গোমাংস খাওয়ার অভিযোগ! বাংলার পরিযায়ী শ্রমিককে পিটিয়ে হত্যা! কী করছিল পুলিশ?

Migrant worker Sabir Malik lynched: অভিযুক্তরা খালি প্লাস্টিকের বোতল বিক্রির ভান করে সাবির মালিক এবং তাঁর বন্ধু আসিরুদ্দিনকে একটি দোকানে ডেকেছিল।

পশ্চিমবঙ্গের যুবক। কাজ করতে গিয়েছিলেন হরিয়ানায়। ধর্মে মুসলমান। খাদ্যাভ্যাসে গরুর মাংস খাওয়ার ইতিহাস আছে। গরু খাওয়ার সন্দেহে পিটিয়ে মারার নজির তো ভারতবর্ষ দেখেইছে। আকলাখের পর এবার পশ্চিমবঙ্গের সাবির! পরিযায়ী মুসলিম শ্রমিককে পিটিয়ে মারল গো রক্ষক গোষ্ঠী! গত ২৭ অগাস্ট ২২ বছরের সাবির মালিককে চরখি দাদরি জেলায় পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আবর্জনা কুড়িয়েই সংসার চালাতেন সাবির। হংসওয়াস খুর্দ গ্রামে স্ত্রী এবং দুই বছরের মেয়েকে নিয়ে ছিল তাঁর ছোট্ট পরিবার। সাবিরকে পিটিয়ে মারার ঘটনায় হরিয়ানা পুলিশ দুই কিশোর সহ সাতজনকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশ জানিয়েছে, অভিযুক্তদের সঙ্গে গো-রক্ষক গোষ্ঠীর সম্পর্ক রয়েছে, বিশদে তদন্ত চলছে।

পুলিশ জানাচ্ছে, সাবিরের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে, একদল যুবক গ্রামে পুলিশকে ডেকেছিল। এই যুবকরা দাবি করেছিল, ওই পরিবারে গরুর মাংস রান্না করে খাওয়া হচ্ছে। পুলিশ ওই মাংস বাজেয়াপ্ত করে তা পরীক্ষার জন্য পাঠালেও পুলিশের দাবি, অভিযুক্তরা আইন হাতে নিয়ে সাবিরকে পিটিয়ে হত্যা করে। সেই সময় অবশ্য পুলিশ কী করছিল সেই প্রশ্ন থেকেই যায়। সাবিরের আত্মীয়রা বলেছেন, ওই একই দিনে, তাদের থানায় ডেকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তারা গরুর মাংস খান কিনা।

আরও পড়ুন- Cow politics: গরু নিয়ে রাজনীতি, হত্যার পরিকল্পনা বারবার, একদিনে হয়নি…

পুলিশ জানাচ্ছে, অভিযুক্তদের নাম অভিষেক, মোহিত, কমলজিৎ, সাহিল এবং রবিন্দর। ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ ধীরাজ কুমারের বক্তব্য, “মঙ্গলবার ২৭ অগাস্ট, একদল যুবক হংসওয়াস খুর্দ গ্রামে কয়েকজন আবর্জনা কোড়ানো সাফাইকর্মীদের পাকড়াও করে। এই যুবকদের অভিযোগ, এই সাফাইকর্মীরা গরুর মাংস খাচ্ছিলেন। ওই একই গ্রামে থাকতেন সাবির। পুলিশকেও ঘটনাস্থলে ডাকা হয়েছিল। পুলিশ ওই গ্রামে গিয়ে তল্লাশির পরে ওইখানে ঝুপড়িতে বসবাসকারী কয়েকজন মানুষকে মাংস রান্না করে খেতে দেখেন। ফরেনসিক এবং ভেটেরিনারি বিশেষজ্ঞরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। মাংসগুলি বাজেয়াপ্তও করা হয় এটা দেখতে যে আসলে সেগুলি সত্যিই গরুর মাংস ছিল কিনা।" রিপোর্ট কিন্তু তখনও আসেনি। অথচ পুলিশের এই নমুনা বাজেয়াপ্ত করে পরীক্ষার জন্য পাঠানোর কয়েক ঘণ্টা পরেই অভিযুক্তরা সাবির মালিককে ধরে ফেলে এবং ভয়াবহভাবে পেটায়। গণপিটুনিতে সাবিরের মৃত্যু হয়। ওই এলাকায় বসবাসকারী বেশিরভাগ মানুষই ছিলেন পরিযায়ী শ্রমিক।

পুলিশ জানাচ্ছে, অভিযুক্তরা খালি প্লাস্টিকের বোতল বিক্রির ভান করে সাবির মালিক এবং তাঁর বন্ধু আসিরুদ্দিনকে একটি দোকানে ডেকেছিল। সেখানে তাঁদের দু'জনকেই মারধর করা হয় বলে অভিযোগ। আসিরউদ্দিন ঘটনাস্থল থেকে পালাতেও এই অভিযুক্তরা সাবির মালিককে একটি মোটরবাইকে করে অন্য জায়গায় নিয়ে যায় এবং সেখানে আবার পেটায়। ওইখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। পরে সাবির যেখানে থাকতেন সেই ঝুপড়ির কাছে তাঁর লাশ পাওয়া যায়।

অভিযোগকারী এবং সাবিরের শ্যালক সুরাজুদ্দিন সরকার ওই একই ঝুপড়িতে থাকেন। তিনি বলছেন, ২৭ অগাস্ট বিকেলে, তিনজন লোক এসে তাঁকে ডেকে বলেছিল যে, প্রচুর বাতিল জিনিস বিক্রির জন্য পড়ে আছে। সাবির তখন তার রিকশা ও ব্যাগ নিয়ে ওই লোকদের সঙ্গে চলে যায়। পরে স্থানীয় বাজার এলাকায় সাবিরের রিকশা পাওয়া যায়। "প্রথমে তাঁকে বাজারের কাছে মারধর করা হয়, তারপর দূরে একটি জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁকে আরও মারধর করা হয়। বিকেল পৌনে পাঁচটা নাগাদ একটি নালায় তাঁর লাশ পাওয়া যায়। এই দিনের আগে এক দুপুরে আমার বাবা এবং আমাকে স্থানীয় থানায় ডেকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে আমাদের কাছে গরুর মাংস আছে কিনা। আমরা স্পষ্টভাবে বলেছিলাম, আমরা রান্না করিনা এবং গরুর মাংস এখানে পাওয়াও যায় না। পরে আমার বোন আমাকে জানায় সাবির বেরিয়েছিল কিন্তু ফেরেনি। আমি পুলিশকে জানাই। পুলিশ তাঁর লাশ খুঁজে পায়,” বলেন সুরাজুদ্দিন সরকার।

“আমরা গত পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করেছি। অনেকেই এখানে আমাদের চিনতেন। আমি কখনই ভাবিনি আমাদের সঙ্গে এমনটা হবে। কারও সমস্যা হলে আমাদের বলা উচিত ছিল। আমরা চলে যেতাম। ওকে পিটিয়ে মেরে ফেলল কেন?” প্রশ্ন করেছেন সাবির।

আরও পড়ুন- গোমাংস রপ্তানিকারকদের থেকেও ইলেক্টোরাল বন্ডে কোটি কোটি টাকা! কে নিল?

পুলিশ বলছে, “আসামিদের আদালতে হাজির করে পুলিশের রিমান্ডে পাঠানো হয়েছে। হরিয়ানায় নির্বাচনের কারণে রাজ্যে আধাসামরিক বাহিনী মোতায়েন রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় আমরা চরখি দাদরির ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় পতাকা মিছিল করছি। এখানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক এবং শান্তি ভঙ্গ নেই,” বলেন ডিএসপি।

সাবির পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার মিয়ারভেরির বাসিন্দা। এমন বর্বর ঘটনায় তাঁর পরিবার হতবাক। সাবির গত পাঁচ বছর ধরে বাড়ি থেকে দূরে। প্রতি ছয়-সাত মাস অন্তর বাড়ি ফিরতেন তিনি। গত শুক্রবার নিজের গ্রামে সাবিরের শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। সুরাজুদ্দিন জানিয়েছেন, হরিয়ানা পুলিশ বলেছিল সাবিরের পরিবারকে হরিয়ানাতে নিয়ে আসা হোক কারণ তারা চেয়েছিল দেহটি সেখানেই কবর দেওয়া হোক। কিন্তু সুরাজুদ্দিন পুলিশকে অনুরোধ করেন যাতে পশ্চিমবঙ্গেই আত্মীয়দের কাছে দেহটি ফিরিয়ে দেওয়া হয়। সাবিরের কাকা বাবর আলি মল্লিকও জানান, সাবিরের দেহ ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের পুলিশের কাছে বারবার আবেদন করতে হয়েছে তাঁদের।

সাবিরের পরিবার জানিয়েছে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফোন করে সাবিরের আত্মীয়দের চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তৃণমূলের রাজ্যসভার সদস্য এবং পরযায়ী শ্রমিক কল্যাণ বোর্ডের (পশ্চিমবঙ্গ) চেয়ারপার্সন সামিরুল ইসলাম বলেছেন, "এ ভয়াবহ ঘটনা। আমরা পরিবারের পাশে আছি। আমাদের সরকার হরিয়ানা সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। বিভিন্ন রাজ্যে বাংলার পরিযায়ী শ্রমিকদের নিশানা করা হচ্ছে। সম্প্রতি ওড়িশাতেও তাদের মারধর করা হয়। আমরা সাবিরের বিচার চাই।”

More Articles