসের কাজে। শনিবার সকালে যেমন মাঠে গিয়েছিলেন ৪০ বছরের বিলাল মহম্মদ সেলাহ। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের দক্ষিণ নাবলুস থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে আল সাওইয়া গ্রামে বাসিন্দা বিলাল। উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন এক ফালি জমি। সেই জমিতেই প্রতি বছর অলিভ চাষ করেন বিলাল। স্ত্রী ও তাঁর চার সন্তানও গিয়েছিলেন তাঁর সঙ্গে। ছিলেন তাঁর ভাইবোন ও অন্য পরিবারের লোকেরাও।

কিন্তু বিপদ যে ধূর্ত বাঘের মতো অপেক্ষা করে রয়েছে ওই চাষের ক্ষেতে, তা বোধহয় ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেননি বিলাল ও তাঁর পরিবারের লোকজন। হঠাৎ করেই ইজরায়েলি এক বসতিস্থাপনকারীর বন্দুক থেকে গুলি এসে ফুঁড়ে দিয়ে চলে গেল বিলালের বুক। মুহূর্তে লুটিয়ে পড়লেন বিলাল তাঁর সাধের জলপাই ক্ষেতে। কাঁচা-পাকা সব জলপাইয়ের গায়ে ছিটে লাগল বিলালের রক্তের, যে ফসল বহু কষ্টে ফলিয়েছিলেন বিলাল তাঁর নিজের হাতে। রক্ত জল করেছিলেন রোদবৃষ্টি মাথায় করে।

আরও পড়ুন: জয়ী না হওয়া অবধি যুদ্ধ চলবে! ৮,৩০০ মৃত্যুর পর কোন পথে এগোবে ইজরায়েল?

বড় বড় যুদ্ধে এসব ছোট ছোট ক্ষয়ক্ষতি হতেই থাকে। যাকে বলে কোল্যাটারাল ড্য়ামেজ। আর সেই পারিপার্শ্বিক ক্ষতি হিসেবে ক্রমে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে গাজা শহরটা। হামাস জঙ্গিদের খতম করতে গিয়ে একের পর এক সাধারণ নিরপরাধ মানুষের শবদেহের মালা রচনা করে চলেছে ইজরায়েল সরকার। হাসপাতাল থেকে গির্জা, শরণার্থী শিবির, সেখানেও যখন-তখন নামছে ইজরায়েলি রকেট। মুহূর্তে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে একের পর জনপদ। বাস্তুভিটে, আত্নীয় স্বজন হারিয়ে মানুষ ছুটছেন এখানে-ওখানে। কখন নেমে আসবে মৃত্য়ুর পরোয়ানা, কেউ জানেন না গাজায়।

গত তিন সপ্তাহে আট হাজার সাধারণ নাগরিকের মৃত্য়ু হয়েছে গাজায়। তার মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি শিশু। আইনে বলে, অপরাধীর সাজা পেতে যতই দেরি হোক না কেন, একজনও নিরপরাধ যাতে সাজা না পায়। অথচ গাজায় হামাস জঙ্গিদের খতম করার নামে হাজারে হাজারে নিরপরাধ শিশু, কিশোর, নারী-পুরুষ, বৃদ্ধকে শেষ করে দিয়েছে নেতানিয়াহু সেনা। কখনও হাতে মেরে, তো কখনও ভাতে মেরে। যুদ্ধ ঘোষণার পরেই গাজায় খাদ্য, পানীয় জল সরবরাহ এবং বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়েছিল ইজরায়েল। এবার বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট পরিষেবা। যাতে বাইরের কেউ ঘুনাক্ষরেও জানতে না পারে, আদতে কী চলছে গাজায়।

কার্যত গণহত্যার সমস্ত ছকই কষে ফেলেছে ইজরায়েল। দিন কয়েক আগে ইজরায়েলি সেনা সতর্ক করেছে গাজার বাসিন্দাদের। তাদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। কারণ যে কোনও সময় ইজরায়েলের হানা রকেটে সম্পূর্ণ ভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে গোটা শহর। পড়ে থাকবে শুধু ধ্বংসস্তূপ আর ছাই। আরে সেই ছাইয়ের নিচে নিশ্চুপে ঘুমোবেন হাজার হাজার সাধারণ মানুষ। যাদের আসলে কোথাও পালানোর নেই। চারদিকে সব রাস্তা বন্ধ। অন্য দেশে যে শরণার্থী হয়ে সিঁধিয়ে যাবেন, সেই পথটুকুও নেই। খোলা আছে শুধু মৃতদেহ হয়ে যাওয়ার রাস্তাটুকুই।

 

তাঁর গোটা পরিবারের সামনে বিলালকে বুকে গুলি করা হল। না, তার হাতে অস্ত্র ছিল না। হামাস জঙ্গির পরিচয়ও তাঁর বা তাঁর পরিবারের কারওর ছিল না। চাষের মাঠে অলিভ ফলাতে এসেছিল সে কেবল। যে অলিভ যুদ্ধের কাজে লাগত না কোনওদিনই। তবু ইজরায়েলি সৈন্যর গুলি ফুঁড়ে দিল তাঁর বুক। বিলালের কাকা ইয়াসির শাহিন জানান, এই পৃথিবীর গরিব, পরিশ্রমীতম মানুষ ছিলেন বিলাল। গোটা জীবনটা বাঁচার জন্য লড়াই করতে হয়েছে তাঁকে। ছোটবেলায় বাবা-মাকে হারান। সেই থেকে চলছে জীবনের যুদ্ধ। আর সেই জীবনযুদ্ধের ময়দান থেকে তাঁকে কেড়ে নিয়ে গেল দু-দেশের যুদ্ধ, যে যুদ্ধে বিলালদের মতো সাধারণ মানুষের ভূমিকা শুধু মরে যাওয়াটুকুই।

শনিবার সকালে ইজরায়েলি সেনা বন্দুক বাগিয়ে হুঙ্কার দিয়েছিল, বিলালদের হাতে মাত্র তিন মিনিট সময় রয়েছে। এর মধ্যে জমি ছেড়ে চলে যাক বিলাল ও তাঁর পরিবার। এরই মধ্যে সেই ইজরায়েলি বসতিস্থাপনকারীর বন্দুকে ছুটল ঘোড়া, বিলালের বুক ফুঁড়ে দিল গুলি। অথচ ইজরায়েলি সেনা জানত, গুলি ছুটতে পারে। তারা কিছুই করল না।

বিলাল,  রামাল্লা শহরের অনেক পথচারীর কাছেই চেনা মুখ। ওই রাস্তাতেই বসে ফল বিক্রি করতেন বিলাল। ছোট ক্ষেতে বেশ কিছু ফল সে চাষ করতেন নিজের হাতে। তারপর ক্ষেত থেকে সেইসব সুমিষ্ট ফল ছেনে বেছে বিক্রি করে আসতেন সে রামাল্লা শহরের কেন্দ্রস্থলের এক বাজারে। কখনও পুদিনা তো কখনও ডুমুর, কখনও আবার ন্যাসপাতি। আর জলপাইয়ের মরসুমে নিজের চাষ করা জলপাই, হাসি মুখে তুলে দিতেন ক্রেতাদের হাতে। পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি বিলাল। সংসারের জোয়াল টানতে তার আগেই নেমে পড়তে হয় রুজিরোজগারের আশায়। পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে নানা পাতা, ভেষজ গাছ সংগ্রহ করে বেচত সে বাজারে গিয়ে। আর নিজের ক্ষেতের চাষ করা ফলমূল তো আছেই। সেই জলপাই ক্ষেতে যাওয়াই কাল হল তাঁর।

এমন বিলালদের নিথর দেহ আজ গাজার সমস্ত রাস্তা জুড়ে। আল সাওইয়ার মতো অসংখ্য এলাকাই ঘিরে রেখেছে অজস্র অবৈধ ইজরায়েলি বসতিস্থাপনকারী। তাদের হাতজোড়া অস্ত্রশস্ত্র। যা যে কোনও সময় এসে ফুঁড়ে দিচ্ছে অসংখ্য নিরপরাধ ফিলিস্তিনির বুক। ইজরায়েলি সেনা সব জানে। অথচ তাদের রোখার চেষ্টা করে না।

বাসিন্দারাও জানেন, বাড়ির বাইরে মৃত্যুফাঁদ। যে কোনও সময় যা কিছু হতে পারে। বাড়ির ভিতরেও যে খুব নিরাপদ তা নয়। রকেট হামলার ভয়ও কম নয়। কিন্তু এ সমস্ত ভয় নিয়ে তো জীবন থমকে থাকে না। তাই জলপাইয়ের মরসুমে জীবনধারনের আশায় ক্ষেতের দিকে ছোটেন গাজাবাসী। সেই সুযোগ নিয়ে তাঁদের উত্যক্ত করে অবৈধ ইজরায়েলি বসতিস্থাপনকারীরা। জলপাই ক্ষেত নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করে, তছনছ করে। আর তাদের মদত দেয় ইজরায়েবি সেনা। নিজভূমে এখন যেন পরবাসী গাজাবাসীরা নিজেই। তাই ফসলের ক্ষেতে যেতে হয় বাসিন্দাদের গোপনে। জলপাই পাড়তে মইয়ে উঠেছিলেন বিলাল। সে সময় হামলা। গুলিবিদ্ধ বিলালকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটেছিলেন পরিবারের লোকেরা। কিন্তু বাঁচানো যায়নি তাঁকে। বিলালকে হারিয়ে যেন সর্বহারা তাঁর পরিবার। কী করবেন, কোথায় যাবেন, তা বুঝতে পারছেন না।

আরও পড়ুন: এক ইশারায় উড়ে যাবে গোটা গাজা! বাসিন্দাদের পালানোর নির্দেশ দিচ্ছে ইজরায়েলি সেনা

শুধু বিলালের পরিবার নয়, গোটা গাজাবাসীর অবস্থাই একই রকম। ইজরায়েলের আগ্রাসনের মধ্যে পড়ে তাঁরা শুধুই মরে যাচ্ছেন। এত এত প্রাণ কেড়েও থামছে না ইজরায়েল। রাষ্ট্রপুঞ্জের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পড়ে আছে টেবিলেই। আর ক্রমশ নিভে যাচ্ছে গাজার একে একে সমস্ত দেউটি।

More Articles