মার্ক্সের দর্শনে বাংলা পথনাটকের জন্ম দিয়েছিলেন তিনিই, বাঙালি ভুলেছে পানু পালকে
Panu Pal Street Play : কোনও কারণ উল্লেখ না করেই তাঁকে গণনাট্য থেকে বহিষ্কার করা হয়। উৎপল দত্ত, ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস প্রত্যেকেই তখন গণনাট্য সংঘ ছেড়ে বেরিয়ে গেছিলেন।
উৎপল দত্ত তাঁকে বলতেন ‘বাংলা পথ-নাটকের পথিকৃৎ’। তাঁর হাত ধরেই পথনাটক আন্দোলনের উত্থান। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে রাজনৈতিক নাটকের বিস্তারে তিনিই ছিলেন অগ্রগণ্য। অথচ জন্মশতবর্ষ পরেও পানু পাল বাঙালির কাছে আজও অবহেলিত এক নাম। পানু পাল অর্থাৎ পূর্ণেন্দুকুমার পালচৌধুরী। পানু পাল নামেই অবশ্য সকলে চিনতেন তাঁকে। জন্ম ১৯১৯ সালের ২ জানুয়ারি, বর্তমান বাংলাদেশের রংপুরে। বাবা হেমন্তকুমার পালচৌধুরী। পরিবার কংগ্রেসি মনোভাবাপন্ন হলেও কৈশোরেই সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৪১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। ১৯৪৩ সালে বাংলায় শুরু হয় পঞ্চাশের মন্বন্তর। গ্রাম বাংলা জুড়ে তখন শুধুই মৃত্যুমিছিল। প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ নীরবে হাড়গিলে পাখির খাদ্য হয়ে গেল। তার প্রতিবাদে পানু পাল মঞ্চস্থ করেন ‘ক্ষুধা ও মৃত্যু’ নৃত্যনাট্য। ওই সময়ে গণনাট্য সংঘের প্রতিষ্ঠা হলেও কলকাতার বাইরে তাঁদের কাজকর্ম ছিল অত্যন্ত সীমিত। পানু পালের নেতৃত্বেই প্রথম অসম, ত্রিপুরা ও বর্তমান বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে গণনাট্য সংঘের শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৮ সালে পানু পাল লেখেন তাঁর প্রথম নাটক ‘দখল’। এই সময়ই তিনি ঋত্বিক ঘটককে গণনাট্য সংঘে নিয়ে আসেন।
১৯৫২ সালে দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পানু পাল লেখেন পথনাটিকা ‘ভোটের ভেট’। পানু পালের নির্দেশনায় তাতে অভিনয় করেন উৎপল দত্ত, ঋত্বিক ঘটক, উমানাথ ভট্টাচার্য। জনৈক নেতা ও শাগরেদের সঙ্গে এক বয়স্ক চাষি ও তাঁর ছেলের কথোপকথনের মধ্যে দিয়ে কংগ্রেসি শাসনের প্রবঞ্চনাকে ব্যঙ্গের মাধ্যমে তুলোধনা করেছিলেন পানু পাল। কিন্তু গণনাট্যের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে এর পরেই। বহু বহু শিল্পীর মতোই বামেদের এই সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। তেমন কোনও কারণ উল্লেখ না করেই তাঁকে গণনাট্য থেকে বহিষ্কার করা হয়। উৎপল দত্ত, ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরী, দেবব্রত বিশ্বাস প্রত্যেকেই তখন গণনাট্য সংঘ ছেড়ে বেরিয়ে গেছিলেন। পানু পাল অবশ্য কিছুদিন পরে ফের ফিরে আসেন।
আরও পড়ুন- অতিমারীর পরেও প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ! বাংলা থিয়েটারে ‘স্টার’ নয়, ‘কনটেন্ট’-ই আসল রাজা
১৯৫৯ সালে খাদ্য আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে গম্ভীরা নাট্যের আঙ্গিকে পানু লিখেছিলেন ‘কত ধানে কত চাল’ পথনাটকটি। ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত তিনি একের পর এক পথনাটক রচনা, পরিচলনা ও অভিনয়ের সঙ্গে অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। তার মধ্যেই কয়েকটি হলো ‘ভাত’, ‘যদি আমরা মন্ত্রী হই’, ‘নিশির ডাক’, ‘ওরা আর আসবে না’, ‘গঙ্গাযাত্রা’, ‘দূর হটো’ ইত্যাদি। প্রায় সবক'টি নাটকই বিশেষ রাজনৈতিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে রচিত। ১৯৯১ সালে নৃত্যশিল্পে কৃতিত্বের জন্য রাজ্য সংগীত-নাটক-দৃশ্যকলা আকাদেমি ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন সম্মান প্রদান করে। ১৯৯৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর এসএসকেএম হাসপাতালে তাঁর মৃত্যু ঘটে।
পথনাটকের প্রাণ তিনিই। অথচ জন্মশতবর্ষ পার করেও পানু পাল বাংলার থিয়েটারচর্চার জগতে বিশেষ পরিচিত নাম হয়ে উঠলেন না। তাঁর নাট্যপ্রতিভার যথার্থ মূল্যায়ন আজও হয়নি, এমনকী বহু নাটকেরও হদিশ মেলে না আর। বাংলা থিয়েটারের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় এমন বহু প্রতিভাই তাঁদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, আজীবন বঞ্চিতই থেকেছেন। শুধু তো এই বঞ্চনা নয়। পানু পালের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে বাংলার তৎকালীন বাম-রাজনীতির অভ্যন্তরীণ বিবাদের ইতিহাসও। ১৯৬৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙনের সময় তিনি পুরনো অংশ অর্থাৎ সিপিআই-এর সঙ্গেই থেকে যান। কিন্তু পার্টির এই ভাঙন তাঁকে মানসিকভাবে যথেষ্ট আহত করেছিল। তিনি গণনাট্য সংঘ ত্যাগ করে সিপিআই-এর নিজস্ব সংগঠন ‘ভারতীয় গণ-সংস্কৃতি সংঘ’-র হয়ে কাজ করা শুরু করেন।
পানু তাঁর কাজের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। দলীয় রাজনীতি পানু পালের থিয়েটারের আদর্শকে নিজের মতো গলিয়ে, মুড়িয়ে নিতে পারেনি। পরবর্তী সময়ের নাটকে তাই জাতীয় কংগ্রেস ও সিপিআই(এম) দুই-ই ছিল তাঁর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। নিজের রাজনৈতিক দলের সমস্ত সিদ্ধান্তকেই নতমস্তকে মেনে নিয়েছিলেন তিনি এমন একেবারেই নয়। পানু পাল বিশ্বাস করতেন, রাজনৈতিক নেতাদের মতো মৌখিক কথাবার্তায় নয়, জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে হলে মাঠে ময়দানে যেতে হবে। রাজনৈতিক নাটককে চার দেওয়ালে বন্দি রাখলে তার কোনও মূল্য নেই। নির্বাচনের আগে পার্টি-স্তুতি বন্দনা করে নাটক প্রযোজনা আসলে সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরই ক্ষতি করে। তাতে বরং অসাম্য ও সাম্প্রদায়িকতার জিগিরকেই জাগিয়ে রাখা হয়। পানু পালের অধিকাংশ নাটকই পার্টির নীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, তবুও নিজের মনে এই আক্ষেপ তাঁর ছিল। দেখে হতাশ হয়েছিলেন, যে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সূচনা তাঁরা করেছিলেন তা ক্রমে শহুরে উচ্চমধ্যবিত্তদের মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়ছে এবং আরও দুঃখের যে বামপন্থী সরকার তাতে প্রবল উৎসাহ দিচ্ছে।
আরও পড়ুন- ৫০ বছর পেরিয়েও কমেনি ধার! কেন কোনও দিনই পুরনো হবে না মারীচ সংবাদ?
শেষদিকে একটি সাক্ষাৎকারে তাঁর আশঙ্কা ছিল,
“একটা কথা মানি— যদি সমাজে একটা অবক্ষয়ী রাজনৈতিক স্রোত বয়, তবে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের কাজ অনেক কঠিন হয়ে যায়। আজকে তাই হচ্ছে।”