জীবন সংকটে, তবুও ব্রাজিলকে বাজি ধরে খেলা দেখছিলেন পেলে

FIFA World Cup 2022 : ডাক্তাররাও চিন্তিত তাঁকে নিয়ে। কিন্তু ব্রাজিলের ম্যাচ থাকলে পেলে যেন অন্য এক গ্রহের বাসিন্দা হয়ে যান।

কাতারের এডুকেশন সিটি স্টেডিয়াম থেকে সাও পাওলোর অ্যালবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালের দূরত্ব কত? খাতায় কলমে না মাপা হলেও, কয়েক হাজার কিলোমিটার তো হবেই। সেই হাসপাতালের প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিটের একটি বিছানায় রয়েছেন এক ৮২ বছরের বৃদ্ধ। ঝলমলে, সদা চঞ্চল চোখ যেন ঝিমিয়ে এসেছে বয়সের ভারে। যে পায়ের জাদু কিংবদন্তি হয়ে গিয়েছে, ফুটবল ইতিহাসের একটা গোটা অধ্যায়ই যিনি দখল করে আছেন চিরকালের জন্য, সেই মানুষটির এখন প্রয়োজন পড়ে হুইল চেয়ারের। তবুও তো তিনি সম্রাট! তবুও তিনি পেলে! ক্যানসার যতই নিজের তেজ বাড়াক, ফুটবল আর পেলেকে আলাদা করা যাবে না কখনই। তিনি নিজেই হতে দেবেন না।

ফুটবল বিশ্বকাপের মরসুমে টগবগে গোটা বিশ্ব। তারই মধ্যে পেলের অসুস্থতা সবার মনেই দুর্যোগের কালো মেঘ ঘনিয়ে আনে। হাসপাতালে শুয়েও তাঁর চোখ ছিল বিশ্বকাপের দিকে। ব্রাজিলের দিকে। প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালের সাম্বা ঝলক তাঁর নজর এড়ায়নি নিশ্চয়ই। কিন্তু তারপরই চরম হতাশা। এখনও যার ঘোর কাটাতে পারেনি ফুটবল বিশ্ব। যে ব্রাজিল দলকে ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ জেতার অন্যতম দাবিদার ধরা হয়েছিল, সেই দলটিই ছিটকে গেল। কোয়ার্টার ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার কাছে পেনাল্টি শ্যুট আউটে ৪-২ ব্যবধানে হার কার্যত স্তব্ধ করে দেয় ফুটবল জগতকে। স্টেডিয়ামে, ব্রাজিলে, প্রতিটি গলিতে সাম্বার ফ্যানদের চোখে জল। মাঠের মধ্যে বসে পড়েছেন ব্রাজিলের আশা নেইমার। কান্না, কেবলই কান্না ঘুরে বেরাল কাতারের স্টেডিয়ামটিতে…

আর তিনি? সাও পাওলোর হাসপাতালে অসুস্থতার সঙ্গে নিত্য লড়াই তাঁর। ডাক্তাররাও চিন্তিত তাঁকে নিয়ে। কিন্তু ব্রাজিলের ম্যাচ থাকলে পেলে যেন অন্য এক গ্রহের বাসিন্দা হয়ে যান। ইচ্ছা ছিল, ১৮ ডিসেম্বরে ফাইনালের দিন সেলেকাওদের হাতে বিশ্বকাপ তুলে দেবেন তিনি। ষষ্ঠবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার অদম্য ইচ্ছা আর জেদ ছিল মনের মধ্যেই। কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রাজিলের অকস্মাৎ হারের পর কেমন আছেন তিনি? নেইমারের দুর্ধর্ষ একটি গোলে এগিয়ে গিয়েও নিয়ন্ত্রণের অভাবে হারতে হল হলুদ-সবুজ ব্রিগেডকে। এতগুলো সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারলেন না ভিনিসিয়াস জুনিয়র, নেইমার, রিচার্লিসনরা। তখন কেমন মনে হচ্ছিল পেলের?

 
 
 
 
 
View this post on Instagram
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 
 

A post shared by Pelé (@pele)

যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর নেমে এল ম্যাচের পর। ইনস্টাগ্রামের পর্দায় হঠাৎ সচল হয়ে উঠল ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবল সম্রাটের প্রোফাইল। গোলের পর নেইমারের উল্লাসের ছবি, আর নিচে দীর্ঘ একটি বক্তব্য। ব্রাজিল দল, বিশেষ করে নেইমারের উদ্দেশ্যে হাসপাতাল থেকে বিশেষ বার্তা দিয়েছেন তিনি। এখানে উল্লেখ্য, ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে গোলটি দেশের হয়ে নেইমারের ৭৭ তম গোল। এদিনই তিনি স্পর্শ করলেন পেলেকে।

কান্নায় ভেঙে পড়া নেইমারের কাঁধে যেন অদৃশ্য হাতটি রাখলেন পেলে। বললেন, “আমি তোমাকে বড়ো হতে দেখেছি। প্রতিদিন তোমার জন্য গলা ফাটিয়েছি। ব্রাজিলের হয়ে গোলসংখ্যার বিচারে তুমি এখন আমায় স্পর্শ করেছ, অভিনন্দন! এসব সামান্য সংখ্যা মাত্র। খেলোয়াড় হিসেবে আমাদের মূল উদ্দেশ্য, মানুষকে প্রভাবিত করা। তাঁদের মধ্যে আশার সঞ্চার করা, তাঁদের অনুপ্রাণিত করা।”

এরপর তিনি ব্রাজিল-ক্রোয়েশিয়া ম্যাচের প্রসঙ্গে আসেন। পেলে নিজের বক্তব্যে বলেছেন, “দুর্ভাগ্যবশত, আজ আমাদের দিন ছিল না। কিন্তু তুমি (নেইমার) সবসময় তোমার পরের প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করেছ। তোমাকে দেখে তারা সাহস পেয়েছে। ৫০ বছর আগে আমার রেকর্ড তৈরি হয়েছিল। এতদিন সেটি অক্ষুণ্ণ ছিল। শেষমেশ তুমি এলে। তুমি পারলে! এর থেকেই তোমার প্রতিভা, তোমার শ্রেষ্ঠত্বের ঝলক দেখা যায়।”

এভাবেই ম্যাচের পর নতুন আশার বাণী শোনালেন পেলে। অভিভাবক হিসেবে পাশে দাঁড়ালেন নিজের দলের। সেইসঙ্গে নেইমারকেও শুভেচ্ছা জানাতে ভুললেন না। প্রসঙ্গত, বিশ্বকাপ শুরুর পরই রুটিন চিকিৎসার জন্য সাও পাওলোর অ্যালবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে ভর্তি হন পেলে। তারপরই শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। কেমোথেরাপি কোনও কাজ না করায় চিকিৎসকরাও চিন্তিত হয়ে পড়েন। শেষমেশ হাসপাতালেরই প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিটে নিয়ে যাওয়া হয় পেলেকে। ফুটবল সম্রাটের যন্ত্রণা যাতে একটু কম হয়, তার জন্যই এই ব্যবস্থা। এখন অবশ্য আগের থেকে তুলনামূলক ভালো আছেন পেলে।

কিন্তু ফুটবল সম্রাটের অসুস্থতা চিন্তায় ফেলে দেয় গোটা বিশ্বকে। শেষমেশ কয়েকদিন আগে পেলে নিজেই ভিডিও বার্তা দেন হাসপাতাল থেকে। সেটা দেখার পর খানিক স্বস্তি হয় ভক্তদের। বিশ্বকাপের মঞ্চেও পেলের সুস্থতা কামনায় শুরু হয় প্রার্থনা। ব্রাজিলের ফুটবল দলও পেলের সুস্থতার বার্তা নিয়ে খেলতে নামে। তাঁর জন্য ফের একবার বিশ্বকাপ জিততে চেয়েছিলেন রিচার্লিসন, অ্যালিসনরা। অন্যদিকে অধিনায়ক থিয়াগো সিলভা, দানি আলভেসকে আর দেখা যাবে না ব্রাজিলের জার্সিতে। হারের পর নেইমারও অবসরের সামান্য ইঙ্গিত দিয়ে রাখলেন। পদত্যাগ করলেন ব্রাজিল কোচ তিতেও।

এতকিছুর মধ্যে আশা হারাননি পেলে। সেলেকাওদের ম্যাজিক কখনও থেমে থাকবে না। মাঠে তাঁরা ফের জ্বলে উঠবেন, এই আশাই রাখছেন ৮২ বছরের মানুষটি। বারবার নেইমারকে বলছেন, সবাইকে আরও অনুপ্রাণিত করতে থাকো। তোমার গোলের পর আবার সবাই মিলে আনন্দ করব। আনন্দ করবে ব্রাজিল। এই বার্তাই কি নেইমারের মনে সাহস জোগাবে? আপাতত পরের বিশ্বকাপের প্রার্থনাতেই দিনযাপন সাম্বাদের।

More Articles