শ্রমিকের কান্নায় ভেজা স্টেডিয়ামের মাটি, কাতার বিশ্বকাপ দাসব্যবস্থার স্মৃতি ফেরাবে
কেন এই বিশ্বকাপ বয়কট করবেন অনেকে আর কেনই বা কেউ কেউ বলছেন যে এই বিশ্বকাপ আদতে ঘটাই উচিত নয়?
২০২২-এর কাতার বিশ্বকাপের মুখে দাঁড়িয়ে ফিফার অর্থলোভী স্বরূপ আরও নিরাবরণভাবে প্রকট হলো। বিশ্ব ফুটবলের গভর্নিং বডি তাদের সবচেয়ে গ্ল্যামারাস প্রতিযোগিতা আয়োজন করবার ভার দিয়েছে কঠোরভাবে রাজতন্ত্র-শাসিত, কালো পেট্রোডলারে চালিত, সাধারণ মানবাধিকার উল্লঙ্ঘনকারী রাষ্ট্র কাতারকে, সেটাও বেশ মোটা টাকার বিনিময়ে। ফিফার ঘুষ নেওয়া কোনও নতুন ব্যাপার নয়। আয়োজক দেশের ঘৃণ্য শাসকের ক্ষমতার অপব্যবহারকে ধামাচাপা দিতে সাহায্য করার ব্যাপারেও তাদের উৎসাহ প্রশ্নাতীত। প্রায় সবক'টা বিশ্বকাপের ক্ষেত্রেই তাই আনন্দে মাততে হলে, অন্ধ থাকাই সুবিধেজনক। কারণ সব সত্য প্রকাশ পেলে, কাঁটা খচখচ করবেই। তবু, এই কাতার বিশ্বকাপ যেন কোথাও গিয়ে অন্য সব টুর্নামেন্টের চেয়ে ঢের বেশি ন্যক্কারজনক। হয়তো ফিফার কর্তাব্যক্তিদের ঘুষের কারণে হওয়া হাই-প্রোফাইল স্ক্যান্ডালের কারণে, বর্ধিত সোশ্যাল মিডিয়ার একটানা স্ক্রুটিনির জন্য আর এশীয় দেশ আয়োজক হওয়ার সুবাদে এবারের বিশ্বকাপের শোচনীয় পশ্চাৎপটের ওপর আলো পড়েছে অন্যান্যবারের চেয়ে অনেকটা বেশি। তবে ফুটবলের অন্ধকার দিক নিয়ে আলোচনার যে অভ্যেস এই টুর্নামেন্ট তৈরি করে দিয়ে যাচ্ছে, তাতে ফুটবলকে ঘিরে তৈরি হওয়া বাস্তুতন্ত্রর লাভই হবে আখেরে।
আসুন দেখে নিই, কেন ফুটবল বিশ্বকাপের দ্বাবিংশ সংস্করণ ঘিরে গড়ে উঠেছে এত বিতর্ক, তাহলে হয়তো বুঝতে সুবিধে হবে কেন এই বিশ্বকাপ বয়কট করবেন অনেকে আর কেনই বা কেউ কেউ বলছেন যে এই বিশ্বকাপ আদতে ঘটাই উচিত নয়।
অভিবাসী শ্রমিকদের শোষণ ও নিপীড়ন
গাল্ফ স্টেটগুলোর এক অতি-সমালোচিত লেবার পলিসি হলো কাফালা সিস্টেম। এই প্রক্রিয়ায় প্রত্যেক অভিবাসী শ্রমিকের একজন কাতার-নিবাসী 'স্পনসর' থাকে, যিনি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই হন সেই শ্রমিকের মনিব। একজন অভিবাসী শ্রমিকের সমস্ত আইনি অধিকার এবং ভিসার দায়িত্ব বর্তায় এই স্পন্সরের ওপরেই। এর ফলে অনেকগুণে সহজ হয়ে যায় গরিব মানুষগুলোর ওপর অত্যাচার করা। এমনিতেই কাতারে যেহেতু একজিট ভিসার ব্যবস্থা রয়েছে, ভিসা কেড়ে নিলে, কেউই স্বদেশে ফিরতে পারবে না। তাছাড়া নানারকম আইনি প্যাঁচে শ্রমিকদের জড়িয়ে ফেলে তাদের প্রাপ্য টাকার থেকে বঞ্চিত করা বেশ সহজ এই স্পনসরদের পক্ষে। শ্রমিকের ওপর সর্বময় কর্তৃত্বের এই ব্যবস্থা যেন এক আধুনিক দাসপ্রথা। স্পনসরদের নো অবজেকশন সার্টিফিকেট ছাড়া শ্রমিকদের কাজ বা মনিব পাল্টানোর কোনও সুযোগ নেই। মরুভূমির প্রচণ্ড গরমে, দিনে যতক্ষণ খুশি শ্রমিকদের নামমাত্র পারিশ্রমিকে খাটিয়ে নেওয়ার এ এক দুর্দান্ত প্রক্রিয়া। তার ওপর আবার শ্রমিকদের বাসস্থানের ব্যবস্থাও খুবই অমানবিক। ছোট ছোট ঘরে মুরগির খাঁচার মতো ভিড় করে কোনওমতে দিনের শেষে শোওয়ার জায়গাটুকু তাদেরকে দেওয়া হয়। সেই বাসস্থানের ভাড়া হিসেবে আবার কেটে নেওয়া হয় বেশ কিছুটা টাকা, অনেক ক্ষেত্রেই যা আদতে মাইনের অধিকাংশটাই। লিভিং কন্ডিশনসের মতো ওয়ার্কিং কন্ডিশনসও এতটাই কষ্টকর যে, প্রচুর অভিবাসী শ্রমিকের মৃত্যু পর্যন্ত হয়েছে। কাতার সরকার মেডিক্যাল সার্টিফিকেটে নানারকম ওজর তুলে, হিট স্ট্রোক এবং অন্যান্য উপসর্গের কথা চাপা দিয়ে নিজেদের হাত ধুয়ে ফেলতে চেয়েছে।
আরও পড়ুন: মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল খেলার ঐতিহ্য ধূলিসাৎ করল আইএসএল? যে প্রশ্ন তুলতেই হবে এবার
আন্তর্জাতিক মিডিয়ার চাপে কাতারকে কাফালা সিস্টেম খাতায় কলমে তুলে দিতে হয়েছে ঠিকই, কিন্তু অন্দরে ঢুঁ মারলে ঠিকই বোঝা যায় যে, আদত পরিস্থিতি আসলে প্রায় কিছুই পাল্টায়নি। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ তুলেছে যে, কাতার অনেক ক্ষেত্রে শ্রমিকদের বেগার খাটিয়েছে, অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর জায়গায় থাকতে দিয়েছে, সময়মতো মাইনে দেয়নি, এবং পাসপোর্ট আত্মসাৎ করে রেখেছে। কাতারকে বিশ্বকাপের দায়িত্ব দেবার পরের দশ বছরে সাড়ে ছয় হাজারেরও বেশি অভিবাসী শ্রমিকদের প্রাণ গেছে। এঁদের সবাই ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ। এবং এই শ্রমিকদের সিংহভাগই যুক্ত ছিলেন অত্যন্ত শ্রমসাপেক্ষ নানান কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কে। মাঝে মাঝে মনে হয়, যে বিশ্বকাপ হোস্ট করতে তড়িঘড়ি আটটা ঝাঁ চকচকে স্টেডিয়াম প্রস্তুত করতে হয়েছে, সঙ্গে যুক্ত করতে হয়েছে প্রয়োজনীয় ইনফ্রাস্ট্রাকচার, সেই বিশ্বকাপের গায়ে শ্রমিকের রক্ত না লেগে থাকাটাই তো আশ্চর্যের ব্যাপার হতো।
সমকামিতার বিষয়ে কাতারের অবস্থান এবং নারী অধিকার
কাতারে সমকামিতা ঘোরতরভাবে নিষিদ্ধ। পৃথিবীর সেই দশটা দেশের মধ্যে কাতার একটা, যেখানে সমকামিতা খাতায়-কলমে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত ডেকে আনতে পারে। এমনকী, সমকামিতার সপক্ষে আওয়াজ তোলাটাও কাতারে গুরুতর অপরাধ। কাতার বিশ্বকাপের সময়ে সে-দেশে এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের মানুষদের আলাদা করে চিহ্নিত করার জন্য স্ক্রিনিং টেস্টের কথাও একটা পর্যায়ে শোনা গিয়েছিল। ফিফা অবশ্য প্রাইড ফ্ল্যাগের ওপর কোনও বিধিনিষেধ আনেনি, এবং বোঝানোর চেষ্টা করেছে যে, তারা বৈষম্য মেনে নেবে না, কিন্তু ফিফার এককালীন শীর্ষ কর্তার সেই কুখ্যাত উক্তি মনে পড়ে যায়– সাংবাদিকের উদ্বিগ্ন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, কাতারে সমকামী মানুষেরা ওই ক'টা দিন নাহয় ব্রহ্মচর্য পালন করবেন। তাছাড়া এই বছরেরই এপ্রিলে কাতারের এক সিকিউরিটি অফিসিয়াল জানিয়েছেন যে, মাঠে প্রাইড ফ্ল্যাগ কেড়ে নেওয়ার একটা প্ল্যান করা হয়েছে, যাতে সমকামিতা-বিরোধী দর্শকদের টার্গেট না হয়ে যেতে হয় এলজিবিটিকিউ-র সমর্থকদের। হাস্যকর যুক্তি, সন্দেহ নেই।
নারী অধিকারের অবস্থাও কাতারে লজ্জাজনক। গোঁড়া কানুন মেনে সেখানে মহিলাদের নিজস্ব সিদ্ধান্তকে সম্মান দেবার বিশেষ রেওয়াজ নেই। মহিলাদের পুরুষ অভিভাবকই সর্বেসর্বা। কাতারে গার্হস্থ হিংসার বিরুদ্ধে কোনও আইন নেই। মহিলাদের পোশাকও পরতে হয় কঠোর পিতৃতান্ত্রিক গাইডলাইন মেনেই।
কাতারে সবরকম পাবলিক ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশন-এর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি জারি আগে থাকতেই করা আছে। বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে, কাতারে বিশ্বকাপের সময়ে কোনও দৈহিক সম্পর্ক-স্থাপন আইনবিরুদ্ধ হিসেবে ইতিমধ্যেই ঘোষিত হয়েছে। কোনওরকম অ্যালকোহলিক পানীয় পাবলিক স্পেসে গ্রহণ করা কাতারে পুরোপুরি বেআইনি। বিশ্বকাপের সময়ে সেই আইন কতটা শিথিল করা হয়, সেটাও দেখার বিষয়।
কাতার দেশটা ফ্রিডম অফ ওয়ার্ল্ড ইনডেক্সের একদম নিচের দিকে বিরাজমান। নাগরিক অধিকার, রাজনৈতিক স্বাধীনতা বা সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার অবস্থা সেখানে বড়ই করুণ। রিপোর্টারদের আক্রমণ করার ঘটনা আকছার ঘটে ওখানে, এমনকী, বিদেশি রিপোর্টাররাও রেহাই পান না। চারজন বিবিসি-র সাংবাদিক ২০১৫ সালে যখন অভিবাসী শ্রমিকদের ব্যাপারে রিপোর্ট করতে গিয়েছিলেন, তাঁদের কাতার বন্দি করেছিল।
শীতকালীন বিশ্বকাপ
বিশ্বকাপ ফুটবলের আদি যুগ থেকে জুন-জুলাইতেই বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয়ে এসেছে। ফুটবলের স্বাভাবিক লিগ ক্যালেন্ডার চিরকাল চলে এসেছে অগাস্ট থেকে এপ্রিল পর্যন্ত। সিজন ব্রেকেই হয় ইউরো, কোপা বা বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্ট। কিন্তু উত্তর গোলার্ধের গ্রীষ্মে, কাতারের তাপমান পঞ্চাশ ডিগ্রি ছুঁইছুঁই হয়ে যায় ওই সময়ে। সেই সময়ে বিশ্বকাপ আয়োজন করার কথাই প্রাথমিকভাবে ভেবেছিল ফিফা। তবে সেই পরিকল্পনা কার্যকর করতে যে স্তরের শীতাতপনিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হতো স্টেডিয়াম থেকে শুরু করে সর্বত্র, সেটা নিশ্চিত করা একপ্রকার অসম্ভব। তাই এইবার বিশ্বকাপ হচ্ছে নভেম্বর-ডিসেম্বরে। অর্থাৎ, লিগ সিজনকে হ্যাঁচকা টানে থামিয়ে বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হবে। স্বাভাবিক লিগ ফুটবল ক্যালেন্ডার এমনিতেই ভর্তি হয়ে থাকে লিগ আর কাপের নানা ম্যাচের চাপে, তারই মধ্যে এবার একমাসজুড়ে হবে বিশ্বকাপ। কাজেই লিগ ক্যালেন্ডারের চাপ বাকি সময়টায় আরও বাড়বে ওই সময়কার খেলাগুলোকে জায়গা দিতে গিয়ে। যে খেলোয়াড়দের আমরা হাইলি-পেড রোবটের বেশি কিছু আজকাল ভাবতে পারি না, তাদের চোট-আঘাত পাবার সম্ভাবনা আরও বাড়বে।
বড়দিনের আগের হপ্তায় ফাইনাল খেলে উঠে, ক্লান্ত দেহমনকে টেনে নিয়ে একপক্ষকালের মধ্যেই সাধারণ লিগ ক্যামপেন শুরু করতে বাধ্য হবেন অনেক খেলোয়াড়। বিশ্বকাপের ক্লাইম্যাকটিক গুরুত্বের হানি তো হবেই, তার পাশাপাশি, মানসিকভাবে রিচার্জড হয়ে সাপ্তাহিক লিগ টেবিলের যুদ্ধ ফের নিয়োজিত হতে নিজেদেরকে মোটিভেট করে যেতে হবে খেলোয়াড়দের। সেটার মনস্তাত্বিক চাপ মারাত্মক।
এছাড়াও ফিফার ঘুষের ক্ষেত্র তো রয়েছেই। এই বিশ্বকাপের খরচ আগের সব বিশ্বকাপের চেয়ে বেশ খানিকটা বেশি। সেই বিরাট টাকার পরিমাণ দেখলে অনেকরকম সন্দেহই হয়। তাছাড়া খেলোয়াড়দের সুরক্ষা নিয়ে নানা প্রশ্নও উঠেছে এই বিশ্বকাপের বিল্ড-আপে।
তবু, বিশ্বকাপ দিনের শেষে এক আন্তর্জাতিক মহামিলনমেলা। পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত খেলার সবচেয়ে বড় মঞ্চ। হাজার বিতর্ক হলেও, এত মানুষ এক জায়গায় মিশলে গঠনমূলক কিছু না কিছু ঠিকই গড়ে ওঠে। ২০২১ সালের ইউরো-তে আমরা দেখেছি, ইউরোপজুড়ে কীভাবে প্রো-এলজিবিটিকিউ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল হাঙ্গেরির রাষ্ট্রীয় নীতির বিরোধিতার সূত্র ধরে। বিশ্বকাপেও যে তেমন কিছু অপেক্ষা করে নেই, সেকথা কে বলতে পারে!