ক্যান্টিনে বাকি ২৩,৮০০ টাকা! চিকিৎসক বিরূপাক্ষ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আর কী কী অভিযোগ?

Birupaksha Biswas: বিরূপাক্ষকে বলতে শোনা যায়, "ঠিকঠাক ভাবে না থাকলে তোর রেজিস্ট্রেশন আটকে দেব। এটা আমার গ্যারান্টি।"

আরজি কর কাণ্ডের আবহে মেডিক্যাল কলেজগুলির 'থ্রেট কালচার'-এর ছবি ছড়িয়ে গিয়েছে। আরজি করের আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে। তাঁর বিরুদ্ধে আরজি করে 'দাদাগিরির' অভিযোগ ছিল। ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার গোড়া থেকেই সন্দীপ ঘোষের পাশাপাশিই আরও কিছুজনের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ উঠছিল। তাঁদের মধ্যেই ছিলেন বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের প্যাথোলজি বিভাগের সিনিয়র রেসিডেন্ট চিকিৎসক বিরূপাক্ষ বিশ্বাস। মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের কাছে বিরূপাক্ষ বিশ্বাস-সহ আরও কিছুজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিলেন চিকিৎসক-পড়ুয়ারা। অবশেষে চিকিৎসক বিরূপাক্ষ বিশ্বাসকে সাসপেন্ড করেছে স্বাস্থ্য ভবন। কে এই বিরূপাক্ষ বিশ্বাস? তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ কী কী?

স্বাস্থ্য ভবন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিরূপাক্ষের সাসপেন্ড হওয়ার কথা জানিয়েছে। বৃহস্পতিবার নির্দেশ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তা কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে। অভিযোগ উঠছিল, অনেক মেডিক্যাল কলেজেই এই চিকিৎসক প্রভাব খাটাতেন। একাধিক চিকিৎসক সংগঠনের দাবি, আরজি করের প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ঘনিষ্ঠ এই চিকিৎসক। মহিলা চিকিৎসকের খুন ও ধর্ষণের ঘটনায় বারবার শোনা গিয়েছে, 'উত্তরবঙ্গ লবি'-র কথা। সেখানেও বিরূপাক্ষ বিশ্বাসের নাম জড়িয়ে ছিল। প্রথম থেকেই শোনা গিয়েছিল, এই লবি নাকি স্বাস্থ্য ভবনের যাবতীয় সিদ্ধান্ত নেয়। অভিযোগ ছিল, মোবাইল ল্যাপটপ নিয়ে পরীক্ষায় বসা থেকে নম্বর বাড়ানো, পরীক্ষক পদ থেকে অপসারণ, বদলি করা সহ বিবিধ দুর্নীতির।

আরও পড়ুন- আরজি কর: মাথায় পৌঁছচ্ছে না অক্সিজেন! কেমন আছেন চিকিৎসক দেবাশিস সোম?

আরজি কর কাণ্ডের ঘটনাস্থলের যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছিল, তাতে নাকি বিরূপাক্ষকেও দেখা গিয়েছিল। সেখানে তাঁর কী প্রয়োজন পড়েছিল সেই উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। ওই ভিডিও ছড়িয়ে পড়তেই তাঁকে সরানোর দাবি ওঠে। তাঁর বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, একবার এক ইন্টার্নকে শংসাপত্র আটকে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। ফোন করে হুমকি দেওয়ার সেই অডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছিল। অডিও ক্লিপে শোনা যায়, অকথ্য ভাষায় গালাগালিও। বিরূপাক্ষকে বলতে শোনা যায়, "ঠিকঠাক ভাবে না থাকলে তোর রেজিস্ট্রেশন আটকে দেব। এটা আমার গ্যারান্টি।" যদিও ওই চিকিৎসক সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে দাবি করেছেন, এই অডিও ক্লিপের স্বর তাঁর নয়। এআই ব্যবহার করে কণ্ঠস্বর বিকৃত করা হয়েছে। অডিও ক্লিপ ঘিরে উত্তাল হয়েছিল পরিস্থিতি। সামাল দিতে ওই চিকিৎসককে কাকদ্বীপ মহকুমা হাসপাতালে বদলি করা হয় কিন্তু তাতেও কোনও সমাধান হয়নি। বিরূপাক্ষ কাকদ্বীপ মহকুমা হাসপাতালে বদলি হচ্ছেন জানতে পেরে বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই সেখানে বিক্ষোভ করেন স্থানীয়রা। সন্ধের পরে জানা গিয়েছিল, তিনি আর আসছেন না। এদিনই তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়।

বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়ারা দাবি করেছেন, ২০২৩ সালের ১১ অগাস্ট স্বাস্থ্য ভবনের তরফে বিরূপাক্ষকে সরানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের ক্ষমতাবলেই এই নির্দেশ বাস্তবায়িত করা হয়নি বলে জানিয়েছেন জুনিয়র ডাক্তাররা। এতে 'উত্তরবঙ্গ লবি'-র প্রধান মাথা অভীক দে-রও হাত রয়েছে বলে তাঁদের দাবি। সেই সময় এই নিয়ে তুমুল বিতর্কও হয়েছিল। তবুও এক বছর ধরে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজেই কর্মরত ছিলেন তিনি। জুনিয়র চিকিৎসকরা আরও বলেন, বিরূপাক্ষ ছাড়াও অনেকেই অবৈধভাবে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে কর্মরত রয়েছেন। স্বাস্থ্য ভবন সূত্রে খবর, গত বছর ১১ অগাস্ট সিনিয়র স্পেশাল সেক্রেটারি অ্যানাস্থলজি, প্যাথলজি, রেডিও-থেরাপি, মাইক্রবায়োলজি-সহ আরও কিছু বিভাগের ৫৮৭ জনকে বদলির নির্দেশ ছিল।

স্নাতকোত্তরের পরে বিরূপাক্ষের সঙ্গে নাকি স্বাস্থ্য ভবনের একটি চুক্তি হয়। সেখানে উল্লেখ ছিল, প্রথম এক বছর বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে এবং পরের দু'বছর অন্য হাসপাতালে পরিষেবা দেবেন বিরূপাক্ষ। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের আন্দোলনকারীদের দাবি, বিরূপাক্ষ এতটাই ক্ষমতাশালী ছিলেন যে এই চুক্তিও মানতে হয়নি তাঁকে। কতটা ক্ষমতাশালী হলে স্বাস্থ্য ভবনের নির্দেশকে বুড়ো আঙুল দেখানো যায় তা একজন শিশুও বোঝে! বিক্ষোভকারী চিকিৎসকদের আরও দাবি, তিনি নাকি কলেজের প্যাথলজি বিভাগেও নিয়মিত উপস্থিত থাকতেন না। ক্ষমতাশীল বিরূপাক্ষ নাকি হামেশাই ইন্টার্ন সহ হাসপাতালের অন্য কর্মীদের হুমকি দিতেন। স্বাস্থ্য ভবনের নির্দেশ ছড়িয়ে পড়তেই একে একে সবাই মুখ খুলছেন। বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজের জয়হিন্দ ক্যান্টিনের মালিক শেখ মাখন দাবি করেছেন, তাঁর ক্যান্টিনে ২৩,৮০০ টাকা বাকি রয়েছে বিরূপাক্ষর। তিনি নাকি রোজ ১০০ কাপ চা অর্ডার দিতেন। ক্যান্টিনের মালিকের কথায় বিরূপাক্ষ বড় বড়, দামি সিগারেট খেতেন। মালিকের দাবি, বাকিতেই খেতে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। বলে যেতেন, পরে দেবেন। বহুবার বাকি টাকা ফেরত নিতে গিয়েওছেন ক্যান্টিনের মালিক কিন্তু বারবার শূন্য হাতেই ফিরিয়ে দিয়েছেন চিকিৎসক।

আরও পড়ুন- আরজি কর কাণ্ড: অবশেষে গ্রেফতার! ১৬ দিন জেরার শেষে সিবিআই হেফাজতে সন্দীপ ঘোষ

চিকিৎসক সংগঠন বিবৃতিতে লিখেছে, "আমরা মেডিক্যাল কাউন্সিলের ভোটের সময় থেকেই এঁদের বিরুদ্ধে বলে এসেছি। মামলা করা হয়েছে। সন্দীপ ঘোষের কুকীর্তি নিয়েও বহুবার বলেছি। না শোনাই রয়ে গেছে আমাদের স্বর। আমাদের প্রার্থী-সমর্থকদের প্রতিহিংসামূলক বদলি করা হয়েছে। জল বাড়তে বাড়তে এখন মাথার ওপর উঠে গিয়েছে এবং আরজি করে আমাদের বোনের নারকীয় দুর্ঘটনার ২৭ দিন বাদে প্রশাসনের টনক নড়েছে। গ্রেফতার এবং সাসপেনশন হচ্ছে। কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। পদত্যাগের হিড়িক উঠেছে কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেল। না আমরা আনন্দিত নই। এদের মাথার ওপর যে মাথারা রয়েছে, তাদের শাস্তি না পাওয়া অবধি আমার স্বস্তি পাব না।"

প্রশ্ন উঠছে, বহু দিন ধরে এই চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো হলেও কেন তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করা হলো না? সাসপেন্ড করতে আরজি কর কাণ্ডের অপেক্ষা করতে হল কেন? বারবার প্রশ্ন উঠছে, কীসের এত দম্ভ এই চিকিৎসকদের?

More Articles