রোদ্দুর রায় বাঙালির নয়া আইকন? প্রতিবাদের মাঝেই যে প্রশ্ন উঠে আসছে
রোদ্দুর রায়ের প্রতিবাদী আইকন হয়ে ওঠায় আরও একটা কথা বোঝা গেল, তা হলো বাঙালি মধ্যবিত্ত বামেদের আইকন সংকট। বাঙালি মধ্যবিত্ত বামেরা আজন্ম আইকন খুঁজে এসেছে। কখনও তা কানহাইয়া কুমার তো কখনও রোদ্দুর রায়।
২০২২-এর ৭ জুন গোয়া থেকে রোদ্দুর রায়কে গ্রেপ্তার করে কলকাতা পুলিশ। রোদ্দুর রায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে তাঁর ফেসবুক লাইভে কুরূচিকর মন্তব্য করেছেন। রোদ্দুর রায়ের এই গ্রেপ্তারির পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়া চত্বর বেশ সরগরম হয়ে উঠেছে। রোদ্দুর রায়ের একাধিক সমর্থক এবং দর্শকদের দেখা গেছে তাঁর সমর্থনে ফেসবুকে তর্কবিতর্ক চালাতে এবং ফেসবুক ওয়ালজুড়ে সমর্থনসূচক লেখালেখি করতে। রোদ্দুর রায়ের এই গ্রেপ্তারির সঙ্গে সঙ্গে একাধিক মানবাধিকার সংগঠনকেও দেখা গেছে তাঁর মুক্তির দাবি তুলতে। নেটিজেনদের একাংশের মতে, রোদ্দুরের এই গ্রেপ্তারি আদতে বাংলার বাকস্বাধীনতার দুরবস্থার চিত্রকেই স্পষ্ট করে।
রোদ্দুর রায় এক দীর্ঘ সময়জুড়ে ফেসবুক এবং ইউটিউবে তাঁর এই কনটেন্ট আপলোড করতেন। তাঁর চর্চার বিষয়বস্তু হতো কখনও সাহিত্য বা কখনও রাজনীতি। এমনকী, সম্প্রতি কে কে বিতর্ক নিয়েও তাঁকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হতে দেখা যায়। মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে এই ভিডিও-র আগেও একবার সে বাঙালির চর্চার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে। যখন সে রবীন্দ্রনাথের একটি গানকে বেশ খানিক বিকৃত করে সামনে আনে। সেই সময়-ও এই পক্ষ ভাগ স্পষ্ট নজরে আসে।
তাঁর প্রতিটা কনটেন্টকে মন দিয়ে দেখলে তাঁর এই 'মোক্সা' দর্শন সম্পর্কে একটা আবছা হলেও ধারণা পাওয়া যায়। সংস্কৃত শব্দ 'মোক্ষ' থেকেই এই 'মোক্সাবাদ'-এর আবির্ভাব। সে মূলত 'খিস্তি' অথবা ইংরেজিতে আমরা যাকে 'স্ল্যাং' বলি, সেই ভাষা ব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানের কানে খানিক অস্বস্তি তৈরির চেষ্টা করে। আপাতভাবে একটা নৈরাজ্যবাদী কায়দায়। যদিও তাঁর এই পদ্ধতি কতটা সূদূরপ্রসারী হতে পারে, তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়, তাও একটা ক্রমাগত ডিস্টারবেন্স তৈরির চেষ্টা সে করে। তাঁর আঘাত করার জায়গা হয়ে ওঠে বাংলার সুশীল 'বাবু' সমাজ।
আরও পড়ুন: রবীন্দ্রনাথ থেকে নেতাজি সুভাষ, উপন্যাসের পাতায় পাতায় ধরা পড়েন এক অন্য রোদ্দুর রায়
যেমনটা আগেই বলেছিলাম। তাঁর এই গ্রেপ্তারির পর একটা বড় অংশের মানুষকে দেখা যায় ক্রোধে এবং প্রতিবাদে ফেটে পড়তে। তাঁর সমর্থকরা রাজ্যে বাকস্বাধীনতা আছে কি না, তা নিয়ে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করা শুরু করেন। যা সত্য। যা দুশ্চিন্তার। তবে খটকা বা আয়রনি, যাই বলি না কেন, তা অন্য জায়গায়। রোদ্দুর রায়ের এই গ্রেপ্তারির কয়েক মাসে আগে, এই রাজ্যেই একাধিক গণআন্দোলনের কর্মীকে গ্রেফতার করে রাজ্য পুলিশ। জয়িতা দাস, প্রতীক ভৌমিক, হাসিবুক শেখ, টিপু সুলতান, সঞ্জীব মজুমদার এবং অর্কদ্বীপ গোস্বামীকে। আয়রনির জায়গাটা হলো, রাজ্যে যখন এই ব্যাপক ধরপাকড় নেমে এল গণআন্দোলনের কর্মীদের ওপর, তখন না রোদ্দুর রায়, না তাঁর সমর্থকদের, কাউকেই দেখা গেল না এই নিয়ে একটা শব্দ খরচ করতে। আজ যে বাকস্বাধীনতা সংকটে বলে তাঁরা দুশ্চিন্তা প্রকাশ করছেন, তাঁদের বোঝা উচিত ছিল যে এই সংকট আজ তৈরি হয়নি। ওপরে উল্লেখ করা প্রতিটা কর্মী, বাংলার মাঠে-ঘাটে গণআন্দোলন করেছিল। জয়িতা দাস একজন দলিত পরিবারের নারী, হাসিবুর শেখ একজন ভূমিহীন কৃষক, টিপু সুলতান একজন সংখ্যালঘু পরিবারের ছেলে। আজ যে যে পরিচয়ের মানুষেরা দেশে ঘাড়ধাক্কা খাচ্ছে বিজেপি সরকারের হাতে, ঠিক সেই পরিচয়ের মানুষরাই এই রাজ্যেও আক্রান্ত হচ্ছে। এটাও সংকট। সেই সময়েও এই আওয়াজ তোলা জরুরি ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, সেই সময় এই আওয়াজ ওঠেনি।
রোদ্দুর রায় আজ যে প্রতিষ্ঠানের বুকে আঘাত হানতে চাইছে, সেই প্রতিষ্ঠান চালায় দেশের উচ্চবর্ণীয় ভদ্রবিত্ত বাবুরা। আর আজ যে বাঙালি সমাজ রোদ্দুর রায়ের সমর্থনে আওয়াজ তুলছে, দেখা যাবে তাদের অধিকাংশ-ও ওই একই বাবু ভদ্রবিত্তের গণ্ডিতে আবদ্ধ। যারা পিঠ বাঁচিয়ে আওয়াজ তুলতে ভালবাসে। রোদ্দুর রায় অতি অবশ্যই এই প্রতিষ্ঠানগুলির বুকে আঁচড় বসাতে পেরেছিল। রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে বাঙালি বাবুসমাজের রক্ষণশীলতার মাটি টলমল হয়েছিল। নিশ্চয়ই হয়েছিল। তবে রোদ্দুর রায়ের আগেও এমন আঘাত কম হয়নি। হয়তো সেই আঘাত আরও জোরালো ছিল। যা সমাজে থেকে গেছে। এখানে মনে করিয়ে দি, দেবব্রত বিশ্বাস এবং বিশ্বভারতীর দ্বন্দ্বের সেই কাহিনি। যা আমরা রোদ্দুরাক্রান্ত বাঙালিরা হয়তো ভুলতে বসেছি। দেবব্রত বিশ্বাসের সেই আঘাত কি রবীন্দ্রনাথকে প্রতিষ্ঠান বানানোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ছিল না? সেই প্রতিরোধের ফলই কি আজ আমরা কুড়োচ্ছি না?
শুরুতেই একবার নৈরাজ্যবাদের প্রসঙ্গ এনেছিলাম। ঐতিহাসিকভাবে নৈরাজ্যবাদী বলতে আমরা যে সমস্ত সংগঠনগুলিকে বুঝেছি, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পাশ্চাত্যের 'অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট ফ্রন্ট' অথবা 'অ্যান্টি ফা'। তার-ও আগে বলশেভিক বিপ্লবের প্রাক পরিস্থিতিতে সেখানকার একটি দল, নারোদনিকদের কথা আমরা শুনেছি। এদের প্রত্যেকের কার্যকলাপ খেয়াল করলে দেখব, তারা অনেকটাই অ্যাকশনভিত্তিক। অর্থাৎ, প্রতিপক্ষকে সরাসরি ময়দানে নেমে আক্রমণ করায় তারা বিশ্বাসী। ইংরেজিতে যাকে আমরা ডিরেক্ট অ্যাকশন বলে থাকি, সেই পদ্ধতিতেই এই সংগঠনগুলিকে কাজ করতে দেখা যেত বা যায়। তবে রোদ্দুর রায়কে দেখা গেল খানিক ভিন্ন প্রক্রিয়া নিতে। সে তাঁর শিক্ষিত ভদ্রবিত্ত ভক্তকুলকে নিয়ে তাঁর প্রতিরোধ চালাতে থাকল ফেসবুক-ইউটিউবে। অর্থাৎ তাঁর প্রতিরোধের ময়দান হয়ে উঠল সোশ্যাল মিডিয়া। ফলত, তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তাঁর ভক্তকুলকেও দেখা গেল ফেসবুককেই প্রতিরোধের মাটি হিসেবে বেছে নিতে। যা ভয়ংকর। যা ভয়াবহ।
আজ পৃথিবীজুড়ে বামপন্থী শিবিরে ভাটা। তার জন্য অধিকাংশ দায় যেমন বিপ্লবী বামপন্থী শক্তিগুলির, ঠিক তেমনই দায় এই সোশ্যাল মিডিয়ারও। অধিকাংশ মানুষকে দেখা যায় তাঁদের রাগ-অভিমান সরাসরি এই সোশ্যাল মিডিয়ার ওয়ালে উগরে দিতে। রাস্তার আন্দোলনের বদলে তারা অনায়াসে বেছে নিয়েছে ফেসবুকের দেওয়ালকে। আর এই পরিস্থিতিতে রোদ্দুরের ছোঁয়া তাদের যেন আরও খানিক আলসে এবং আন্দোলনবিমুখ করে তুলেছে।
রোদ্দুর রায়ের প্রতিবাদী আইকন হয়ে ওঠায় আরও একটা কথা বোঝা গেল, তা হলো বাঙালি মধ্যবিত্ত বামেদের আইকন সংকট। বাঙালি মধ্যবিত্ত বামেরা আজন্ম আইকন খুঁজে এসেছে। কখনও তা কানহাইয়া কুমার তো কখনও রোদ্দুর রায়। শেষ ক'বছরে তেমন জোরদার, আকর্ষণীয় আইকন না আসায় নিরুপায় বাঙালি রোদ্দুর রায়কেই বেছে নিয়েছেন।
রোদ্দুর রায়ের এই গ্রেফতার আমাদের মতো নয়া উদারবাদ পরবর্তী মধ্যবিত্ত বাঙালি প্রজন্মকে বুঝতে আরও সাহায্য করল। আমাদের প্রতিবাদ সিলেক্টিভ। আমাদের প্রতিবাদ গ্ল্যামারভিত্তিক। আমাদের প্রতিবাদ আইকনকেন্দ্রিক।
(মতামত লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত)