মণিপুর নিয়ে লাগাতার প্রশ্ন রাহুল-মহুয়াদের! বাধ্য হয়েই দায়সারা উত্তর মোদির?

Modi on Manipur: লোকসভা ভোটের আগে-পরে মণিপুর নিয়ে মুখ খোলেননি প্রধানমন্ত্রী। অবশেষে বিরোধীদের চাপে বুধবার সংসদে শেষপর্যন্ত মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি।

গোটা ২০২৩ জুড়ে জাতিহিংসায় উত্তাল থেকেছে মণিপুর। গোটা একটা বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও শান্তি ফেরেনি মণিপুরে। অথচ প্রধানমন্ত্রী সে নিয়ে উচ্চবাচ্যও করেননি এতদিন। এমনকী একটি কথা পর্যন্ত হয়নি লোকসভায়। তবে এবারের লোকসভা অধিবেশন যেন অন্যবারের চেয়ে আলাদা। গত এক দশক পরে লোকসভায় বিরোধী দলনেতার চেয়ার ফাঁকা নেই। তার উপর এবার লোকসভা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি বিজেপি। এনডিএ শরিকদের কাঁধে ভর করে সরকার গড়তে বাধ্য হয়েছে তারা। উল্টোদিকে লোকসভা ভোটে না জিততে পারলেও মানুষের সমর্থন অনেকটাই গিয়েছে জোট ইন্ডিয়ার দিকে। ফলে শক্ত হয়েছে বিরোধীদের হাত। এ বার লোকসভা অধিবেশন শুরু হতে না হতেই তা ভালোভাবেই মালুম পেয়েছে বিজেপি সরকার। একাধিক বিষয় নিয়ে বিরোধিতায় ফেটে পড়েছে লোকসভা। তার মধ্যে একটি অবশ্যই মণিপুর।

দুদিন ধরে লাগাতার বিরোধী নেতারা মণিপুর প্রসঙ্গে বিঁধেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে। এমনকী মঙ্গলবার যখন প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণ দিতে ওঠেন তখনও লোকসভা ফেটে পড়ে বিরোধীদের মণিপুর স্লোগানে। এই প্রথমবার মণিপুরের একজন সাংসদকে পেয়েছে লোকসভা। ওই দিন কথা বলতে উঠে মণিপুর নিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন অঙ্গোমচা বিমল আকোইজম। এমনকী রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত তাঁর ভাষণে একবার উল্লেখ করেননি মণিপুরের প্রসঙ্গ।

আরও পড়ুন: মণিপুরে চুপ থাকা মানে মেরি-রতন থিয়ামদের অপমান করা! মোদির উদ্দেশ্যে মণিপুরের সাংসদ

লোকসভা ভোটের আগে-পরে মণিপুর নিয়ে মুখ খোলেননি প্রধানমন্ত্রী। অবশেষে বিরোধীদের চাপে বুধবার সংসদে শেষপর্যন্ত মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। সোমবার ভাষণ দিতে উঠে রাহুল গান্ধি জানান, মণিপুরকে সরাসরি গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। তাঁর অভিযোগ, সরকার এমন আচরণ করছে যেন মণিপুরে কিছুই হয়নি । রাহুলের কথায়, "মণিপুর আপনার, আপনাদের নীতি এবং আপনাদের রাজনীতির জন্য পুড়ে গিয়েছে ৷" বিরোধী দলনেতা আরও বলেন, "মনে হচ্ছে যেন মণিপুর ভারতের কোনও রাজ্যই নয় ! প্রধানমন্ত্রীর জন্য, মণিপুর রাজ্য নেই। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে একটি বার্তা দিতে, সেখানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছি। কিন্তু না, প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কোনও উত্তর পাবেন না ৷"

মণিপুরের সাংসদ আঙ্গোমচার গলাতেও শোনা গিয়েছে একই সুর। এদিন তিনি কেন্দ্র সরকারকে মনে করিয়ে দেন মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতির কথা। কীভাবে ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ এখনও গৃহহীন মণিপুরে। অনেকেই তাঁদের মধ্যে কোনও মতে মাথা গুঁজেছেন শরণার্থী শিবিরে। এক বছর কেটে গেলেও মণিপুরের পরিস্থিতি পাল্টায়নি। মানুষ কীভাবে বেঁচে রয়েছেন, তা বর্ণনার অতীত বলেই এদিন সংসদে জানান কংগ্রেস সাংসদ। আঙ্গোমচা জানান, মণিপুরের প্রতি বর্গকিলোমিটার জায়গা জুড়ে আজও মোতায়েন রয়েছে কেন্দ্রীয় বাহিনী। হিংসায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি। অথচ প্রধানমন্ত্রী নীরব। রাষ্ট্রপতি এড়িয়ে যাচ্ছেন মণিপুরের কথা।

ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছিলেন, মণিপুরে শান্তি ফিরেছে। তার কৃতিত্বও দিয়েছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ এবং বিজেপিশাসিত মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংকে। তার পর সম্ভবত এই প্রথমবার মণিপুর নিয়ে মুখ খুললেন মোদি। অবশ্য তাঁর মুখে ফের শোনা গেল মণিপুরের স্বাভাবিকতার কথাই। যদিও মঙ্গলবারই মণিপুরের সাংসদ অঙ্গোমচা বিমল আকোইজম জানিয়েছেন, অন্তত ৬০ হাজার মানুষ এখনও গৃহহীন মণিপুরে। এদিকে মোদি বুধবার রাজ্যসভায় জানালেন, ‘‘মণিপুর নিয়ে যাঁরা আগুনে ঘৃতাহুতি দিচ্ছেন, তাঁরা জেনে রাখুন, মণিপুরই একদিন তাঁদের প্রত্যাখ্যান করবে।’’ কারণ ব্যাখ্যা করে মোদী বলেন, ‘‘কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকার মিলে মণিপুরের পরিস্থিতি শোধরানোর নিরন্তর চেষ্টা চালাচ্ছে। আর সেই চেষ্টায় ধীরে ধীরে সাড়াও দিচ্ছে মণিপুর। স্বাভাবিকত্ব ফিরছে সেখানে।’’

কেন্দ্রে নতুন সরকার গড়ার পর বুধবার রাজ্যসভায় প্রথম ভাষণ ছিল মোদীর। সেখানে বিরোধীদের মণিপুর নিয়ে তোলা প্রশ্নের জবাব দেন মোদী। যদিও মোদীর কথার মাঝেই রাজ্যসভায় ‘ঝুট-ঝুট’ রব ওঠে। রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা মল্লিকার্জুন খড়্গেকে বলতে দেওয়ার দাবিতে সরব হন বিরোধীরা। সেই দাবি না মানায় রাজ্যসভা থেকে ওয়াক আউটও করেন বেশ কয়েক জন। এদিন কার্যত ‘বিরোধীশূন্য’ রাজ্যসভাতেই মণিপুর নিয়ে বিরোধীদের প্রশ্নের ‘জবাব’ দেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে বিরোধীদের কটাক্ষ করে তাঁকে বলতে শোনা যায়, ‘‘এঁরা যে প্রশ্ন করেছেন, তার জবাব শোনার মত ধৈর্যও নেই এঁদের।’’ মোদি এদিন জানিয়েছেন, ‘‘মণিপুরে স্বাভাবিকত্ব ফেরাতে সরকার ক্রমাগত কাজ করে চলেছে। মণিপুরে এ পর্যন্ত ১১ হাজার এফআইআর দায়ের হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে ৫০০ জনকে। ধীরে ধীরে হিংসাত্মক ঘটনা কমছে মণিপুরে। স্কুল-কলেজ খুলছে। এমনকি, কিছু দিন আগে যখন দেশের সমস্ত স্কুল-কলেজে পরীক্ষা হয়েছে, তখন পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে মণিপুরেও।’’

একই সঙ্গে মণিপুর নিয়ে বিরোধীদের সমস্ত দাবির জোর সমালোচনা করে মোদি এদিন জানান, ‘‘মণিপুরে যা হচ্ছে, তার শিকড় অনেক গভীরে। কংগ্রেসের মনে রাখা উচিত, মণিপুরে ১০ বার রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে হয়েছিল। কিছু তো কারণ ছিল, যার জন্য এমন করতে হয়েছিল। অথচ কংগ্রেসই এখন ওই বিষয়ে রাজনীতি করতে ব্যস্ত।’’ কংগ্রেসের শাসনকালেও যে মণিপুরে ‘অশান্তি’ হয়েছিল, তা মনে করিয়ে দিয়ে মোদী বলেন, ‘‘১৯৯৩ সালে মণিপুরে এই একই জিনিস হয়েছিল। পাঁচ বছর ধরে চলেছিল সেই অশান্তি। তাই আমি বলব, এখন মণিপুরের যা পরিস্থিতি, তার সমাধান করতে যদি কেউ আমাদের পাশে দাঁড়াতে চান, আমি তাঁদের সাদরে অভ্যর্থনা জানাব। কিন্তু যাঁরা মণিপুরের আগুনে ঘি ঢালার চেষ্টা করছেন, তাঁদের সতর্ক করব। কারণ, এটা করলে মণিপুরই একদিন ওঁদের প্রত্যাখ্যান করবে।’’

আরও পড়ুন: মোদির প্রিয় ম: মুসলিম, মাদ্রাসা, মাংস… মণিপুর কই? প্রশ্ন মহুয়ার

মণিপুর নিয়ে মোদির এই বক্তব্য কি আসলে লোকসভায় মণিপুর ইস্যুতে নতুন করে ঘি-ই ঢালল? মোদি সরকারের বিরোধিতা করার নয়া অস্ত্র তুলে দিল বিরোধীদের হাতে? হিংসাদীর্ণ মণিপুরে একবারও পা রাখেননি মোদি, এমনকী বিরোধীদের বারবার অনুরোধের পরেও। লোকসভা ভোটে তার জবাব পেয়েছে বিজেপি হাতে হাতে। মোদির এই আত্মমগ্নতা কি মণিপুরের সেই ক্ষোভের আগুনে নতুন করে ঘৃতাহূতি দিল? উঠছে প্রশ্ন।

More Articles