'এই উজ্জ্বলতার স্রোতে...' আজও বাঙালির নস্টালজিয়ায় কেন ফিরে আসে বারবার শালিমার?
Durgapuja 2022: নতুন, পুরনোর মিলমিশের মধ্যেই অব্যহত বাংলায় দুর্গাপুজোর আমেজ।
বাংলায় দুর্গাপুজো মানেই উৎসব। বাড়িতে দুর্গাপুজোর ইতিহাসের তুলনায় বারোয়ারি দুর্গাপুজোর ইতিহাস কম দিনের হলেও তাও বহু জায়গায় এক শতাব্দী পার করে ফেলেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতে দুর্গাপুজো পালনের পদ্ধতি খুব একটা বদলায়নি বটে, তবে বারোয়ারি পুজো পালনের ও আয়োজনের পদ্ধতিতে বহু পরিবর্তন হয়েছে। দুর্গাপুজোর মণ্ডপে মণ্ডপে মানুষের ভিড় এখন আর ষষ্ঠী থেকে শুরু হয় না। প্রতিপদ বা দ্বিতীয়া থেকেই বেশিরভাগ বড় পুজোর মণ্ডপ দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়। সপ্তমীর রাতে উপচে পড়া ভিড়ের মধ্যে লাইন দিয়ে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে মণ্ডপ এবং ঠাকুর দেখার আনন্দের থেকে দ্বিতীয়া অথবা তৃতীয়ার বিকেলে একটু ফাঁকা ফাঁকা মণ্ডপ দেখার আনন্দ অনেকটা আলাদা হলেও মানুষ এখনও দুটোই উপভোগ করতে চায়। যদিও অতিমারীর কারণে গত দুই বছর দুর্গাপুজোর আনন্দে ভাটা পড়েছিল। কিন্তু সেই অভাব এবার পুষিয়ে নিতে প্রস্তুত মানুষ।
বারোয়ারি দুর্গাপুজোর রূপ পরিবর্তন মণ্ডপ এবং তার আশপাশে সবথেকে বেশি ললক্ষ্য করা যায়। গত শতকের শেষ অবধি এবং বহু ক্ষেত্রে এই শতকের গোড়ায় বারোয়ারি পুজোর আলোকসজ্জা অনেকটাই আলাদা ছিল। পুজোর দিনগুলিতে পাড়ায় বাড়ির ছাদগুলো থেকে ঝোলানো হলুদ আলোর বাল্ব এবং গাছে লাগানো সবুজ কাগজে মোড়া টিউবলাইট পুজোর সময় আলোকসজ্জা হিসেবে ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে নানারকম আলোর রোশনাই দেখিয়ে ছোট, বড়, মাঝারি বারোয়ারি পুজোগুলো পরস্পরকে টেক্কা দিতে চেষ্টা করতে শুরু করে। এই বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিযোগিতার ফলে মণ্ডপের অলোকসজ্জায় বহু পরিবর্তন এসেছে। বর্তমানে শুধুমাত্র হলুদ বাল্ব এবং সবুজ কাগজে মোড়া প্লাস্টিকের বদলে বিভিন্ন রঙের আলোর ব্যবহার করা হয়। বহু মণ্ডপে থিমের চাহিদা অনুযায়ী আলোর খুব কম ব্যবহার করা হয়। বারোয়ারি পুজোতে থিমের রমরমা এই শতকের সঙ্গেই শুরু হয়েছিল। তার আগে যে থিম পুজো একদমই ছিল না, তা বলা ভুল, কিন্তু সেই থিম হাতে গোনা কিছু বারোয়ারি পুজোর মধ্যে সীমিত ছিল। থিম বলতে গত শতকের শেষ অবধি মানুষের ধারণাও ছিল খুব সীমিত। পাহাড়, জঙ্গল অথবা কোনও মন্দিরের আদলে তৈরি মণ্ডপ মানুষকে তাক লাগিয়ে দিত। বিগত দুই দশকে থিমের ঢেউ এসেছে। তার ফলে ট্রেন থেকে জাহাজ, পুরনো বাড়ি থেকে ভবিষ্যতের পৃথিবী, ধর্মস্থান, বাঁশের কেল্লা, এমনকী, মঙ্গলগ্রহের আদলে মণ্ডপ তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মতামত প্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই নতুন ধাঁচের মণ্ডপ তৈরি। মানুষের মধ্যে শান্তির প্রচার করতে বিগত দশকে একটি বারোয়ারি পুজোকমিটি মণ্ডপ তার আশপাশের বাড়িতে সাদা রঙ করেছিল। পরিবেশ রক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন বার্তা দিয়ে গত দুই দশকে একাধিক মণ্ডপ তৈরি হয়েছে।
বাংলায় দুর্গোৎসব পালনের পদ্ধতির পরিবর্তন শুধু দেখাই যায় না, কানে শোনাও যায়। বিগত শতকে পুজোর সব দিনগুলোতে পরিচিত বাংলা গান চলত আর ভাসানের শোভাযাত্রায় চলত হিন্দি গান। পুজোর গান বলে একটা আলাদা জগৎ ছিল, পুজো উপলক্ষে মুক্তি পেত বেসিক ডিস্ক ও সিনেমার গান। এছাড়া মণ্ডপে ঢুকলে কম করে দু'-তিনজন ঢাকিকে দেখা যেত। তারপর বহুদিন পুজোর বাংলা গানে খরা চলেছে টানা, ক্রমে জায়গা করে নিল নতুন বাংলা গান, কোথাও আবার শুধুমাত্র বাদ্যযন্ত্রের আওয়াজ। পুজোর দিনগুলোর জন্য গাওয়া গানের বহুবিধ পরিবর্তন হতে শুরু করল। 'আয় রে ছুটে আয় পুজোর গন্ধ এসেছে' থেকে বর্তমানের 'দুগ্গা এল'। সবকিছুর মধ্যেও, আজও, পুরনো দিনের দিকে ফিরে যাওয়ার প্রচেষ্টায় মাঝে মাঝে মাইকে বেজে ওঠে 'আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা'।
আরও পড়ুন: কোথাও ভ্যাটিকান সিটি, কোথাও বাংলার ঐতিহ্য, যেভাবে সেজে উঠছে কলকাতার দুর্গাপুজো
দুর্গাপুজোর সময় বিভিন্ন বিজ্ঞাপন দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন সংস্থা এই বিজ্ঞাপনগুলো দুর্গাপুজোর কথা ভেবেই তৈরি করেন। এই অজস্র বিজ্ঞাপনের মধ্যে কিছু বিজ্ঞাপন মানুষের দীর্ঘদিন মনে থাকে। দুর্গাপুজোর বিজ্ঞাপন বলতে গেলেই তাই শালিমারের বিজ্ঞাপনের নাম বলতেই হয়। "এই উজ্জ্বলতার স্রোতে/ এই বুকের ভিতর হতে/ এই ফুটে ওঠা বিশ্বাসে/ ফিরে আসে বারবার"। গানের লাইনের মতোই দুর্গাপুজোর সঙ্গেই বছর বছর ফিরে আসে এই বিজ্ঞাপন। বিভিন্ন বিখ্যাত শিল্পীদের একসঙ্গে গাওয়া শালিমারের বিজ্ঞাপনের গান আজও বাঙালির খুবই প্রিয়।
প্রাথমিকভাবে অভিনেত্রী-সঞ্চালিকা মৈত্রেয়ীকে দেখা যেত এই বিজ্ঞাপনে। তারপর এই বিজ্ঞাপনে শামিল হন শ্রীকান্ত আচার্য, ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়, লোপামুদ্রা মিত্র, রূপম ইসলাম, অন্বেষা, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, উপল সেনগুপ্ত, চন্দ্রিল ভট্টাচার্য, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়রা। এছাড়া থাম্বস আপের একটি বিজ্ঞাপনও বিগত দশকের শুরু অবধি বেশ জনপ্রিয় ছিল। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত সেই বিজ্ঞাপনে এক ভদ্রলোকের বাড়ির দুর্গাপুজোর আয়োজনের দায়িত্ব নেয় সেই পাড়ার অল্পবয়সিরা।
বর্তমানে পুজোর জন্য তৈরি বিভিন্ন সংস্থার বিজ্ঞাপনের পরিমাণ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। রসগোল্লা থেকে পারফিউম, জামা থেকে গাড়ি, ইমারতি দ্রব্য থেকে বাড়ি, সবকিছুর বিজ্ঞাপন দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু কোনও বিজ্ঞাপনই আগের বিজ্ঞাপনগুলোর মতো মনে থেকে যাচ্ছে না। বিগত দশকের শেষ থেকে রাস্তায় বিভিন্ন পুজোর মণ্ডপের বিজ্ঞাপন দেখতে পাওয়া যায়।
বাংলায় দুর্গাপুজোর আয়োজন এবং পালনের ছবিটা খুব দ্রুত পাল্টাচ্ছে। বাড়ির এবং হাতে গোনা কিছু বারোয়ারি পুজো ছাড়া বাকি সব পুজো থিমসর্বস্ব হয়ে উঠেছে । মজার ব্যপার হলো, বিগত বছরগুলিতে বেশ কিছু মণ্ডপ পুরনো বনেদি বাড়ির পুজোর আদলে তৈরি করা হয়েছিল। মণ্ডপ, আলোকসজ্জা, গান, বিজ্ঞাপন, খাবার- সব ক্ষেত্রেই পুজোর আয়োজন এবং পালনে কিছু না কিছু পরিবর্তন হয়েছে। যদিও এই নতুন, পুরনোর মিলেমিশের মধ্য থেকেই বাংলায় দুর্গাপুজো আয়োজিত হচ্ছে।