বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে || ৫০ লক্ষর বেশি মামলার নিষ্পত্তি হয়নি হাই কোর্টগুলিতে
ভারতীয় গণতন্ত্রের ঐশ্বর্য নাকি এদেশের বিচারব্যবস্থা। এদিকে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীর পেশ করা পরিসংখ্যানে সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য ধরা পড়েছে। তাহলে হচ্ছেটা কী!
ভারতীয় বিচারব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এদেশে বিচারপ্রক্রিয়া অতি-বিলম্বিত। দেশের বিভিন্ন আদালতগুলিতে জমে গিয়েছে মামলার পাহাড়। এদিকে যথেষ্ট সংখ্যক বিচারপতি কিংবা বিচারকের অভাব। বছরের পর বছর ধরে এই পরিস্থিতি। অবস্থার পরিবর্তনের কোনও আশাও নেই।
কেন্দ্রীয় সরকারের পেশ করা তথ্যেও একই ছবি ধরা পড়েছে। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু সম্প্রতি রাজ্যসভায় এ-সম্পর্কে যে লিখিত তথ্য পেশ করেছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, হাই কোর্টগুলিতেও একই পরিস্থিতি। একই সঙ্গে পরিস্থিতি সঙ্গিন দেশের শীর্ষ আদালতেও। শীর্ষ আদালত এবং দেশের হাই কোর্টগুলিতে প্রচুর সংখ্যক মামলা জমে থাকলেও বিচারপতির অভাবে সেই মামলাগুলির নিষ্পত্তি ঝুলে রয়েছে।
কেন্দ্রের পেশ করা তথ্যানুসারে, চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত হাই কোর্টগুলিতে জমে থাকা মামলার সংখ্যা চোখ কপালে তুলবে। জমে রয়েছে ৫৯ লক্ষর বেশি মামলা। এই মামলাগুলির নিষ্পত্তি কবে হবে, সেসম্পর্কেও কোনও নিশ্চয়তা নেই।
আরও পড়ুন: প্রদীপের নিচে এত অন্ধকার? স্বাধীনতার ৭৫-এ কোথায় দাঁড়িয়ে ভারত
এছাড়া ভারতীয় বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে আরেকটি উদ্বেগজনক তথ্য হলো, শীর্ষ আদালত এবং দেশের হাই কোর্টগুলিতে পুরুষ বিচারপতির তুলনায় মহিলা বিচারপতির হার কম। খোদ কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়েছে, দেশের শীর্ষ আদালতে মহিলা বিচারপতির সংখ্যা মোটে চারজন। আর হাই কোর্টগুলিতেও মোট মহিলা বিচারপতির সংখ্যা এই মুহূর্তে মোটে ৯৬ জন।
সারা দেশে মোট হাই কোর্টের সংখ্যা ২৫টি। বিচারপতির অভাবের জন্যে লক্ষ লক্ষ মামলা ঝুলে রয়েছে এবং মহিলা বিচারপতির আনুপাতিক হার পুরুষ বিচারপতির তুলনায় কম। পেশাগত বৈষম্যজনিত এই সমস্যার মোকাবিলা কীভাবে করা হবে, এ-ব্যাপারেও কোনও দিশা দেখাতে পারেননি কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরণ রিজিজু।
একঝলক দেখে নেওয়া যাক, ভারতের ২৫টি হাই কোর্টের ঝুলে থাকা মামলার নিরিখে সবচেয়ে শোচনীয় পরিস্থিতি কোন রাজ্যের। এক্ষেত্রে তালিকার এক নম্বরে নাম এলাহাবাদ হাই কোর্টের। এলাহাবাদ হাই কোর্টে ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা ১০ লক্ষাধিক। এরপরই স্থান রাজস্থান হাই কোর্টের। রাজস্থান হাই কোর্টে ৬ লক্ষাধিক মামলা ঝুলে রয়েছে। তৃতীয় স্থানাধিকারী রাজ্যে মহারাষ্ট্র। বম্বে হাই কোর্টে ঝুলে রয়েছে ৬ লক্ষের কাছাকাছি মামলা। শোচনীয় পরিস্থিতি মাদ্রাজ হাই কোর্ট, পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাই কোর্ট, মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক হাই কোর্টের পাশাপাশি তেলেঙ্গানা, পাটনা, অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাত, ওড়িশা, দিল্লি হাই কোর্টের মতো সর্বত্রই। একই করুণ দশা কলকাতা হাই কোর্টেরও। কলকাতা হাই কোর্টে ঝুলে রয়েছে ২ লক্ষর বেশি মামলা।
বছরের পর বছর মামলার পাহাড় জমে থাকার বিষয়টি ভারতীয় সংবিধানেরও পরিপন্থী। সংবিধানের ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী মামলা প্রলম্বিত হওয়ার কথা নয়। বরং সংবিধানে মামলাগুলির দ্রুত নিষ্পত্তির কথা পরিষ্কারভাবে বলা আছে।
কেন্দ্রীয় সরকার সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। শীর্ষ আদালত এবং হাই কোর্টগুলিতে মহিলা বিচারপতির সংখ্যা কম হলেও পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করা যাবে, সেসম্পর্কেও যদিও এখনও কোনও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়নি।
যেমন, শীর্ষ আদালতে মোট ৩৪জন বিচারপতি নিয়োগের বিষয়টি অনুমোদিত। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা মোটে ৩৪ জন। দেশের হাইকোর্টগুলিতে রয়েছেন মোট ৯৬ জন মহিলা বিচারপতি। যদিও অনুমোদিত বিচারপতির সংখ্যা ১ হাজার ১০৮ জন।
আবার দেশের কয়েকটি রাজ্যের হাই কোর্টে একজনও মহিলা বিচারপতি নেই। এই রাজ্যগুলির ভেতর রয়েছে মণিপুর, মেঘালয়, ত্রিপুরা, পাটনা এবং উত্তরাখণ্ড। তবে কলকাতা হাই কোর্টে রয়েছেন মোট সাত জন মহিলা বিচারপতি।
একদিকে সারা দেশে হাই কোর্টগুলিতে ৫৯ লক্ষ মামলা দিনের পর দিন ধরে জমে রয়েছে, অন্যদিকে একই পরিস্থিতি শীর্ষ আদালতেও। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু জানিয়েছেন, ২০২২ সালের ২ অগাস্ট পর্যন্ত শীর্ষ আদালতে জমে থাকা মামলার সংখ্যা ৭১ হাজার ৪১১টি। এর ভেতর ফৌজদারি মামলার সংখ্যাই ১৫ হাজার ৭৬টি।
উদ্বেগজনক আরেকটি বিষয় হল গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শীর্ষ আদালতে ঝুলে থাকা মামলার সংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। এছাড়া ৪২ হাজার মামলা শীর্ষ আদালতে ঝুলে রয়েছে গত পাঁচ বছরের কাছাকাছি। আর ১৮ হাজারের বেশি মামলা ঝুলে রয়েছে গত পাঁচ থেকে দশ বছর ধরে।
দেশের শীর্ষ আদালতে কিংবা হাই কোর্টগুলিতে প্রচুর মামলা জমে থাকার নিরিখে আদালতগুলিতে কী শোচনীয় পরিস্থিতি চলছে, তাও কহতব্য নয়। এর ফলে প্রশাসনের পাশাপাশি বিপাকে পড়েছেন মামলাকারী সাধারণ নাগরিকরা। ন্যায়বিচারের আশায় তাঁদের বছরের পর বছর তীর্থের কাকের মতো প্রতীক্ষা করতে হচ্ছে।
চলতি বছরে এ-পর্যন্ত পাওয়া বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে, সারা দেশের সব ধরনের আদালতগুলি মিলিয়ে নিষ্পত্তি না হওয়া মামলার সংখ্যা ৪ কোটি ৭০ লক্ষর কাছাকাছি। আর কেন্দ্রের বক্তব্য হলো, জমে থাকা মামলার সংখ্যা চার কোটির কম। এর কারণ আগেই জানানো হয়েছে। বিচারপতি, বিচারকের সংখ্যার অপ্রতুলতাই অন্যতম প্রধান কারণ। প্রসঙ্গত, ভারতের আদালতগুলিতে মোট বিচারপতি, বিচারকের সংখ্যা এ-মুহূর্তে ২৫ হাজার ৬২৮জন।
রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেসের বিধায়ক-মন্ত্রীদের সম্পতি হু হু করে বেড়ে চলার প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে কলকাতা হাই কোর্টে মামলা দায়ের করেছিল সিবিআই। ২০১১ সালে বাংলা রাজনৈতিক পালাবদলের পরে ক্ষমতাসীন হয় তৃণমূল কংগ্রেস। এরপর থেকে তৃণমূল নেতাদের সম্পত্তির পরিমাণ ২০১৬ সাল পর্যন্ত হু হু করে বেড়েছে। অতি গুরুত্বপূর্ণ এই মামলাটি এজলাসে উঠেছে সম্প্রতি। যদিও এজন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে টানা পাঁচ-পাঁচটি বছর।
জমে থাকা মামলার পাহাড়ের হাত থেকে নিষ্কৃতি মেলার কোনও আশাও দেখা যাচ্ছে না। এ-ব্যাপারে কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রকও হাত গুটিয়ে বসে আছে। কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু জানাননি, পর্যাপ্ত সংখ্যক বিচারপতি এবং বিচারক আদৌ নিয়োগ করা হবে কি না। বরং তিনি জানিয়েছেন, আগামিদিনে এই মামলার সংখ্যা আরও বাড়বে।
কেন্দ্রীয় সরকার বড়াই করছে ভারতীয় বিচারব্যবস্থার। ভারতীয় গণতন্ত্রের ঐশ্বর্য নাকি এদেশের বিচারব্যবস্থা। এদিকে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীর পেশ করা পরিসংখ্যানে সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য ধরা পড়েছে। তাহলে হচ্ছেটা কী!
বিচারপতি এবং বিচারকদের সংখ্যার অপ্রতুলতার ফলে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি যে সমস্যা দেখা দিয়েছে। এক-একজন বিচারপতি কিংবা বিচারককে দৈনিক ৪০ থেকে ৫০টি মামলা সামাল দিতে হচ্ছে। বিচারপতি এবং বিচারকরাও মানুষই। অতিরিক্ত কাজের চাপ দিনের পর দিন সামলাতে হচ্ছে তাঁদের।
পরিস্থিতি সম্পর্কে পুরোপুরিভাবে ওয়াকিবহাল কেন্দ্রীয় সরকার। কেননা কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী কিরেণ রিজিজু নিজেই জানিয়েছেন, ব্রিটেনে দৈনিক একজন বিচারপতির এজলাসে মোটে তিন থেকে চারটি মামলার শুনানি চলে।
সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!