উনিশে এপ্রিল বললেই বাঙালির এখনও মনে পড়ে ঋতুপর্ণর কথা

১৯ এপ্রিল নিছক কোনও তারিখ হয়ে নেই আর বাংলার চলচ্চিত্রপ্রেমীদের কাছে। অন্তত ১৯৯৪ সালের পর থেকে। বাংলার এক নতুন চলচ্চিত্রভাষার জন্মদিন হয়ে রয়েছে 'উনিশে এপ্রিল'। ইঙ্গমার বার্গম্যানের 'অটাম সোনাটা'-র অনুপ্রেরণা থাকুক বা না থাকুক, নিঃসন্দেহে, সত্যজিতের প্রয়াণের পরে পরেই বাংলা সিনেমার শিক্ষিত, অভিজাত দর্শকদের জন্য এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিল মা-মেয়ের সম্পর্কের টানাপোড়েনের এই ছবি।

যাঁর হাত ধরে বাংলা সিনেমার এই নতুন ঘারানার জন্ম দিয়েছে, তিনি ঋতুপর্ণ ঘোষ। নয়ের দশকে, যখন মুক্তি পেয়েছিল 'উনিশে এপ্রিল', তখন ঘরে ঘরে সাদা-কালো পোর্টেবেল টিভি, বা 'বোকা-বাক্স'। ঝিরিঝিরি দূরদর্শন, সেখানে এই জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত ছবির সম্প্রচার (সিনেপ্রেমীরা অনেকেই ততক্ষণে ঘুরে এসেছেন হলে)। পরিচালক, তরুণ ঋতুপর্ণ ঘোষ। আবার কোনও কোনও ঘরে কালার টেলিভিশন ঘিরে গোল হয়ে বসা। জামবাটি-ভর্তি মুড়ি-চানাচুর সমেত নতুন বাংলা ছবি দেখা। এমন বাংলা ছবি, যার নান্দনিকতা শহরের শিক্ষিত মধ্যবিত্তর কথা মাথায় রেখেই তৈরি, অনেকেই যার অভাব বোধ করছিলেন।

এটি পরিচালকের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র, প্রথম 'হীরের আংটি'। ছবিজুড়ে মা এবং মেয়ের মধ্যে একটি সংবেদনশীল সম্পর্ক চিত্রায়িত হয়েছে। কোনও আউটডোর দৃশ্য, নাচ-গানের দৃশ্য না থাকার পরেও বক্স অফিসে হিট করেছিল এই ছবি। সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল-তপন সিংহদের পরবর্তী পর্যায়ের জন্য একজন প্রতিভূ প্রয়োজন ছিল বাংলা সিনেমার। সেই সময় দাঁড়িয়ে যেন তাই হয়ে উঠলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। 'উনিশে এপ্রিল' সেই কারণেই নিছক একটা দিন হয়ে রইল না, বরং বলা ভাল, বা‌ংলা সিনেমার দর্শকদের কাছে তা মাইলফলক হয়ে রইল।

আরও পড়ুন: পাড়ার সেইসব নববর্ষের সন্ধে ছিল ইন্দ্রজালের মতো

সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক- প্রত্যেকই স্বতন্ত্র চলচ্চিত্রভাষার জন্ম দিয়েছেন। পরে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, অপর্ণা সেন ও গৌতম ঘোষরা বিভিন্নভাবে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সেই ধারাকে। কিন্তু নব্বই দশকের শুরুতে তা খানিকটা স্তিমিত হয়ে আসে। সেই ধারায় গতি সঞ্চারণ করেছিলেন ঋতুপর্ণ। প্রয়োজনকে অতিক্রম করে সৃষ্টিসুখের উল্লাসে, দোলাচল দূর করে দৃঢ়তার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেছেন এক নতুন চলচ্চিত্রধারা। যেসব ভাবনা মানুষের মনে ছিল, সৃষ্টিশীল চিন্তায় ছিল, কিংবা যা ভেবেও প্রকাশের ভাষা পাচ্ছিল না নাগরিক মনন, তিনি তা-ই প্রকাশ করে দেখালেন। সেই প্রকাশও যে কতটা সাবলীল হতে পারে, তা–ও দেখালেন, যে কারণে তাঁর সিনেমায় চরিত্রদের বক্তব্য যেমন বুদ্ধিদীপ্ত, তেমন তীক্ষ্ণ।

ঋতুপর্ণের 'উনিশে এপ্রিল' বলে মা ও মেয়ের অভিমানের কথা, ছোটবেলায় মাকে কাছে না পাওয়ার যন্ত্রণা, বাবাকে হারিয়ে ফেলা একটা শিশুকে কতটা অসহায় করে দিতে পারে, বিখ্যাত মা ও ছাপোষা বাবার টানাপোড়েন, বাবার সুপ্ত পিতৃতন্ত্রকে পুরোপুরি চিনতে না পারার আখ্যান। বৃষ্টির রাতে আচমকা পোলাও রান্নার ছলে মা-মেয়ের জমে থাকা কথার বিস্ফোরণ হোক বা মেয়ে‌ মিঠুর সুইসাইড নোট দেখে মায়ের শক, আরশোলা দেখে ভয় পাওয়া, মা-মেয়ের অভিমান, ভালবাসা- এই ছবিতে সবই খুব স্বাভাবিক। বৃষ্টির ঝিরিঝিরি শব্দ স্পষ্ট হওয়া, ভাঁড়ার ঘরে আমূল স্প্রে-র কৌটোর মধ্যে তেজপাতা, পারফিউমের বোতল- ডিটেলিং ছিল দেখার মতো। গল্পে স্পষ্ট মায়ের ওপর মেয়ের ক্ষোভ, আবার মায়ের হাঁটুতে চোট লাগার চিন্তাও সেই মেয়েরই আছে– সব মিলিয়ে সম্পর্কের এক আশ্চর্য কেমিস্ট্রি তুলে ধরেছেন ঋতুপর্ণ। মা ডান্সার বলে প্রেমিক সুদীপের সঙ্গে ৫ বছরের সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যাওয়া, এবং সুদীপকে ফোনে বোঝানোর চেষ্টা রীতিমতো জীবন্ত! মিঠুর ব্যাগ গোছানো আর প্রেমিকের উপর অভিমানের ছলে গাঢ় চুম্বনের দৃশ্যে প্রেম-যৌনতার চিত্রায়নও হয়ে ওঠে রক্তমাংসের।

একথা সত্যি যে, দেবশ্রী এবং অপর্ণা সেন- দু'জনেই চমৎকার শিল্পী, তেমনই ঋতুপর্ণ তাঁর দ্বিতীয় ছবিতেই কারিগরি দক্ষতায় উজ্জ্বল। উল্লেখ্য, এই সিনেমা ১৯৯৫ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় এবং দেবশ্রী পান সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার।
চরিত্রের আড়ম্বর নেই, সময়ের ঘনঘটা নেই- এমনই এক গল্প বলেছিলেন ঋতুপর্ণ ঘোষ। অপর্ণা-দেবশ্রী ছাড়াও প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, দীপঙ্কর দে, বোধিসত্ত্ব মজুমদার ও চিত্রা সেনের অভিনয় ছিল দেখার মতো। একটি দিনের গল্পের মধ্যে কয়েকটি চরিত্র ফুটে উঠেছিল নিপুণভাবে।

ঋতুপর্ণের সিনেমার নারীচরিত্ররা বারবার বিভিন্ন আঙ্গিক নিয়ে হাজির হয়েছে। তবে নারীর প্রতি পক্ষপাতী না হয়ে বরং সামাজিকভাবে তাকে বিশ্লেষণের প্রয়াসই বেশি দেখা যায় ঋতুপর্ণর ছবিতে। একটি বিশেষ মুহূর্তের কথা দিয়েই মনের সামগ্রিক অবস্থাকে তুলে ধরার পারদর্শিতা তাঁর সিনেমার আরেকটি দিক। যেমন ‘দহন’ সিনেমায় আক্রান্ত নারীকে বাঁচাতে স্কুটার থেকে শিক্ষিকা নেমে যাওয়ার আগে তাঁকে বাধা দিয়ে পুরুষদের কথাবার্তা। অথবা, ‘অন্তরমহল’ সিনেমায় জমিদারের নায়েবের বলা যে ‘ব্রাক্ষ্মণদের শোয়ার ঘরে ঢোকানোই ভুল হয়েছে’— এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের ও ধর্মের ব্যবহার সম্পর্কেও ইঙ্গিত পাওয়া যায়। ঋতুপর্ণ স্মরণ করিয়ে দেন, ‘চিত্রাঙ্গদা’-য় শেষের দিকে সমুদ্রতীরের ভোরের আলোয় একটি সংলাপে, ‘কোনও রূপান্তরই সম্পূর্ণ নয়, পদ্ধতিটা চলতেই থাকে।’ সত্যি, চলচ্চিত্রকার ঋতুপর্ণর রূপান্তরও কি সম্পূর্ণ হল?

অকালে তাঁর চলে যাওয়া বাংলা চলচ্চিত্রজগতে বিরাট ক্ষতির সমান। সেই ক্ষতি নিঃসন্দেহে অপূরণীয়। একথা বলাই বাহুল্য। তবে সময় অতিক্রম করে সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন ঋতুপর্ণ। তাঁর কুড়িটির কাছাকাছি ছবির মধ্য দিয়ে তিনি যে ঘরানার জন্ম দিয়েছেন, তা বাংলা সিনেমাকে অনেকটা পথ এগিয়ে যাওয়ার স্পর্ধা দিয়েছে। আর সেই স্পর্ধার নামই 'উনিশে এপ্রিল'।

More Articles