পায়ের নখ উপড়ে, চুল-দাড়ি ছিঁড়ে রবীন্দ্রনাথকে 'শ্রদ্ধা' জানিয়েছিল বাঙালি— লজ্জার বাইশে শ্রাবণ

আজ বাইশে শ্রাবণ পুজোর পর্যায়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মৃতদেহ ভিড়ের কদর্যতা এড়াতে পারেনি। শেষযাত্রায় যা হয়েছিল, তা ভয়াবহ।

আমার শ্রাদ্ধ যেন ছাতিম গাছের তলায় বিনা আড়ম্বরে বিনা জনতায় হয়— শান্তিনিকেতনের শালবনের মধ্যে আমার স্মরণসভা মর্মরিত হবে, মঞ্জরিত হবে, যেখানে যেখানে আমার ভালোবাসা আছে, সেই সেইখানেই আমার নাম থাকবে।

লিখছেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩০ সালের ২৫ অক্টোবর ইন্দিরা দেবীকে লেখা একটি চিঠিতে। ভিড় তাঁর পছন্দ ছিল না। তিনি জানতেন উন্মত্ত জনতার মতো হিংস্র বস্তু পাওয়া ভার। এবং চেতনাহীন উন্মাদনা কেবলই কদর্যতার ছাপ রাখে। কলকাতা থেকে বহু দূরে নিজের শান্তির নীড় গড়েছিলেন ধার-দেনা করে। শেষ জীবনে গাছ লাগানোর একটা নেশা হয়েছিল। প্রকৃতির কোলে আশ্রয় খুঁজছেন স্বেচ্ছা-নির্বাসনে।

অথচ রাজনীতিবোধ যথাযথ। 'সভ্যতার সংকট'-এর মতো প্রবন্ধ লেখা হচ্ছে এই সময়েই। রাশিয়ার দিকে অশেষ আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন। পশ্চিমের ওপর হতাশ, ক্রুদ্ধ। ভিড় ছেড়েছিলেন স্বদেশি আন্দোলনের সময়েই। নিজের পছন্দমতো শান্তিনিকেতন সাজিয়ে নিয়েছিলেন। ইচ্ছে ছিল, সেই ধুলোতেই মিশে যাওয়ার। সেই লাল মাটির অর্ঘ‍্যের থেকে বেশি তাঁর চাওয়ার কিছু ছিল না। অথচ জনপ্রিয় হওয়ার কিছু মাশুল রয়েছে। শান্তিনিকেতনে মৃত্যু হলো না কবির। হলো জোড়াসাঁকোর মহর্ষি ভবনের ঘরটিতে। পরের দিন আনন্দবাজার ছেপেছিল, "কবির বর্তমান অসুস্থতার বহুপূর্বে কবি নাকি এইরূপ ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছিলেন যে তাঁহার অন্তেষ্টিক্রিয়া যেন তাঁহার প্রিয় আবাস শান্তিনিকেতনে সম্পন্ন করা হয়।" সে ইচ্ছেও অপূর্ণ থেকে গেছে।

আজ বাইশে শ্রাবণ পুজোর পর্যায়ে চলে গিয়েছে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মৃতদেহ ভিড়ের কদর্যতা এড়াতে পারেনি। শেষযাত্রায় যা হয়েছিল, তা ভয়াবহ।

নির্মলকুমারী মহলানবিশ সে ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন,

যখন স্নান করানো হচ্ছে, নীচের জনতার মধ্যে একদল উপরে এসে বাইরে থেকে টান মেরে দরজার ছিটকিনি খুলে ঘরে ঢুকে পড়ল। কী দারুণ অপমান কবির চৈতন্যহারা এই দেহটার! যে মানুষের মন এত স্পর্শকাতর ছিল, যে বাইরের লোকের সামনে নিজের ব্যক্তিগত প্রয়োজনের কথা কখনও প্রকাশ করতে পারতেন না, সেই মানুষের আত্মাহীন দেহখানা অসহায় ভাবে কৌতুহলী দৃষ্টির সামনে পড়ে রইল। তাড়াতাড়ি তাঁকে ঢাকা দিয়ে সুরেনবাবুরা সবাইকে ঠেলে বাইরে বের করে দিয়ে আবার দরজা বন্ধ করলেন। এক একটা দরজায় এক-একজন পাহারা। ভিতর থেকে দরজায় ছিটকিনি সত্ত্বেও হাত দিয়ে ঠেলে রাখা হয়েছে। তবু বাইরে থেকে প্রাণপণ ঝাঁকানি আর উন্মত্ত চিৎকার—দরজা খুলে দিন, আমরা দেখব। তাড়াতাড়ি করে আমরা কাপড় পরানো শেষ করলাম…বেলা তিনটের সময় একদল অচেনা লোক ঘরের মধ্যে ঢুকে নিমেষে আমাদের সামনে থেকে সেই বরবেশে সজ্জিত দেহ তুলে নিয়ে চলে গেল। যেখানে বসেছিলাম সেখানে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। শুধু কানে আসতে লাগল- 'জয় বিশ্বকবির জয়, জয় রবীন্দ্রনাথের জয়, বন্দেমাতরম।'

শুনলে মনে হয় কোনও হরর মুভির চিত্রনাট্য। রবীন্দ্রনাথ নয়, ওই নামের উন্মাদনা উদযাপনই এই ভিড়ের লক্ষ্য। উন্মত্ত জনতার সামনে বাড়ির ভেতরের মানুষগুলো কী পরিমাণ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল, তাও সহজে অনুমান করা যায়। অথচ বারংবার কবি প্রিয়জনদের অনুরোধ করেছিলেন, এমনটা যেন না হয়। কখনও ইন্দিরা দেবী, কখনও নির্মলকুমার— বৃদ্ধ কবি শেষযাত্রায় শান্তি প্রার্থনা করেছেন সবার কাছেই। জনস্রোতে সেইসব কোথায় ভেসে গিয়েছে। নির্মলকুমারীকেও বলেছিলেন, "তুমি যদি সত্যি আমার বন্ধু হও, তাহলে দেখো আমার যেন কলতার উন্মত্ত কোলাহলের মধ্যে, 'জয় বিশ্বকবির জয়', 'জয় রবীন্দ্রনাথের জয়', 'বন্দেমাতরম'— এইরকম জয়ধ্বনির মধ্যে সমাপ্তি না ঘটে।" কবির আশঙ্কা এইভাবে সত্যি হতে দেখে প্রিয়জনরা বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন। অথচ অসহায়, ক্ষমতাহীন। ভিড়ের সিদ্ধান্ত অতিক্রম করার ক্ষমতা কারও নেই। সজনীকান্ত লিখেছেন, "মৌলভী ফজলুল হক, স্যার সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র বসু প্রভৃতি প্রধানেরা সাড়ে বত্রিশ ভাজার মতো জনতার মধ্যে মিশাইয়া গিয়াছিলেন।"

মৃতদেহ বের করে নিয়ে যাওয়ার পরে আর কোনও উপায় থাকল না। কেউ স্মারক রাখার অছিলায় কবির পায়ের নখ উপড়ে নিল, চুল-দাড়ি ছিঁড়ে নিল কেউ। রানী চন্দর সঙ্গে রথীন্দ্রনাথ বাবার মুখাগ্নি করার জন্য বেরোলেন। রাজপথে ঢল নেমেছে। নিমতলা ঘাট থিকথিক করছে। পা ফেলার জায়গা নেই। বাড়ির মোটর সেই ভিড়ে একচুল এগোতে পারল না। নেমে পড়তে হলো তাঁদের। রাম অধিকারী দু'হাতে আগলে রথীন্দ্রনাথকে নিয়ে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করলেন। তাঁর যেমন চেহারা তেমনই গলা। চিৎকার করে ভিড়ের উদ্দেশ্যে বলছেন, আপনারা একটু পথ ছেড়ে দিন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছেলে রথীন্দ্রনাথ এসেছেন পিতার কাজ করতে— আপনারা একটু পথ দিন। আরও ভিড় বেড়ে যায় তাতে। সবাই রথীন্দ্রনাথকে দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ঘট অবধি পৌঁছতেই পারলেন না রথীন্দ্রনাথ। মুখাগ্নি করা হলো না তাঁর। বিকেল তিনটেয় শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল। শেষকৃত্য শুরু হল রাত আটটায়। কবির মুখাগ্নি করলেন তাঁর পৌত্র সুবীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর।

৩০ জুলাই ১৯৪১, জীবনের শেষ তিনটি পংক্তি রচনা করেন রবীন্দ্রনাথ।

অনায়াসে যে পেরেছে ছলনা সহিতে

সে পায় তোমার হাতে

শান্তির অক্ষয় অধিকার।

এপিটাফ। দাহ করার স্থানটিতে এই পংক্তিকয়টি বাঁধিয়ে রাখা আছে। ভাগ্যের পরিহাস। এই শ্মশানে বিন্দুমাত্রও শান্তি পায়নি রবীন্দ্রনাথের মৃতদেহ। বরং শান্তিনিকেতনের নিরালায় দিনের পর দিন যে গাছ লাগিয়েছেন, তাতে সার-জল পড়েছে। তাঁরা কখনও নিজ গুণে বিখ্যাত মানুষের নাম, কখনও বকুল ফুল। শান্তির আশ্রম থেকে দূরে কোলাহলের মধ্যে তাঁর বিন্দুমাত্রও অবশিষ্ট নেই। আছে কেবল ভড়ং, লোকদেখানো রবিপ্রেম তথা পূজার উন্মাদনা। যার দোহাই দিয়ে যা খুশি তাই চালানো যায়। সেই ভিড়, কোলাহল শান্তিনিকেতনকে পীঠ করে তুলেছে, করেছে সংস্কৃতি-বিলাসের কেন্দ্র। শেষ জীবনে এক অশক্ত বৃদ্ধ একটুখানি শান্তি চেয়েছিলেন, সেটুকু দিতে যে জাতির হাত সরে না, তাদের আর যাই হোক বাইশে শ্রাবণ উদযাপন মানায় না, বরং লজ্জার উত্তরাধিকার মানায়। মানায় নিজেদের উন্মাদনাকে বারংবার প্রশ্ন দিয়ে ক্ষতবিক্ষত করা।

More Articles