নির্বাচন জুড়ে বন্ধু-প্রীতি! মুখ্য নির্বাচন কমিশনারের পদ পেলেন কীভাবে রাজীব?

Election Commissioner Rajiv Kumar: সাংবাদিক বৈঠক না করার রেকর্ড থাকলেও, সাংবাদিক বৈঠকে তাঁর কবিতা পাঠ করার রীতি রয়েছে। রাজীব হামেশাই কবিতা শোনান দু'লাইন।

কে থাকল, কে গেল, পরিষ্কার হতে শুরু করেছে ইতিমধ্যেই। দেশজুড়ে ইন্ডিয়া জোটের ফলাফল অপ্রত্যাশিতভাবে উজ্জ্বল! সমস্ত এক্সিট পোলকে অবৈজ্ঞানিক প্রমাণ করে দিচ্ছে ইন্ডিয়া জোট। লোকসভা নির্বাচন আবহে বিরোধীরা নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছিলেন। বিরোধীরা দাবি করে এসেছেন, নির্বাচন কমিশন আর ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার নাকি বন্ধু। অভিযোগ ওঠে, নির্বাচন কমিশন বিজেপিরই শাখা সংগঠন। বিরোধীরা যুক্তি দেন, যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর ঘৃণাভাষণে ক্লিনচিট দিয়েছে কমিশন তাতে এই অভিযোগ ওঠারই কথা। এতে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমারও কাঠগড়ায় উঠেছেন। নির্বাচন শুরুর আগে রাজীব দেশের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জেড ক্যাটাগরির সুরক্ষা পেয়েছেন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সেই অনুমোদন করেছিল। রাতারাতি সুরক্ষা বলয়ের উন্নতির কারণ মন্ত্রক বিস্তারিত জানায়নি। নির্বাচনের শুরু থেকে শেষ, তাঁকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। এবার সোশ্যাল মিডিয়াতে 'লাপাতা জেন্টলম্যান' বলেও আখ্যা পেলেন রাজীব। যদিও তিনি সেই মিমের জবাব দিতে ছাড়েননি। তাঁর পাল্টা জবাব, "আমরা সর্বক্ষণ এখানেই ছিলাম। কখনও হারিয়ে যাইনি।" সাংবাদিক বৈঠকে তিনি দাবি করেছেন, এই নির্বাচনে ভোটদাতার সংখ্যা রেকর্ড গড়েছে। ৬৪.২% কোটি ভোটার লোকসভা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন। যদিও প্রতি দফায় ভোটার টার্ন আউট, দেরিতে তথ্য প্রকাশ, পরে তা বদলে দেওয়া নিয়েও অভিযোগ ওঠে। ইভিএম নিয়েও বারবার সন্দেহ প্রকাশ করছেন বিরোধীরা। রাজীব কুমার কি সত্যিই বিজেপির মিত্র? রাজীব কি সত্যিই ভোটের পরিসংখ্যানে কারচুপি করছেন?

মুখ্য নির্বাচন কমিশনার রাজীব কুমারের জন্ম ১৯৬০ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি। বিএসসি, এলএলবি, পিজিডিএম, পাবলিক পলিসি এবং সাস্টেনিবিলিটিতে স্নাতকোত্তর তিনি। রাজীব একজন আইএএস অফিসার ছিলেন। ২০২২ সালে অবসর নেন তিনি। ২০০৫ সালে তপশিলি জাতির বিল বিষয়ে তাঁর গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা ছিল বলে জানা যায়। রাজীব ২০১৭ সাল থেকে অর্থ মন্ত্রকের ব্যাঙ্ক পরিষেবা দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। ২০২০ সালের ১৫ মে, ২৫ তম মুখ্য নির্বাচন কমিশনার হন তিনি।

আরও পড়ুন- উত্তরপ্রদেশই উলটে গেল! কে গিলে ফেলল রাম মন্দিরের সাফল্য?

একদা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির 'জন ধন যোজনা', ছোট-মাঝারি শিল্পের জন্য ৫৯ মিনিটে ঋণ-সহ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের সমস্যা মেটানোর কাজকর্ম দেখাশোনা করেছিলেন রাজীব। মূলত অর্থ মন্ত্রকের পাঁচটি দফতরের সচিবদের মধ্যে প্রবীণতম অফিসারকেই অর্থসচিবের পদে বসানো হয়। সেই মতো রাজীব ও রাজস্ব সচিব অজয়ভূষণ পাণ্ডে দু'জনেই একই সময়ের। মোদি সেই সময় রাজীবকেই এগিয়ে রেখেছিলেন এবং অর্থসচিবের পদে বসিয়েছিলেন। একই সময় বাজেটে ডলার ঋণ দেওয়া নিয়ে বিতর্ক শুরু হলে অর্থসচিবের পদ থেকে সুভাষচন্দ্র গর্গকে সরিয়ে দেওয়া নিয়ে জোরালো সমালোচনা হয়েছিল। অতনু চক্রবর্তীকে বিলগ্নীকরণ দফতর থেকে আর্থিক বিষয়ক দফতরের দায়িত্বে আনা হয়েছিল। এই সকল কিছু নিয়েই জমাট বাঁধছিল বিতর্ক। ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণার পরই, বিরোধী দলগুলিকে দুর্বল করতে দলের প্রধান নেতৃত্বদের গ্রেফতার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলছিল ওয়াকিবহাল মহল। অন্যদিকে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে দেওয়ারও অভিযোগ ছিল। এই নিয়ে কোনও যাচাই করতে দেখা যায়নি রাজীবকে।

২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে কমিশন জানিয়েছিল, অবৈধ নগদ, মদ, মাদক, সোনা, জাল অর্থের উৎস বন্ধ এবং এই দুর্নীতির মূলে যারা রয়েছেন তাঁদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে। নতুন কিছুই নয়, দেশে প্রতিটি নির্বাচন হওয়ার আগে অবৈধ অর্থ উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন প্রক্রিয়া চালায় কমিশন। এই লোকসভা নির্বাচনের আগে একটি সাংবাদিক বৈঠকে রাজীব বলেছিলেন, "হিংসা এবং অর্থের প্রভাবের কোনও জায়গা নেই।" কিন্তু দেখা গেছে, বিশেষজ্ঞরা যেখানে ইলেক্টোরাল বন্ড দুর্নীতিকে দেশের সবচেয়ে বড় দুর্নীতি বলেছিলেন, সেই দুর্নীতির বিরোধিতায় তাঁর ভূমিকা ছিল না বললেই চলে। সাংবাদিক বৈঠক না করার রেকর্ড থাকলেও, সাংবাদিক বৈঠকে তাঁর কবিতা পাঠ করার রীতি রয়েছে। রাজীব হামেশাই কবিতা শোনান দু'লাইন। কখনও বলেন, "রহিমন ধাগা প্রেম কা, মত তোড়ো চটকায়ে, টুটে পে ফির না জুড়ে, জুড়ে গাঁঠ পড়ি জায়ে" (প্রেমের বন্ধন ভাঙলে আর জোড়া যায় না, জুড়লেও তাতে দাগ থেকে যায়)। কখনও আবার বলেন, "দুশমনি জম কে করো, লেকিন ইয়ে গুঞ্জায়িস রহে, জব কভি হাম দোস্ত হো যায়ে তো শর্মিন্দা না হো" (প্রবল শত্রুতা করো। কিন্তু পরে বন্ধুত্ব হলে যেন লজ্জা না পেতে হয়।)

আরও পড়ুন- শিবসেনা বনাম শিবসেনা! উদ্ববের দল ভাঙানোর পরে মহারাষ্ট্রে কত আসন পাবে এনডিএ?

ইভিএম কারচুপি অভিযোগ নিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে রাজীব বলেন, "পুরো গণনা প্রক্রিয়া পোক্ত। লক্ষ লক্ষ মানুষ, এজেন্ট, মাইক্রো অবজার্ভাররা তাঁদের কাজ করবেন তাই কোনও সংশয় থাকা উচিত নয়।" কিন্তু কমিশনের পূর্বের কার্যকলাপের পর বিরোধীরা যেন আর তাকে ভরসা করতে পারছে না। রাজীবের দাবি, ১১টি রাজ্যের গত বিধানসভা নির্বাচন নিরপেক্ষভাবেই হয়েছে। নির্বাচনে অবৈধ নগদ, জাল অর্থর উৎস রুখে দেওয়াই তাঁর মূল লক্ষ্য বলেই তিনি জানিয়ে থাকেন। কমিশন একটি পোর্টাল খুলেছে যেখানে সময় মতো আর্থিক হিসেব প্রকাশ করতে হয় দলগুলিকে। মুখে দাবি করে গেলেও তথ্য বলছে, পিএমও ফান্ড, ইলেক্টোরাল বন্ডের মতো গুরুতর আর্থিক দুর্নীতিতে শীর্ষে নাম রয়েছে শাসকগোষ্ঠীরই, যার বিরুদ্ধে তিনি কোনও পদক্ষেপই করেননি। দেশে ভোট বাড়াতে মদ, মাদক, নগদের অপব্যবহার হয়। ভোট শুরুর আগে তাতে রাশ টানার কথা ঘোষণা করেছিলেন রাজীব। তাঁর দাবি অনুযায়ী, দেশে বাজেয়াপ্ত হয়েছে ৮৮৮৯.৭৪ কোটি টাকা। প্রায় ৫.৪০ কোটি লিটার মদ এবং ৪,৩৯১ কোটি টাকার মাদক বাজেয়াপ্ত হয়েছে বলেও দাবি। যদিও বিশেষজ্ঞরা, দেশের পরিস্থিতি বুঝতে নির্দিষ্ট কোন অঞ্চলের মদ, মাদক, নগদ বাজেয়াপ্ত হয়েছে তার বিশদ তথ্যের দাবি করেছে, তবে সেই তথ্য আপাতত পেশ করেনি কমিশন।

প্রসঙ্গত, মানবধিকার দফতর, তথ্য কমিশন - স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবেই জনগণ জানে কিন্তু পর্যবেক্ষকদের দাবি, এই প্রতিষ্ঠান এবং পার্টি অফিসের কার্যকলাপের মধ্যে কোনও ফারাক আর নেই। রাজীব যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন, একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে বিরোধীরা যেই বিষয়গুলিকে ইস্যু করেছে সেই সূত্র ধরেই কথা বলেন। অভিযোগ ওঠে, যেন শাসকগোষ্ঠীরই এজেন্ট তিনি। এক বিশেষজ্ঞ বলেছিলেন, রেফারি যেন গোলকিপারের ভূমিকা পালন করছেন। এই সকল কিছুই মোদি আর রাজীবের মধ্যেকার গোপন বন্ধুপ্রীতির সম্পর্ককে আলোচনায় আনে। এই সকল তথ্যের পর বলা চলে, রাজীবের দুর্নীতি বিরোধী পদক্ষেপ যেন বালির বাঁধ। সেই সম্পর্কের থাবা কি ভোটগণনাতেও পড়বে তাই এখন দেখার।

More Articles