আমেরিকায় ভয়াবহ মন্দা আসন্ন, কতটা প্রভাব পড়বে ভারতীয় অর্থনীতিতে?

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই যে পশ্চাদপসরণ পরিস্থিতি চলছে, তাতে আমেরিকা তো বটেই, ইউরোপও এমনকি চিনও পড়তে পারে মন্দার কবলে, তা হলে ভারত কি রক্ষা পাবে? সেক্ষেত্রে এখন পা মেপে মেপে ফেলতে হবে সরকার-আরবিআইকে।

'বাজার এখন খুব খারাপ', 'একটু দাঁড়িয়ে যা, ক'টাদিন একটু মার্কেটটা দেখে নে', 'ক্রিপ্টোতে এখন ভুল করেও হাত নয়', 'একেই চাকরির বাজার এত খারাপ, তার ওপর যদি মন্দা আসে...' আশংকা, উদ্বেগের দিন ফিরছে, আবার। ২০০৮ সালের পর আবার মেঘাচ্ছন্ন আমেরিকার অর্থনীতির আকাশ। মুদ্রাস্ফীতির হার তুঙ্গে, এবং বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, আগামী বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালে আবার মন্দাক্রান্ত হতে চলেছে মার্কিন অর্থনীতি। যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব থেকে বিশ্বের খুব কম দেশই নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারে। তবে দুঃসংবাদ, ভারত একেবারেই তা পারবে না।

৫০ লক্ষ কর্মচারী এই মুহূর্তে তথ্যপ্রযুক্তি সেক্টরে কর্মরত। আমেরিকার বাজার থেকে তার মধ্যে আসে ৪০ থেকে ৭৮ শতাংশ লভ্যাংশ। টিসিএস, ইনফোসিস, উইপ্রো, এইচসিএল এবং টেক মাহিন্দ্রা হলো তাদের মধ্যে অন্যতম, যাদের ব্যবসার বেশিরভাগটাই নির্ভরশীল আমেরিকা এবং ইউরোপের বাজারের ওপর।

কিন্তু আবার কী কারণে অর্থনীতির আকাশে কালো মেঘ? কী হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী রাষ্ট্রে? যে দেশের অর্থনীতি গোটা পৃথিবীর মোট জিডিপির প্রায় ২৫ শতাংশ, তাদের মন্দা এলে কীভাবে সামলাবে গোটা বিশ্ব?

আরও পড়ুন: লোপাট কোটি কোটি টাকা, ভারতের সবচেয়ে বড় ব্যাঙ্ক জালিয়াতির শিকড় কতটা গভীরে?

১৯৯৪ সালের পর আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক সুদের হার বৃদ্ধিতে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। মুদ্রাস্ফীতির হার দুই শতাংশের নিচে রাখতে তারা বদ্ধপরিকর। যা এই মুহূর্তে আট শতাংশ ছুঁয়ে ফেলেছে। শুধু তাই নয়, মূল্যবৃদ্ধি যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, তাতে ফেডেরাল রিজার্ভ জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা এই সুদের হার এখন বাড়াতে থাকবে।

অতিমারী পরবর্তীকালে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে আমেরিকা সুদের হার শূন্যে নিয়ে আসে। মানুষের হাতে যাতে অর্থের অভাব না হয়, তার জন্য ডলারের জোগানও অনেকটাই বাড়িয়ে দেয় তারা। যার ফলে লাভবান হয় উন্নয়নশীল দেশগুলির অর্থনীতি, বিশেষ করে ভারতের। তাতে সাময়িকভাবে দেশে বৈদেশিক, বিশেষ করে ডলারের ভান্ডার বৃদ্ধি পায়। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে।

একথা জানা ছিলই যে, এই জোগান বৃদ্ধি একদিন বিপদ ডেকে আনবেই। অতিমারী-পরবর্তীকালে অর্থনীতির চাকা ঘুরেছিল। কিন্তু রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের পরিকল্পনা একটু অন্যরকম ছিল। তাকে থামাতে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমি দেশগুলির জোট অনেক ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করলেন। ব্যস, তৈরি হলো জ্বালানির সংকট, খাদ্যপণ্যর সংকট, সারের সংকট। বিশ্বজুড়ে প্রায় সব দেশেই জিনিসপত্রের দাম বাড়তে শুরু করল নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। মূল্যস্ফীতির চাপে বিভিন্ন দেশের সাধারণ মানুষ এখন দিশেহারা।

শুধু আমেরিকা নয়, চাপে আছে বিশ্বের সব বড় অর্থনীতিগুলিই। ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানির মত দেশগুলিও এখন আক্রান্ত। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, বৃহৎ অর্থনীতিগুলির মধ্যে ৬০ শতাংশ দেশই এখন মূল্যস্ফীতির ফাঁসে নাজেহাল। তাই সেই সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের কাছেই সুদের হার বাড়ানো একটি বড় হাতিয়ার এবং যা বাড়াতে তারা দ্বিধা বোধ করছে না। যার প্রভাব পড়বে আর্থিক বৃদ্ধিতে, স্বাভাবিকভাবেই বাড়বে বেকারত্ব, এবং আসবে মন্দা।

মন্দা এসেছে এই কথা কখন বলা যেতে পারে? মন্দা আসলে কী?

১৯৭৫ সালে 'দ‍্য নিউ ইয়র্ক টাইমস'-এ প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানবিদ জুলিয়াস শিস্কিন মন্দা পরিস্থিতি শনাক্ত করার জন্য বেশ কয়েকটি মূল বিধির কথা বলেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হল "জাতীয় গড় আয়ের দু'টি নিম্নমুখী ত্রৈমাসিক পর্ব।"

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংজ্ঞাগুলোও পরিবর্তিত হয়ে যায় এবং বর্তমানে মন্দা বলতে বোঝায় এমন একটি সময়কাল, যখন অন্তত দু'টি ত্রৈমাসিক পর্বে জাতীয় গড় আয় কমে যায়। অনেক অর্থনীতিবিদ ১২ মাসের মধ্যে বেকারত্বের পরিমাণ ১.৫ শতাংশ বৃদ্ধিকে মন্দা-র সংজ্ঞা বলে চিহ্নিত করেন। এছাড়াও বেকারত্বের হারও এই বিষয়ে নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করে। আমেরিকায় এই মুহূর্তে বেকারত্বের হার ৩.৬ শতাংশ, যা ২০২৪-এ গিয়ে বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৪.১ শতাংশে। ইতিমধ্যেই আমেরিকায় বেশ কয়েকটি সংস্থা কর্মী ছাঁটাই শুরু করে দিয়েছে।

এবার আসা যাক ভারতের ওপর কী প্রভাব পড়বে, সেই বিষয়ক আলোচনায়। আমেরিকায় সুদের হার বাড়ানো শুরু হয়েছে মধ্য মার্চ থেকে, এবং ভারতের শেয়ার বাজারে সেই বৃদ্ধির জল্পনা থেকেই চূড়ান্ত টালমাটাল শুরু হয়ে গিয়েছে। সেই সঙ্গে গোদের ওপর বিষফোড়ার মতো বিদেশি বিনিয়োগ ঝড়ের বেগে বেরিয়ে যাচ্ছে দেশের শেয়ার বাজার থেকে। বিদেশি বিনিয়োগের বাজার একেবারে ধসে গিয়েছে বলা যায়। ভারতের বাজার থেকে অর্থ সরিয়ে নিয়ে গিয়ে আমেরিকার বাজারে বিনিয়োগ করতে চাওয়ার লক্ষ্যেই এহেন দশা। রেপো রেটও বাড়িয়েছে আরবিআই। ধাপে ধাপে। সেই সূত্র ধরে সবক'টি ব্যাঙ্কও বাড়িয়েছে সুদের হার। কিন্তু তাও বাজার স্থিতিশীলতার মুখ দেখছে না। তার ওপর মুদ্রার মূল্যও পড়ছে। এই বছরের শুরুতে এক মার্কিন ডলার কিনতে গেলে খরচ হত ৭৪.২৫ টাকা। আজ ছয় মাস পর সেই খরচা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮.১৭ টাকায়।

এই পরিস্থিতিতে ভারতও কি মন্দার শিকার হবে? কী ভবিষ্যৎ তথ্য প্রযুক্তি শিল্পে কাজ করা ৫০ লক্ষ কর্মচারীর?

আশঙ্কা পুরোপুরি উড়িয়ে দিচ্ছেন না অনেকেই। কারণ, আমেরিকায় যদি মন্দা শুরু হয়ে যায়, তার একটা কু-প্রভাব তো পড়বেই এদেশে। বিশেষ করে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে। বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, ভারত এখন স্ট্যাগফ্লেশনের মধ্য দিয়ে চলেছে। মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে, কিন্তু অর্থনৈতিক উন্নতির হার হ্রাস পাচ্ছে, সেটাই স্ট্যাগফ্লেশন। স্ট্যাগফ্লেশনকে মুদ্রাস্ফীতিতে মন্দা পরিস্থিতি বা রিসেশন-ইনফ্লেশন বলা হয়ে থাকে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যখন অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই যে পশ্চাদপসরণ পরিস্থিতি চলছে, তাতে আমেরিকা তো বটেই, ইউরোপও এমনকি চিনও পড়তে পারে মন্দার কবলে, তা হলে ভারত কি রক্ষা পাবে? সেক্ষেত্রে এখন পা মেপে মেপে ফেলতে হবে সরকার-আরবিআইকে। জ্বালানির মূল্য কমানো বা তাকে রাখতে হবে একেবারে হাতের মুঠোয়। খাদ্যপণ্যর দামও রাখতে হবে আতসকাচের নিচে। দেখতে হবে, যাতে বেআইনি মজুতদারি না হয়। খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রেও শিথিলতা আনতে হবে।

তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের জন্যে একটা আশার কথা হল, সবক'টি বৃহৎ ভারতীয় সংস্থার চুক্তি দীর্ঘমেয়াদি। মন্দা যদি আসেও, তাতেও খুব সমস্যা হওয়া উচিত নয়। কিন্তু তাতেও খুব নিশ্চিন্তে থাকা সম্ভব নয়। তাছাড়া খাদ্যশস্যের ভান্ডার অটুট রাখতে ভারত সরকার গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে এই মুহূর্তে। ইউক্রেন আক্রান্ত হওয়ার পর যা নিয়ে গোটা বিশ্বই সমস্যায় পড়েছে।

অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, ভয়াবহ মুদ্রাস্ফীতি থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় হল মন্দা। যা কিছুদিন কষ্ট দেবে ঠিকই, কিন্তু ধৈর্য যদি রাখা যায়, তাহলে অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াবে এবং চাঙ্গা হবে। তবে তার জন্যে চাই দুর্দান্ত পরিচালনা এবং দৃঢ় নেতৃত্ব।

আমাদের নেতৃত্ব কি আশা রাখার যোগ্য? অতীত ভালো কথা বলছে না। দেখা যাক, ভবিষ্যৎ কী উত্তর নিয়ে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে।

More Articles