আন্দোলনের জের না উপরমহলের চাপ? কেন পদত্যাগ আরজি করের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের?
R G Kar Rape Case: সোমবার পদত্যাগ করেছেন সন্দীপ ঘোষ! বলেছেন, ‘নৈতিক দায়িত্ব’-এর কারণেই পদত্যাগ করেছেন তিনি।
একা মেয়ে রাতে ওভাবে ঘুরে বেড়াবে কেন, সেই নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। তাঁরই হাসপাতালের এক তরুণী চিকিৎসককে ধর্ষণ করা হলো, খুন করে দেওয়া হলো, অথচ এত বড় ঘটনার পরেও মৃতাকেই দোষ দিয়েছিলেন তিনি। সারা বাংলা জুড়ে ওই তরুণী চিকিৎসকের মৃত্যুর বিচারের দাবি উঠেছে। দাবি ওঠে আরজি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের পদত্যাগেরও। অবশেষে সোমবার পদত্যাগ করেছেন সন্দীপ ঘোষ! বলেছেন, ‘নৈতিক দায়িত্ব’-এর কারণেই পদত্যাগ করেছেন তিনি। কারও চাপে নয়, স্বেচ্ছায় নাকি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আর জি কর হাসপাতালে অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ। সন্দীপ বলেছেন, “আর অপমানিত হতে পারছি না। লাঞ্ছনা সহ্য করতে পারছি না।”
সোমবার সকালেই ইস্তফাপত্র নিয়ে স্বাস্থ্যভবনে পৌঁছে যান সন্দীপ। তার আগে আরজি কর হাসপাতালের বাইরে দাঁড়িয়ে, সন্দীপ ঘোষ বলেছেন, “ঘটনার পর ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা পৌঁছে যান ঘটনার ২ ঘণ্টার মধ্যে। পুলিশও পৌঁছে যায়। সিপিও আসেন। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আন্ডারে সব কিছুই কমপ্লিট হয়ে যায় খুবই অল্প সময়ের মধ্যে। সে রকম যদি হতো, আমার হাসপাতালের সিসিটিভি ফুটেজ ১ ঘণ্টার মধ্যে আমি পুলিশকে হ্যান্ডওভার করতাম না। অনেক ক্ষেত্রে দোষীদের ধরতেই পুলিশের অনেক সময় লেগে যায়। এক্ষেত্রে কিন্তু বেশি সময় লাগেনি। ১ জনকে অন্তত ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ধরে ফেলেছে।” নিজের এই সাফাই কেন দিতে হলো সন্দীপকে? কারণ তিনি অভিযোগ তুলেছিলেন মৃতা তরুণীর দিকেই! অথচ চরম অস্বীকার করেছেন সেই কথা। অধ্যক্ষ সন্দীপ বলছেন, একা মেয়ে কেন রাতে ঘুরছিল জাতীয় কথা তিনি বলেননি, তাঁর মুখে ওই কথা বসিয়ে নাকি অপপ্রচার হয়েছে।
আরও পড়ুন- বিশ্রাম নিতে কেন সেমিনার রুমে যেতে হয়েছিল আরজি করের চিকিৎসককে?
তবে পদত্যাগের আগে নিজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হওয়ার সন্দেহ উস্কে দিয়ে গেছেন সন্দীপ। বলেছেন, তাঁকে তাড়াতে ছাত্র আন্দোলনে উস্কানি দেওয়া হয়েছে! বলেছেন, "ডাক্তারদের মধ্যেও চোর, ডাকাত রয়েছে। আমি অর্থোপেডিক সার্জেন। আমি খেটে খেতে পারব। সকলে ভেবেছিল সন্দীপ ঘোষ পদত্যাগ করতে পারেন না। আমি সৎ ব্যক্তি। আরজি করের দায়িত্ব নেওয়ার পর অনেকের টাকা খাওয়া বন্ধ করেছিলাম। আগে হাসপাতাল থেকে ডেথ বা বার্থ সার্টিফিকেটের জন্য আগে পয়সা দিতে হতো। আমি এসব বন্ধ করেছি। এখন আর দিতে হয় না। যতদূর পেরেছি হাসপাতালের উন্নয়নে, রোগীদের স্বার্থে করেছি।” নিজের অবস্থানে ১৮০ ডিগ্রি পালটি খেয়ে সন্দীপ বলেছেন, "যে কুকুর, জানোয়াররা তরুণী চিকিৎসককে ছিঁড়ে খেয়েছে শাস্তি পাক। আমার বদনাম করা হয়েছে। রটানো হয়েছে আমি নাকি বলেছি তরুণী চিকিৎসক আত্মহত্যা করেছেন, কেন একা ছিলেন? এসব আমি বলিনি। অপপ্রচার হয়েছে। আমার মুখে কথা বসিয়ে রাজনৈতিক খেলা চলছে।” কাদের রাজনৈতিক 'খেলা'-র শিকার সন্দীপ?
নিজেকে সৎ বলে দাবি করা সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে কিন্তু একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও মৃত্যুর পর তাই তাঁর বিরুদ্ধে জমে থাকা ক্ষোভ আরও ফেটে বেরিয়ে আসে। হাসপাতালের গোপন সূত্র বলছে, চিকিৎসার সরঞ্জাম কেনার টাকারও ভাগ যেত সন্দীপ ঘোষের কাছে। তাছাড়া জরুরি সরঞ্জাম কেনায় অবহেলা, চুক্তিভিত্তিক কর্মী নিয়োগ, হাসপাতাল পরিকাঠামো সংক্রান্ত বিষয়ে গাফিলতিতে ব্যাপক দুর্নীতির মাথা সন্দীপ। আরজি করের প্রাক্তন নন মেডিক্যাল ডেপুটি সুপার আখতার আলি অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বিরুদ্ধে টাকা নিয়ে বদলির অভিযোগ তুলেছিলেন। বায়ো মেডিক্যাল ওয়েস্ট এবং মধ্যরাতে ডিউটি বদল নিয়েও তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল। সন্দীপ ঘোষের বদলির দাবি উঠেছে আগে, তখন স্বাস্থ্যভবন বদলির নির্দেশও জারি করে। তারপরেও তিনিই থেকে যান অধ্যক্ষের পদে। তখন যদি রাজনৈতিক লাভের অঙ্ক না থেকে থাকে, এখন কীভাবে রাজনৈতিক খেলার গন্ধ পাচ্ছেন সন্দীপ?
২০২৩ সালের মে মাসে আরজি কর হাসপাতালের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের বদলির নির্দেশ জারি হয়। তাঁকে মুর্শিদাবাদের মেডিক্যাল কলেজের অস্থি রোগ বিভাগের প্রফেসর পদে বদলি করা হয়। আরজি করে তাঁর জায়গায় আসেন উলুবেড়িয়ার শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ সনৎ ঘোষ। সন্দীপ ঘোষ না থাকায় স্বাস্থ্য ভবনে ই-মেল করে জয়েনিং রিপোর্ট দেন তিনি। এর ৪৮ ঘণ্টা পরেই সন্দীপ ঘোষের বদলির নির্দেশিকা বাতিল করে আবার তাঁকে আরজি করে ফেরানো হয়। পাঁচ মাস পর আবার সন্দীপ ঘোষের বদলির নির্দেশ জারি হয়। বারাসাত মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ মানস বন্দ্যোপাধ্যায়কে আরজি করে যোগ দিতে বাধা দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য ভবনের নির্দেশে মানস কাজে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর আবার সন্দীপই দায়িত্বে এলেন কীভাবে?
আরও পড়ুন- মৃতকেই দুষেছিলেন, আরজি করের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ আসলে কে?
এবার হাসপাতালের মধ্যে ধর্ষণ ও খুনের মতো ঘটনায় সারা বাংলাজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। কর্মবিরতি, আন্দোলনের মধ্যে আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে সন্দীপ ঘোষকে যে বদলি করে দেওয়া হতে পারে এমন সম্ভাবনা ছিলই। শোনা যাচ্ছিল, এবার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের দায়িত্বে যাচ্ছেন তিনি। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই নিজের পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন সন্দীপ ঘোষ। সন্দীপ ঘোষের যা দাপট, এত দুর্নীতির অভিযোগ, বদলির নির্দেশিকাকে তুড়িতে উড়িয়ে তিনি যেভাবে গদি আঁকড়েছিলেন তাতে এটুকু স্পষ্ট আন্দোলনের জেরে তিনি পদত্যাগ করেননি। তাহলে কি উপরমহলের চাপ? এতকাল পরে সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী কি হস্তক্ষেপ করলেন?
শোনা যাচ্ছে, সন্দীপ ঘোষকে পার্ক সার্কাস ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ করা হতে পারে৷ তাঁর জায়গায় আর জি করের নতুন অধ্যক্ষ পদে নিয়ে আসা হতে পারে বর্তমানে স্বাস্থ্য ভবনের ওএসডি, স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তন উপাচার্য ডাঃ সুহৃতা পালকে। বর্তমানে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ডাঃ অজয় রায়কে স্বাস্থ্য ভবনের ওএসডি করা হতে পারে৷