ক্ষমতা আর যৌন শোষণের আখ্যান; মহাভারতকে নতুন করে জানতে কেন পড়তেই হবে 'পাঞ্চালী'
Panchali Book Review: পাশাখেলায় মত্ত যুধিষ্ঠিরকে বুঝতে গিয়ে, তার মগজটাকেই হাজির করা হয়েছে ছবিতে। আর সেই মগজ শিশ্নতে ক্রমপরিবর্তিত হয়েছে।
“IN THE LAND OF BHARATA MIXED-BREED HALF-CASTE PEOPLE CAN EASILY BE WRITTEN OFF.” (PANCHALI, EPISODE-1)
“এই বৃহৎকথা প্রথমে মহাদেবের মুখ হইতে বহির্গত হয়। ক্রমে পুষ্পদন্ত তাহা শ্রবণ করেন। পুষ্পদন্ত যখন অভিশাপবশে বররুচি হইয়া ভূতলে জন্মলাভ করেন, তখন তাঁহার নিকট হইতে গুণাঢ্য এবং গুণাঢ্যের নিকট হইতে রাজা সাতবাহন তাহা প্রাপ্ত হন। এইরূপে সেই বিস্তৃত কথা প্রসিদ্ধলাভ করিয়াছে।” (কথাসরিৎসাগর, নবম তরঙ্গ)
খুব সম্প্রতি, ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে মহাভারত বিষয়ক চিত্রালেখ্য বা গ্রাফিক নভেল পাঞ্চালী। কাহিনিতে শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় এবং ছবিতে শঙ্খ বন্দ্যোপাধ্যায়। পূর্বে এই দুই স্রষ্টার যুগ্ম সম্মিলনেই প্রস্তুত হয়েছিল এই সিরিজের প্রথম বই 'ব্যাস'। পাঞ্চালী নানা ভাবেই মহাভারতকে ঘিরে রাজনীতি, ইতিহাসচেতনা, সাহিত্যবোধ, দর্শনচিন্তার সঙ্গে বোঝাপড়ার মাধ্যমে শিল্পীর স্বাধীনতা এবং ভাষ্যের এক নতুন পাঠ প্রস্তুত করেছে। পাঞ্চালী নিশ্চিত ভাবেই লেখক এবং চিত্রকরের ভাবনা সমন্বয় ও একধরনের পারস্পরিক জ্ঞান-সখ্যের ফসল। তবে বোঝা দরকার কোথায় এবং কীভাবে দুই শিল্পী তাঁদের নির্মিত বৌদ্ধিক বন্ধুত্বের ফসলের মধ্যে নিজস্ব স্বকীয়তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখেছেন।
আজকের ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠা রাজনৈতিক পরিসরে ‘ইতিহাস’ কাকে বলব সেই নিয়ে জোরদার তর্ক বেধেছে। দক্ষিণপন্থায় বিশ্বাসী কেউ-কেউ দাবি করছেন মহাভারত ‘ইতিহাস’ আমাদের কাছে। শুধু ‘ইতিহাস’ নয়, আসলে তাই নাকি ‘History’, অগত্যা মহাভারত মোটেই কাহিনি বা আখ্যান নয়। এই প্রসঙ্গে ২০১৩ সালে প্রকাশিত রোমিলা থাপারের The Past Before Us: Historical Traditions of Early North India গ্রন্থের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। রোমিলার চিন্তা অনুসরণ করে বলা যায়, প্রাক-ঔপনিবেশিক ভারতের ‘ইতিহাস’ নামে একটি নিজস্ব সন্দর্ভ থাকলেও, মহাভারত ‘ইতিহাস’ হলেও, সেই ‘ইতিহাস’ চিন্তার সঙ্গে মিল নেই যারে একাংশের দক্ষিণপন্থী বলেন ‘ইতিহাস’।
আজকের পাঠকের জন্য শিবাজী যখন মহাভারতকে নতুন করে লিখতে বসেন তখন কথাকার হিসাবে তার মধ্যে একধরনের জরুরি ইতিহাসচিন্তা কাজ করে। যে চিন্তার মুখ্য কেন্দ্রে এসে দাঁড়ায় একটি সহজ এবং নিরীহ প্রশ্ন, যে প্রশ্নটি নানা তালেগোলে আমরা ভুলে যাই। সেটি হল, মহাভারতের গল্প কে শোনান আমাদের? এই গল্প শোনার ইতিহাসকে বাদ দিলে বোঝা সম্ভব নয় মহাভারতের সুবিশাল ঐতিহ্য। আর সেই গল্পকথক, সৌতি উগ্রস্রবা। সৌতিই গ্রন্থের শুরুতে আবির্ভূত হয় তার গল্পের ঝুলি নিয়ে। জনতার দরবারে সে শুধু মাত্র মহাভারতের কাহিনি শোনায় না, গল্প বলতে বলতে নিজেকেও জড়িয়ে নেয় নানা দ্বিধাদ্বন্দের সঙ্গে। মূল মহাভারতকে সামনে রেখেই সৌতিকে হাজির করা হয়েছে এখানে। কিন্তু বদলে গেছে উপস্থাপনের ঢং, বদলেছে জিজ্ঞাসার ধরন। যে জনতা সৌতির গল্প শোনে সেও নিজের মতো করে প্রশ্ন সাজায় মাথার মধ্যে। আজকের দিনে, ইতিহাসের এই চয়নের প্রশ্নটিই জরুরি। পাঠককে এটা বলা দরকার হয়ে পড়ে যে সৌতিকে বাদ দিয়ে, মহাভারত গড়ে উঠতে পারে না। সৌতি-কথিত মহাভারতের এই ইতিহাস বাঙালির চিন্তা ও আবেগ বিশ্বে গরহাজির। সৌতির এই নির্বাচন, আমাদের নিয়ে যায় শিবাজীর সেই ইতিহাসভুবনে, যার ভিন্নতর পরিচয় মেলে তাঁরই ‘ভারতে মহাভারতে’ (২০২২) গ্রন্থে। সাহিত্যের ইতিহাসবোধ কেমন করে নির্মাণ করতে পারি আমরা, সৌতির হাত ধরে সেই পাঠটুকু বাঁধা থাকে পাঞ্চালীর গোলকধাঁধার পথেবিপথে। সৌতির হাত ধরে শিবাজী আমাদের দেশিয় গল্প বলার ইতিহাস এবং রীতিকে সামনে নিয়ে আসেন। গল্পের ইতিহাস ছাড়া ভারতের ইতিহাস হতে পারে না। গল্পের সেই অনন্ত অতৃপ্তি, যা বেঁচে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
আরও পড়ুন- পড়াশোনা ছেড়ে আন্দোলনে! ভারতীয় ছবির ‘রস’ প্রথম বুঝিয়েছিলেন দেবকী বসুই
শিল্পী শঙ্খ বন্দ্যোপাধ্যায়ও এই অংশের চিত্র রচনা করতে গিয়ে এক বিকল্প আখ্যানজগতে নিয়ে যান আমাদের। সৌতি আর শ্রোতাদের মধ্যে নানা বর্ণ এবং জাতির মানুষ রয়েছে। এক নিষাদ মহিলা ও তাঁর পঞ্চপুত্রকে আগুনে পুড়ে মরতে হয়েছিল কুন্তী এবং পাণ্ডবদের বিকল্প হিসাবে। ওই সম্প্রদায়েরই আরেক প্রতিনিধির মনে নানা জিজ্ঞাসা ঘনিয়ে তোলে সৌতির নাটরঙ্গ। তবে শুধু জাত পাতের বৈচিত্র এবং রাজনীতি নয়, সৌতির লিঙ্গপরিচয়ের প্রশ্নটিও বিশেষভাবে খেয়াল করার মতো। একটা দেশ যখন ক্রমশ আরও বেশি উগ্র পুরুষ হওয়ার খেলায় মেতে ওঠে তখন এই পরিচিতির প্রশ্নটি আর নেহাত সাধারণ বিষয় থাকে না। যে সৌতি তার গলার স্বর, বৈচিত্র্যে ভরা উচ্চারণ আর নানা অঙ্গভঙ্গিমায় বাঁচিয়ে রাখে মহাভারতের গল্প বলার পরম্পরাকে, সেই সৌতি দেখতে ঠিক পুরুষ-পুরুষ নয়। রঙ আর রেখার স্পর্শে শঙ্খ এমন এক সৌতিকে হাজির করেন পাঠকের সামনে যে পৌরুষের হুঙ্কার ছেড়ে কমনীয়তার সৌন্দর্য্যকে উদ্যাপন করে। সৌতির এই নির্মাণই বুঝিয়ে দেয় শিল্পীর যৌন-সচেতনতার প্রতর্কটিকে। কেবল তাই নয়, পাঞ্চালীর ছবিগুলো ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, শঙ্খর চিত্রদর্শনে যৌনতা একটি বড় স্থান জুড়ে ঘাঁটি গেড়ে আছে। সিরিজের প্রথম বই ব্যাস থেকেই শঙ্খ যেমন ভাবে ইতিহাসের যুক্তিপরম্পরা মেনে মহাভারতের যৌনতার জগতটিকে তুলে ধরেন তা আক্ষরিক অর্থেই বিরল। যদি ধারাবাহিকভাবে কেউ এই শিল্পীর যৌনতা বিষয়ক ছবিগুলিকে পর্যবেক্ষণ করেন, তাহলে তিনি খুব সহজেই মহাভারতের কামশৃঙ্গারের রসদেশে প্রবেশ করতে পারবেন।
এ কথাটি ভুলে গেলে চলবে না যে মহাভারতের গল্পের বৃত্তটি আমাদের রোজাকার চেনা জানা হাসি কান্নায় ভরা জীবনের চেয়ে অনেকখানি আলাদা। এর কাহিনি শুনতে গিয়ে পাঠকের চোখের সামনে এক স্বপ্নরাজ্যের দুনিয়া খুলে যায়। নানা রসের সমাহারে লিখিত এই আখ্যান পড়তে গিয়ে, বুঝতে গিয়ে, সম্ভব-অসম্ভবের সীমারেখা মুছে আসে ধীরে ধীরে। যুদ্ধের বিপুল সজ্জায়, প্রেমের বাঁধভাঙা প্রতিজ্ঞায় আর প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে ওঠা মন এক অসীম ব্যপ্তিকে ছুঁতে চায়। এই কাহিনি তাই যেমন এক সাধারণ চাষিকে, ক্ষেতখামারের শ্রমিককে আকর্ষিত করে, তেমনই টান দেয় দার্শনিকপ্রবরদের। বস্তুত, শিবাজী-শঙ্খ জুটি যে পাঞ্চালী প্রস্তুত করেছেন তার ছবি ও কাহিনি যুগপৎ মহাকাব্যিক। রেখা ও লেখার এই দুনিয়ায় যেকোনও সাধারণ পাঠক চাইলে প্রবেশ করতে পারেন। গ্রন্থ পড়াদেখার সুখের জন্য চাই না পণ্ডিতি বিদ্যাবুদ্ধি। সরল মনে, খোলা চোখে, এক স্বপ্নরাজ্যে প্রবেশ কর
প্রবেশ করতে পারবেন পাঠকদর্শক। কিন্তু কেউ যদি খুঁজতে চান মহাভারতের সেই বিপুল জটিলতার শেকড়গুলিকে, তার জন্যও উপহারের ডালি সাজিয়ে রেখেছে এই বই। নারীর সুখ ও অ-সুখ, পুরুষের আধিপত্যে শিশ্ন সম্পর্ক, প্রকৃতি তথা জঙ্গলের সঙ্গে মানুষের অবস্থান, শুধু জঙ্গল নয়, সেই জঙ্গলের বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্তি এবং বিবিক্তি, গণিতের বোঝাপড়া, যৌনতার থাকভাঙা রীতি, নগরের বৈচিত্র এমন হাজারো প্রতর্ক জমাট বেঁধে আছে পাঞ্চালীর পাতায় পাতায়। লেখা এবং ছবির মধ্যে এক দ্বৈতজগতের পরত জমে আছে। সন্ধানী চোখ ইচ্ছানুসারে যাতায়াত করতে পারে চিত্রালেখ্যের অন্দরে।
অরণ্যকে তার সমস্ত বৈভব, ভয় আর প্রেমের ছন্দহীন বৈপরীত্যে বেঁধেছে এই বই। যে জঙ্গলে পঞ্চপাণ্ডব আর কুন্তী লুকিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন কৌরবদের চক্রান্তের হাত থেকে বাঁচতে, সেই নিবিড় বনানীর সঙ্গে কেমন লতায়পাতায় জড়িয়ে পড়েন তারা। মহারণ্যও নানা ঘটনা আর পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে রঙে, রেখায়, লেখায়। একেবারে শুরুতে জঙ্গলকে আমরা যেভাবে পাই, সেখানে তা অনেক বেশি ভয়ের। রাতের নিকষ অন্ধকারে জাগ্রত হয় যত বিভীষিকাময় প্রাণী। আবার যখন হিড়িম্বা লুকিয়ে লুকিয়ে ভীমের দিকে তাকায়, আর তার শরীর-মনে কামনার আগুন জ্বলে ওঠে, তখন বিটপীর শান্ত-চঞ্চল মেদুরতা ছুঁয়ে যায় পাঠকের মন। আর যখন সব তর্কবিতর্ক পেরিয়ে এক হয় দ্বিতীয় পাণ্ডব ও হিড়িম্বা তখন বনস্থলী যেন তার ফুল-ফলের লাবণী নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে কুশীলবদের অন্দরে-অন্তরে। অরণ্যানির এমন করে ভালোবাসার ‘পোস্টম্যান’ হয়ে ওঠার সাক্ষী রইবে পাঠক।
ইংরেজি ভাষায় লিখিত এই গ্রন্থের নানা স্তরে বাঙালি চৈতন্যের বৌদ্ধিক অন্তর্ভুক্তি বিশেষভাবে মনে রাখার মতো। মহাভারতীয় রাক্ষসদের সঙ্গে কী অবলীলায় মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে বাংলা রূপকথার রাক্ষসখোক্ষসের জগৎ। রাক্ষসের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে আসে ‘হাউ মাউ খাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ’। শিশুসাহিত্য নিয়ে দীর্ঘ দিনের গবেষণার সূত্রে শিবাজী বাংলা রূপকথার নানা অলিন্দে বিচরণ করেছেন। কিন্তু সেই তথাকথিত গবেষণার ‘শক্ত’ জ্ঞান কত সহজে ছড়িয়ে পড়েছে এমন রম্য লেখনে! লেখার সঙ্গেই তাল মিলিয়ে ছবি, ‘হাউ মাউ খাঁউ’ এর দুনিয়াকে যেমন করে চিত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন শঙ্খ তাতে আক্ষরিকভাবেই ভয় লাগে। তবে এই ভয় এমন এক করাল জগতে নিয়ে যায় আমাদের, যেখানে ভয় পেতে ভালোবাসি আমরা। রাক্ষস আঁকতে গিয়ে মুখোশের ব্যবহার বিশেষ রূপে খেয়াল করার মতো। চিত্রকর যেন আমাদের চেতনার স্তরে প্রশ্ন তুলে ধরেন, যাকে আমরা ভয়ংকর, বীভৎস রূপে চিনি তার সঙ্গে শিল্পের যোগ নেই তো? রাক্ষসকে চিনতে জানতে এই মুখোশ শিল্পই মাধ্যম হয়ে ওঠে। আগুন থেকে জন্ম নেওয়া দ্রৌপদীকে যেমন করে লেখা ও রেখায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা যথার্থই সুন্দর। আগুনের অলংকার নিয়ে দ্রৌপদীর জন্ম। সেই দ্রৌপদীর স্বয়ম্বরে ধনুবাহী যানটিকে যারা ঠেলে নিয়ে চলেছে সেই মানুষরা বিশেষভাবে নিপীড়িত। তারা শুধু রুগ্ন জীর্ণই নয়, পোশাকটুকুও যেন কোনও রকমে পরে আছে। শঙ্খ তাঁর এই চিত্রদর্শনের মাধ্যমে পাঞ্চাল দেশের শৌর্যবীর্য আর দ্রৌপদীর সৌন্দর্যের বাইরে বেরিয়ে রাজতন্ত্র, ক্ষমতা আর শোষণের গল্প শুনিয়ে যান। এমন চোরা অন্তর্ঘাতই বুঝিয়ে দেয়, শিল্পী তাঁর নিজের ছবিকে কেমন চোখে দেখেন।
আরও পড়ুন- নয়ের দশকের স্মৃতি ও একটি সমকামী ভালবাসার পরিণতি
শিবাজী এই গ্রন্থে যেমন করে ভাষারূপ দিয়েছেন তা শত প্রশংসাতেও কম পড়বে। অল্প কথা, মৃদু বা তীক্ষ্ণ উচ্চারণ, আবার ভাষার অপরূপ লালিত্য এই সমস্ত কিছুর সঙ্গে জুড়ে গেছে কখনও শেক্সপীয়র, আবার কখনও কালিদাসের ছিন্নচরণ। তাই পাঞ্চালীর কথা ‘ভারত’এর হয়েও সকল দেশ সীমার অতীত। ভীম-হীড়ম্ব লড়াই, স্বয়ম্বর সভায় ভীমার্জুনের বিক্রম ইত্যাদির সংলাপ-রচনে শিবাজী অনন্য। আর সংলাপের সঙ্গেই জুড়েছে যোঝাযুঝির নানাবিধ ছবি। শঙ্খ একটি আলাপচারিতায় বলেছেন, রণদৃশ্য সৃজনে তিনি বিশেষভাবে কিছু দর্শনগত অবস্থান বিচার করেছেন। বিশেষত ভীমের দ্বৈরথ অনেক বেশি রক্তাক্ত, বীভৎস এবং হিংস্র। অন্যদিকে অর্জুনের তীরন্দাজি অনেক বেশি পরিচ্ছন্ন। মহাভারতে যুদ্ধবিগ্রহ সীমাহীন অস্থিরতা এবং ক্রোধের কথা বলে। পাঞ্চালী সেই বীররসকে যথার্থভাবেই ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। খাণ্ডববন দহনের গল্প এবং ছবি মনে করিয়ে দেয় অরণ্যের উপর ঘটে চলা দীর্ঘকালীন ধ্বংসযজ্ঞের স্মৃতি। একটা বাস্তুতন্ত্রকে চোখের সামনে শেষ হয়ে যেতে দেখি আমরা। এই অংশটি ছবি এবং লেখায় এমন ডুবিয়ে দেয় আমাদের, পাঠক হিসাবেও আমরা যেন অরণ্যচারী পশুদের ক্রন্দন শুনতে পাই। দেখতে পাই চোখের জল।
পাশাখেলায় মত্ত যুধিষ্ঠিরকে বুঝতে গিয়ে, তার মগজটাকেই হাজির করা হয়েছে ছবিতে। আর সেই মগজ শিশ্নতে ক্রমপরিবর্তিত হয়েছে। আলাপচারিতায় শঙ্খ বলেছেন, পাশাখেলা অংশে যুধিষ্ঠির যেন অনেক বেশি পুরুষ হয়ে উঠতে চেয়েছেন। শিশ্নই তাকে শাসন করেছে। শিশ্নের এই শাসনকে ছবিতে আমরা নাৎসি স্বস্তিকচিহ্নে রূপান্তরিত হতে দেখি। আর রাজসভায় যারা বস্ত্রহরণের দৃশ্য দেখে তাদের চোখগুলো শুক্রাণু হয়ে ধেয়ে আসে দ্রৌপদীর দিকে। মহিলা প্রেক্ষিতে পুরুষের দৃষ্টি ধর্ষণ—এতে শঙ্খর নারীবাদী চিত্রদর্শনের আভাস মেলে।
কথা ও ছবির সুচারু যুগলবন্দি এই গ্রন্থের প্রাণরূপ। শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় দীর্ঘদিন ধরে মহাভারত নিয়ে কাজ করেছেন। মহাভারতকে বুঝতে তিনি সংস্কৃত মান্য সংস্করণ গ্রন্থকে যেমন আশ্রয় করেছেন তেমনই হাজির হয়েছেন দেশিয় ভাষার দরবারে। কোনওদিন যদি তিনি কাশীদাসের বারান্দায় পা ছুঁইয়েছেন তো অন্যদিন শঙ্কর কবিচন্দ্রের দেশে। চিত্রশিল্পী শঙ্খ তাঁর ছবির জগত গড়তে যেমন এই দেশের পুরনো ইতিহাসের আশ্রয় নিয়েছেন, তেমনই পাড়ি দিয়েছেন মেসোপটেমিয়ার স্থাপত্যের পথেও। এমন সম্মিলনেই বোধহয়, অমর কাব্য লেখা হয়।
চিত্র সৌজন্যে: শঙ্খ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পেঙ্গুইন