ভারতের লক্ষ লক্ষ শিশুকে হাত পাততে হচ্ছে দু'মুঠো ভিক্ষের জন্য, কেন এই অবস্থা দেশের শৈশবের?

কেন দেশ থেকে ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল করা যাচ্ছে না?

দেশের ভবিষ্যৎ শিশুরা। কিন্তু ভারতে লক্ষ লক্ষ নাবালক-নাবালিকার শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি অতি তিক্ত। পারিবারিক দারিদ্রই এর অন্যতম কারণ। এর জেরে শিশু-কিশোররা পথে পথে ভিক্ষা করছে। কচিকাঁচা এই ভিক্ষুকদের বয়স ৬ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত। ২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতি দেখা দেওয়ার পরে ভারতে শিশু ও কিশোর ভিক্ষুকের সংখ্যা বেড়েছে। স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন, এঁদের বয়স ৬ থেকে ১২ বছরের মধ্যে। রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষা করছে ওরা। এভাবে প্রতিদিন রোজগার হচ্ছে ৫০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত।

২০১১ সালে ভারতে সর্বশেষ সেনসাস হয়। সেই সেনসাস অনুযায়ী, ভারতে শিশু ও কিশোর ভিখিরির সংখ্যা ৩ লক্ষ ৭২ হাজার। এদের বয়স ১৪ বছরেরও কম। শিশু ও কিশোর ভিক্ষুকদের মধ্যে বালকের সংখ্যা ১ লক্ষ ৯৭ হাজার এবং বালিকাদের সংখ্যা ১ লক্ষ ৭৪ হাজার। স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন, যে সমস্ত শিশু ও কিশোরকে দিয়ে ভিক্ষা করানো হচ্ছে, তাদের মাদক খাইয়ে, মারধর করে অথবা হুমকি দিয়ে ভিক্ষা করানো হচ্ছে।

যে শিশু ও কিশোরকে ভিক্ষাবৃত্তি করানো হচ্ছে, তাদের মধ্যে অধিকাংশকে পাচার করা হচ্ছে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রতিদিন ১৭৪ জন শিশু-কিশোর নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে দেশের নানা প্রান্ত থেকে। এদেরই ভিক্ষায় নামানো হচ্ছে।

আরও পড়ুন: স্বাধীন ভারতের লজ্জা! কর্মক্ষেত্রে আজও অধরা অর্ধেক আকাশের স্বপ্ন

কেবলমাত্র ভারতে নয়, সারা পৃথিবীতেই এই কাণ্ড চলছে। 'ওয়ার্ল্ড ভিশন স্টাডি' নামে আন্তর্জাতিক সমীক্ষায় দেখা দিয়েছে, সারা পৃথিবীতে গায়ের জোরে এভাবে ভিক্ষায় নামানো হচ্ছে ৮০ লক্ষ ভিক্ষুককে।

কেন এই পরিস্থিতি? সূত্রের খবর, সারা পৃথিবীতে ১০ কোটির বেশি শিশু-কিশোর খিদের জ্বালায় কাতর। গোটা এশিয়ার ৮ কোটির বেশি শিশু-কিশোর খাদ্যাভাবে ভুগছে। আর এই অনাহারই তাদের ভিক্ষাবৃত্তি করতে বাধ্য করছে।

তবে ভারতে শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ। ২০১৫ সালের 'জুভেনাইল জাস্টিস কেয়ার অ্যান্ড প্রোটেকশন অব চিলড্রেন অ্যাক্ট' অনুসারে ভারতে শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি নিষিদ্ধ। তবে আইনের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না, একথা বলা বাহুল্য। এ-সত্ত্বেও ভারতে শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি করিয়ে শিশু-কিশোরদের দিয়ে কোটি কোটি টাকা কামিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

শিশু-কিশোরদের দিয়ে ভিক্ষা করানো হচ্ছে রাস্তায় রাস্তায়। লকডাউনে গাড়িঘোড়া বন্ধ থাকায় শিশু-কিশোরদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ ছিল। ফলে শিশু-কিশোররা বেজায় বিপাকে পড়েছিল। লকডাউন উঠতেই মাফিয়াচক্রের পরিচালনায় শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তি ফের অবাধে চলছে।

দেশের রাজধানী দিল্লিতেও একই পরিস্থিতি। হাজার হাজার শিশু-কিশোর আজও রাজধানীর পথেঘাটে ভিক্ষাবৃত্তি করছে। এই তথ্য জানিয়েছে 'দিল্লি কমিশন ফর প্রোটেকশন অফ চাইল্ড রাইটস'। স্বেচ্ছাসেবীরা জানিয়েছেন, দেশের রাজধানী দিল্লিতে অন্তত পাঁচ হাজার শিশু ভিক্ষাবৃত্তি করছে। রাজধানী শিশুতে যে শিশুরা ভিক্ষাবৃত্তি করছে তাদের আয় কুড়িয়ে-বাড়িয়ে দৈনিক ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত।

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দেওয়া পরিসংখ্যান অনুসারে, সারা দেশে মোট ২ কোটি শিশু রাজধানীর পথেঘাটে ভিক্ষাবৃত্তি করছে। এদের লেখাপড়া শেখার কোনও সুযোগ নেই।

কেউ শখে হাত পাতে না। পেটে টান পড়লেই মানুষ ভিক্ষুক বনে। শিশু-কিশোরদের পেটের দায়ে ভিক্ষাবৃত্তি করতে হচ্ছে, দেশের ভবিষ্যতের পক্ষে তা যে একেবারেই সুখকর নয়, সেকথা বলার নয়। শিশুদের ভিক্ষাবৃত্তির ফলে ২০১৫ সালের 'জুভেনাইল জাস্টিস কেয়ার অ্যান্ড প্রোটেকশন অ্যান্ড অ্যাক্ট' লঙ্ঘিত হচ্ছে।

ভারতে ২ কোটি শিশু ভিক্ষাবৃত্তি করলেও তাদের উদ্ধার করে সমাজের মূলস্রোতে ফেরানোর কোনও পরিকাঠামো নেই। পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে যে হোমগুলি রয়েছে, তাতে মোটে ২ লক্ষ ৫০ হাজার শিশুর আশ্রয় হতে পারে। এটা সিন্ধুতে বিন্দুসম বলা যেতে পারে।

দেশের রেলস্টেশনগুলি নাবালক-নাবালিকা ভিক্ষুকে ছেয়ে গিয়েছে। এছাড়া বড় বড় মেট্রো শহরের রাস্তাঘাট, ফুটপাথেও একই পরিস্থিতি।

সারা পৃথিবীর নিরিখে ভারতে শিশু-কিশোর ভিক্ষুকের সংখ্যা সর্বোচ্চ। স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরে দেশের এই পরিস্থিতিতে 'ভারত আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন' আর কখনও পাবে কি না, এই প্রশ্নও উঠছে সংগত কারণেই।

ভারতে শুধু শিশুরাই নয়, হাজার হাজার প্রাপ্তবয়স্ক মানুষও ভিক্ষাজীবী। সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ক্ষমতায়ন দফতরের তরফে রাজ্যসভায় পেশ করা রিপোর্ট অনুসারে, মোট যত সংখ্যক মানুষ ভিক্ষাবৃত্তি করছেন এদের মধ্যে ১৪ শতাংশই শিশু-কিশোর ভিক্ষুক। দেশের যে রাজ্যগুলিতে শিশু-কিশোররা ভিক্ষাবৃত্তি করছে, এদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক রয়েছে বিজেপিশাসিত রাজ্য উত্তরপ্রদেশে। এরপরই স্থান বিহার এবং রাজস্থানের। দেশের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলগুলিতেও একই পরিস্থিতি।

এদিকে ভারতে ভিক্ষাবৃত্তি কেবল বেআইনি নয়, অসাংবিধানিকও। যদি কোনও শিশু-কিশোরকে ভিক্ষাবৃত্তিতে নিযুক্ত করা হয়, সেক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইনানুসারে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড ও সেইসঙ্গে জরিমানা করার বিধান রয়েছে। তবে সেই আইন রয়েছে কেবলমাত্র খাতায়-কলমেই।

'ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো'র পরিসংখ্যান অনুসারে, প্রতি বছর ভারতে ৪০ হাজার নাবালক-নাবালিকাকে অপহরণ করা হয়। এদেরই মাফিয়াচক্র ভিক্ষুক হিসেবে কাজে লাগায়। আর ভিক্ষুক হিসেবে নিযুক্ত এই নাবালক-নাবালিকাদের পথে-ঘাটে, রেল স্টেশনে, মেট্রো স্টেশনের বাইরে কিংবা বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া এলাকাগুলিতে ভিক্ষাবৃত্তি করানো হচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবীরা উদ্বেগপ্রকাশ করে জানিয়েছেন, এই নাবালক-নাবালিকাদের মধ্যে অধিকাংশই মাদকাসক্তির শিকার। মাদক খাইয়ে এদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করানো হচ্ছে। এছাড়া কথায়-কথায় নিয়মিত মারধর তো রয়েইছে।

কেন দেশ থেকে ভিক্ষাবৃত্তি নির্মূল করা যাচ্ছে না? এনিয়ে গবেষণাও হয়েছে। তাতে দেখা গিয়েছে, যে সমস্ত শিশু-কিশোর ভিক্ষাবৃত্তি করছে ভিক্ষাবৃত্তি করাটা তাদের কাছে অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। এই অভ্যাস ছাড়ানোর মতো প্রয়োজনীয় পরিকাঠামোও নেই।

সর্বশেষ সেনসাস অনুযায়ী, বাংলাতেও শিশু-কিশোর ভিক্ষুকের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এই সমস্যা মোকাবিলার অন্যপথ পথ কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য বাজেটগুলিতে শিক্ষাক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানো। কারণ কেবলমাত্র শিক্ষাই পারে মানুষকে সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি উপহার দিতে। এদিকে সারা দেশে বহু শিশু-কিশোর বাটি হাতে রাস্তায় রাস্তায় করুণ চোখে মিনতি করছে ভিক্ষাপাত্রে দানের আশায়। ওরা প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগটুকুও থেকে বঞ্চিত। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করছে, কেন্দ্রীয় বাজেটে স্কুলশিক্ষা খাতে বরাদ্দ ২০২১-২০২২ সালের আর্থিক বছরের ৪০ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা থেকে বাড়িয়ে ২০২২-২০২৩ আর্থিক বছরে ৬৩ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা করা হয়েছে।

More Articles