মাত্র ৮০০ টাকা পুঁজি নিয়ে শুরু বেঙ্গল কেমিক্যালস! বাঙালি কোথা থেকে কোথায় এল

যখনই কোনও বক্তৃতায় গিয়েছেন, মুক্তকণ্ঠে বলেছেন, এই শিক্ষাব্যবস্থা ভুল। যে জ্ঞান শুধু গুমর দেয়, কর্মঠ হতে শেখায় না, তা পরিত্যজ্য। তাঁর বক্তব্য ছিল, কেরানি হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিড় বাড়ানোর কোনও প্রয়োজনই নেই।

বাঙালী আজ জীবন মরণের সন্ধিস্থলে উপস্থিত। একটা সমগ্র জাতি মাত্র কেরানী বা মসীজীবী হইয়া টিকিয়া থাকিতে পারে না; বাঙালী এতদিন সেই ভ্রান্তির বশবর্তী হইয়া আসিয়াছে এবং তাহারই ফলে আজ সে সকল প্রকার জীবনোপায় ও কর্মক্ষেত্র হইতে বিতাড়িত। …জাতির ভবিষ্যৎ যে অন্ধকারাবৃত, তাহা বুঝিতে দূরদৃষ্টির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু তাই বলিয়া আশা ভরসার জলাঞ্জলি দিয়া হাত গুটাইয়া বসিয়া থাকিলেও চলে না। 'বৈষ্ণবী মায়া' ত্যাগ করিয়া দৃঢ়হস্তে বাঁচিবার পথ প্রস্তুত করিয়া লইতে হইবে।

-আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়

নিজে ব্যতিক্রম বলেই এমন কথা অনায়াসে বলতে পেরেছিলেন। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়। বাবা হরিশচন্দ্র ছিলেন জমিদার। কিন্তু জমিদারি রাখতে পারেননি। সব বেচে দিয়ে কলকাতার বাসা ছেড়ে খুলনায় ফিরে এসেছিল হরিশের পরিবার। সে-বাড়ির সেজ ছেলে প্রফুল্ল। উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতের পথে রওনা দেওয়ার আগে মাকে ডেকে বলেছিলেন, "জীবনে সাফল্য লাভ করলে, প্রথমেই সম্পত্তি পুনরুদ্ধার ও বাড়ির সংস্কার করব।" আত্মবিশ্বাস তখনও একফোঁটা টলেনি। কাজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার পাশাপাশি অর্থনীতি নিয়ে তাঁর যে আগ্রহ তৈরি হবে, তা আর আশ্চর্য কী! ভারতের গোড়ার দিকের কয়েকজন সফল শিল্পপতিদের সঙ্গে তাঁর পার্থক্য এই যে, তিনি রসায়নবিদ এবং তাঁর পড়াশোনার অভাব ছিল না। ব্যবসা ব্যাপারটা রীতিমতো গুলে খেয়েছিলেন। আত্মজীবনীতে লিখেছেন, "বাল্যকাল হইতেই আমি অর্থ-নৈতিক সমস্যার প্রতি আকৃষ্ট হইয়াছি এবং পরবর্তী জীবনে শিক্ষা ও বিজ্ঞান চর্চার ন্যায় উহা আমার জীবনে ওতপ্রোতভাবে মিশিয়া গিয়াছে।"

মাঝে একশোটা বছর পেরিয়ে গিয়েছে। উদারনীতিবাদের সুযোগে জ্ঞানচর্চা ছাড়াই কেবল রোজগারে আখের গোছানোর স্বাদ পেয়েছে মধ্যবিত্ত। প্রফুল্লচন্দ্র নিয়ে খুব একটা চর্চার আর প্রয়োজন বোধ করে না তারা। শিক্ষক নিয়োগের কারচুপিতে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছেন নেতারা। বর্তমানে ব্যবসার ক্ষেত্রটিও আর তেমন প্রশস্ত নয় সে-যুগের মতো। মসীজীবী মধ্যবিত্ত বাঙালি এখন ঘুষের বিনিময়ে চাকরি চায়, পড়াশোনার কষ্টটুকুও তেমন পোষায় না তাদের। সাধারণ মানুষ তখনও মুখে ফেনা তুলে পরিশ্রম করত, পেট ভরত না, এখনও তাই করে, পেট ভরে না।

আরও পড়ুন: তাঁর হাতেই তৈরি জাতীয় পতাকার নকশা, তবু শেষ জীবন কেটেছিল চরম দারিদ্রে

প্রফুল্লচন্দ্র প্রেসিডেন্সিতে অধ্যাপনা করতেন। জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, মানিকলাল দে, পুলিনবিহারী সরকার, নীলরতন ধর, মেঘনাদ সাহা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, রসিকলাল দত্ত— একঝাঁক তাজা ছাত্রকে তৈরি করেছিলেন নিজের হাতে। সকলেই কৃতী ছাত্র, পরবর্তীতে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। এঁদের অনেককে নিয়েই প্রফুল্লচন্দ্র গড়বেন 'ইন্ডিয়ান স্কুল অফ কেমিস্ট্রি'। ছাত্রদের সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করতেন। এই কারণে ছাত্রদের সঙ্গে একটা অদ্ভুত মমত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠত তাঁর। অপরদিকে ৮০০ টাকা মাত্র পুঁজি নিয়ে বেঙ্গল কেমিক্যালস গড়ে তুলছেন নিজের বাড়িতে। ৯১ নম্বর আপার সার্কুলার রোডে ভাড়া থাকেন তখন। এদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাপদ্ধতি নিয়ে খুবই বিরক্ত ছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। ধরা-বাঁধা সিলেবাসে পাশ করে ডিগ্রি-হাঁকানো ছাত্র তখন প্রচুর। বেশিরভাগই প্রকৃত অর্থে শিক্ষিত না। অর্ধশিক্ষিত বেকারে বাংলা ভরে উঠেছে। আজীবন এই শিক্ষাপদ্ধতির বিরোধিতা করে গিয়েছেন। চাকরি নেই, দেশে শিল্প নেই, অথচ পাশ করা দিগগজেরা পরিশ্রমের নাম শুনলে পালায়। ব্যবসা তো অনেক দূরের কথা, বিয়ে করে সেই পণে জীবন চালানোর স্বপ্ন দেখে। এই সমস্ত দেখে শুনে প্রফুল্লচন্দ্রের সহ্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল। যখনই কোনও বক্তৃতায় গিয়েছেন, মুক্তকণ্ঠে বলেছেন, এই শিক্ষাব্যবস্থা ভুল। যে জ্ঞান শুধু গুমর দেয়, কর্মঠ হতে শেখায় না, সে জ্ঞান পরিত্যজ্য। তাঁর বক্তব্য ছিল, কেরানি হওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিড় বাড়ানোর কোনও প্রয়োজনই নেই। মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থা ভালো করে গড়ে তুলে কেরানিদের আলাদা চাকরি পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হোক। বিশ্ববিদ্যালয় গতে বাঁধা পড়াশোনার জন্য নয়। বরং অধ্যাপকরা নিজেদের গবেষণার ভিত্তিতে নতুন যা কিছু আবিষ্কার করবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের তাঁরা তা শিখিয়ে দেবেন।

সেই সময়টা জাতীয়তাবাদের পরিপূর্ণ বিকাশের সময়। ফলে ব্রিটিশ সরকারের কাছে চাকরির ভিক্ষাবৃত্তি সম্বন্ধে প্রফুল্লচন্দ্রের মননে তীব্র অনীহা জাগাটাই স্বাভাবিক। বরং আত্মনির্ভর হওয়ার লক্ষ্যে মধ্যবিত্তকে ব্যবসায় ব্রতী করার দিকেই তাঁর ঝোঁক ছিল বেশি। এই সময়েই বেঙ্গল কেমিক্যালস গড়ে তোলা। বলছেন, "ইয়োরোপ ও আমেরিকার ব্যবসায়ের ক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত যুবকদের পক্ষে কিরূপ সীমাবদ্ধ, তাহা আমি দেখাইয়াছি। আমাদের দেশে, আবার ততোধিক বিপুল বাধাবিঘ্নের সঙ্গে সংগ্রাম করিতে হয়। সাধারণ ইয়োরোপীয় বা আমেরিকান্ গ্রাজুয়েটের সাহস, কর্মোৎসাহ এবং সর্বপ্রকার বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করিয়া জয়লাভের জন্য দৃঢ়সংকল্প আছে, কিন্তু ভারতীয় গ্রাজুয়েটদের চরিত্রে ঐ সব গুণ নাই। আমাদের রাসায়নিক কারখানায় প্রায় ৬০ জন বিজ্ঞানের গ্রাজুয়েট আছে। তাহারা তাহাদের দৈনন্দিন নির্দিষ্ট কাজ বেশ চালাইতে পারে। কিন্তু তাহারা নিজের চেষ্টায় বা কর্মপ্রেরণায় প্রায়ই কিছু করতে পারে না।" কারখানাতেও ধরাবাঁধা গত দেখে খানিক অবাক হয়েছিলেন প্রফুল্লচন্দ্র। তবে এও অনস্বীকার্য, সেই দেখার মধ্যে অনেকখানি জাতীয়তাবাদী অভাববোধ ছিল।

রবীন্দ্রনাথ যেমন শান্তিনিকেতনের ছাত্রদের মধ্যে কৌতূহলের অভাব দেখেছিলেন, প্রফুল্লচন্দ্রের অভিজ্ঞতাও অনেকটা কাছাকাছি। বরং ব্যবসার ক্ষেত্রে তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলত, বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন লোকের প্রয়োজন অনেক বেশি। বারবার এই কথা বলেছেন প্রফুল্লচন্দ্র। বেঙ্গল কেমিক্যালস তখন অত্যন্ত সফল প্রতিষ্ঠান। অথচ প্রতিষ্ঠাতার সহজ-সরল জীবনযাপন দেখে অবাক হতেন অনেকেই। বৈজ্ঞানিক চিন্তা এবং কর্মশক্তির পারস্পরিক বোঝাপড়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন চিরকাল। নিজের জন্য একফোঁটা ভাবার সময় পাননি।

বিজ্ঞানচেতনা এবং রাজনীতি যে পরস্পরবিরোধী নয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ তিনিই। হোক দুর্ভিক্ষ, হোক বন্যা- ঝুলি নিয়ে বাড়ি বাড়ি ত্রাণ সংগ্রহ করতে বেরিয়ে পড়েছেন। 'বেঙ্গল রিলিফ কমিটি'-র অন্যতম প্রাণপুরুষ। সঙ্গে থাকতেন সুভাষ বোস। তখনও নেতাজি হননি তিনি। ৭০ জন স্বেচ্ছাসেবী কাজ করত তাঁর অধীনে। রবীন্দ্রনাথ প্রফুল্লচন্দ্র সম্বন্ধে বলেছিলেন, "আমি প্রফুল্লচন্দ্রকে সেই আসনে অভিনন্দন জানাই যে আসনে প্রতিষ্ঠিত থেকে তিনি তাঁর ছাত্রের চিত্তকে উদ্বোধিত করেছেন— কেবলমাত্র তাকে জ্ঞান দেননি নিজেকে দিয়েছেন— যে দানের প্রভাবে সে নিজেকেই পেয়েছে। …কত যুবকের মনোলোকে ব্যক্ত করেছেন তার গৃহাস্থিত অনভিব্যক্ত দৃষ্টিশক্তি, বিচারশক্তি, বোধশক্তি।"

এমন নিজেকে উজাড় করে দেওয়া শিক্ষক এখন কোথায়? ব্যবসা করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মানসিকতা কোথায়? সাধারণ মানুষের জন্য পথে নামা শিক্ষিত ব্যক্তি কোথায়? শিক্ষামন্ত্রীর কালো টাকার পাহাড়ের নিচে খেটে খাওয়ার মানসিকতা খাবি খাচ্ছে ক্রমাগত। খেটে খাওয়ার মানসিকতা বাঙালি মানস থেকে মুছে গিয়েছে কয়েক দশক। ২ আগস্ট প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের জন্মদিন। চিরকালের ঠোঁটকাটা মানুষটির জন্মদিন বাঙালি বিস্মৃত হয়েছে।
 

 

More Articles