মানিকদা বলার আগেই বুঝে যেতেন রায়, একেই বলে শুটিং!

Soumendu Roy: 'রায়কাকা', 'রায়দাদা' ডাক শুনতে শুনতে কবে যেন ভুলেই গিয়েছিলাম সৌমেন্দু নামটা। ওই পদবিই যেন কীভাবে ওঁর নাম হয়ে গিয়েছিল।

বাবার 'রায়', আমার 'রায়কাকা' আর বাকি ইউনিটের 'রায়দা'। সৌমেন্দু রায়ের নামখানা ইউনিটের সকলেই প্রায় ভুলতে বসেছিলেন। সব্বার কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন 'রায়'। বয়সভেদে দাদা বা কাকাটা বসিয়ে নেওয়া হত শুধু। আদতে আড্ডাবাজ, প্রাণখোলা এক মানুষ। কিন্তু শুটিং চলাকালীন সেই মানুষটা যেন অন্য লোক। নিজের কাজকে কীভাবে গুরুত্ব দিতে হয়, তা শেখার মতো ছিল রায়কাকার থেকে।

বাবা যখন 'পথের পাঁচালী'-র শুটিং করছেন তখন রায়কাকা ক্যামেরার কেয়ারটেকার। বাবার ছবিতে তখন ক্যামেরা করতেন সুব্রত মিত্র। ধারাবাহিক ভাবে পর পর বেশ কয়েকটি ছবিতে তিনিই ক্যামেরা করেছেন বাবার সঙ্গে। সেই সমস্ত খুঁটিয়ে সমস্ত কাজ লক্ষ্য করতেন রায়কাকা। সেটা ১৯৬০-৬১ সালের কথা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মশতবার্ষিকী। বাবা দু'টি ছবির করবেন বলে মনস্থির করলেন। প্রথমটি রবীন্দ্রনাথের উপরে একটি তথ্যচিত্র এবং দ্বিতীয়টি পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ছবি 'তিন কন্যা'। 'পোস্টমাস্টার', 'মণিহারা' এবং 'সমাপ্তি'- রবিঠাকুরের এই তিনটি গল্প নিয়ে একটি ছবি। সেই সময় সুব্রত মিত্র পড়লেন চোখের সমস্যায়। বাবা ডেকে পাঠালেন রায়কাকাকে। বললেন, "সুব্রতদা সমস্যায়। তুমি যদি ডকুমেন্টরি ও তিনকন্যাটা একটু তুলে দাও।" সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন রায়কাকা। শুরু হয়ে গেল কাজ। সেই 'তিনকন্যা' দেখে কে বলবে, সেটা কোনও ক্যামেরাম্যানের প্রথম কাজ। বিশেষত 'মণিহারা' গল্পে আলো নিয়ে অনেকটা খেলার জায়গা ছিল। সেই সব জায়গা শুধু উতরেই দেননি, দুর্দান্ত সুবিচারও করেছেন তার সঙ্গে। তাঁর কাজ দেখে দারুণ খুশি হয়েছিলেন বাবা।

আরও পড়ুন: মোৎজার্ট অন্ত প্রাণ, বেঠোফেনকে নিয়ে ছবি করতে চাইতেন সত্যজিৎ রায়

এরই মধ্যে চোখের সমস্যা সারিয়ে কাজে ফিরলেন সুব্রত মিত্র। তাঁরই হাতে হল বাবার প্রথম রঙিন ছবি 'কাঞ্চনজঙ্ঘা'-র শুটিং। এর পর 'অভিযান'-এর শুটিংয়ের সময় আবার সুব্রত মিত্র ব্যস্ত হয়ে যান একটি অন্য় কাজে। সেসময় আবার রায়কাকাকে ডেকে নেন বাবা। এরপরে 'মহানগর', 'চারুলতা', 'নায়ক' -বেশ কয়েকটা পর পর ছবি হয়েছে সুব্রত মিত্রের হাতেই। এর পরে রায়কাকাকে পুরোপুরি ডেকে নিলেন বাবা। ততদিনে সুব্রত মিত্র অন্যান্য কাজে ব্যস্ত। শুধু বাংলা ছবিই নয়, বম্বেরও বেশ কিছু কাজ তার হাতে। ফলে ততটা সময় দিতে পারছিলেন না সুব্রতবাবু। সেসময় থেকে 'ঘরেবাইরে' পর্যন্ত বাবার সঙ্গে একটানা কাজ করা করেছেন রায়কাকা, এবং দক্ষতার সঙ্গে তা করেছেন। এর মাঝখানে বাবার সঙ্গে অনেকগুলি তথ্যচিত্রতেও কাজ করেছেন তিনি। বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের উপরে তৈরি 'দ্য ইনার আই', ভারতনাট্যম-শিল্পী বালা সরস্বতীর উপরে তৈরি 'বালা', স্বল্প দৈর্ঘ্যের ছবি 'টু'- পর পর বাবার সঙ্গে কাজ করে গিয়েছেন রায়কাকা। প্রায় ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত একটানা ছিলেন তিনি একটা বিরাট অধ্যায় জুড়ে। সেসময় সাদা-কালোর কাজ যেমন করেছেন, করেছেন রঙিন ছবির কাজও। 'অশনি সংকেত' প্রথম রঙিন ছবি রায়কাকার।

রায়কাকার সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তার গতি। দুর্দান্ত দ্রুততার সঙ্গে নির্ভুল কাজ করতেন রায়কাকা। সময় নষ্ট করা একেবারে ধাঁতে ছিল না ওঁর। যে ব্যাপারটি বিশেষ পছন্দ ছিল বাবার। যেহেতু সুব্রত মিত্রের কাজ দেখেছেন রায়কাকা, চেষ্টা করেছেন ওই ধারা, ওই স্টাইলটা বজায় রাখার। তবে দ্রুত কাজ করতেন বলে কাজের মানের সঙ্গে সমঝোতা করেননি কোনওদিন। আরও একটা দারুণ ব্যাপার ছিল রায়কাকার। ক্যামেরার কেয়ারটেকার থাকার দরুণই হোক বা ব্যক্তিগত শখের কারণে ক্যামেরাকে তিনি চিনতেন রন্ধ্রে রন্ধ্রে। যে কোনও ক্যামেরাকে খুলে ফেলে নতুন করে জুড়ে ফেলতে জানতেন রায়কাকা। ক্রমে দুর্দান্ত এক রসায়ন তৈরি হয়ে গেল বাবা আর রায়কাকার মধ্যে। সেটা এমনই ছিল যে বাবা মুখ খোলার আগেই রায়কাকা বুঝে যেতেন ঠিক কী চাইছেন পরিচালক সত্যজিৎ রায়। যার দৌলতে বাবার খাটুনি কমে গিয়েছিল অনেকটাই।

শুধু যে তিনি ক্যামেরা করেছেন বা আলোর কাজ করেছেন, তা তো নয়। বরং সিনেমা তৈরির গোটা প্রক্রিয়াটার সঙ্গে তাকে আদ্যোপান্ত মিশে থাকতে দেখেছি সবসময়। একটা সময় বাবা ক্যামেরা দেখতেন না মোটেই। প্রথম ক্যামেরা চালানো শুরু করেন তিনি চারুলতা ছবি থেকে। তার আগে পর্যন্ত হয় সুব্রত মিত্র নয় রায়কাকাই সেই কাজটি সামলেছেন। কারণ ক্যামেরা অপারেটিং তো আর যে সে কাজ নয়। সেটাও একটা আর্ট। সেটার জন্যও প্রচুর মগজের খাটনি লাগে। বাবা যে ক্যামেরার দায়িত্বটি বুঝে নিলেন সে ব্যাপারে কোনওদিন মনোঃক্ষুন্ন হতে দেখিনি রায়কাকাকে। বরং হাসিমুখে বলেছেন, "ভালো হল, এবার আলোটা নিয়ে একটু ভাবনাচিন্তার সময় পাব।" এমনই ছিল সে সময় দুই রায়ের রসায়ন। শুটিংয়ের পরে পোস্টপ্রোডাকশনেও নিয়মিত থাকতে দেখেছি ওঁকে। সব দিক শেখার এক অপরিসীম আগ্রহ ছিল রায়কাকার।

আমি তখন অনেকটাই ছোট। ইউনিটের অন্যান্য নবীন সদস্যর সঙ্গেই বেশি ঘোরাঘুরি ছিল আমার। রায়কাকাকে কিন্তু বরাবর দেখেছি দারুণ ফিট। ইউনিটের সবচেয়ে ফিট বললেও ভুল বলা হবে না। সকালে উঠে জগিং করা ছিল তাঁর রোজের রুটিন। খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রেও ছিল দারুণ শৃঙ্খলাবোধ। ভালো ব্যাডমিন্টন খেলতেন, সাঁতারও কাটতেন দুর্দান্ত। কলকাতায় শুটিংয়ের সময় যেটা হয়, প্য়াকআপ হওয়ার পরে সকলে যে যার মতো বাড়ি চলে যান। কিন্তু আউটডোরে গিয়ে শুটিংয়ের সময়ে আদতে লোক চেনা যেত। সেসময়ও রায়কাকাকে কখনও নিয়মের বাইরে বেরোতে দেখিনি। মেপে খাওয়া, আর প্রায় সর্বক্ষণ কাজে ডুবে থাকা। প্রায় সবসময়েই হয় আলোর কারসাজি নিয়ে ভাবছেন, নয় ক্যামেরার কাজ নিয়ে। আসলে সে সময় কাজ করতে হত অনেক টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে। বাজেট সে সময় ছিল একটা বড় ভাবনার বিষয়। ওই বাজেটে 'গুপিগাইন-এর মতো ছবি করা ছিল একটা চ্যালেঞ্জের মতো। কীভাবে কাজকে আরও ভালো করে তোলা যায়, কীভাবে খরচ কমানো যায়, কীভাবে আরও দ্রুত কাজ নামিয়ে ফেলা যায়, সেসব নিয়ে অহরহ ভেবে চলতেন রায়কাকা। আর এ ব্যাপারে তাঁর জুড়ি মেলা ছিল ভার।

একটানা শুটিংয়ের চাপ, নানা রকম সমস্যার ভিতরে বহু সময়েই মাথা ঠান্ডা রাখা কঠিন হয়ে পড়ত। কিন্তু কোনওদিন রায়কাকার মুখে রাগের ছায়াটুকু দেখিনি। রায়কাকা মানেই সব সময়ে মাথা ঠান্ডা। মাঝেমাঝে একেকটা পরিস্থিতিতে মনে হত এই বুঝি উনি রাগে ফেটে পড়বেন। হয়তো কয়েকজনের মুখের উপর কটূকথাও বলে দেবেন। কিন্তু তেমনটা কখনও হয়নি। কোনওদিন মেজাজ হারাতে দেখিনি রায়কাকাকে। আর সে কারণেই বোধহয় শুটিংফ্লোরের সকলের কাছে তিনি ছিলেন ভীষণ ভালোবাসার পাত্র। প্রায়শই বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে আসতেন রায়কাকা। ছবির বিষয়ে নানা কথা হত বাবার সঙ্গে। কাজের কথাই বেশি। দেখতে দেখতে কেমন পরিবারের মতো হয়ে গিয়েছিলেন মানুষটা।

বাবার ছবির শুটিংয়ে রায়কাকাকে তো দেখেইছি। আরও ভালো ভাবে রায়কাকাকে জানলাম নিজে ছবি করতে নেমে। ততদিনে রায়কাকা যেন আমার বন্ধু। আমার প্রথম ছবি 'ফটিকচাঁদ'। সেই ছবির ক্যামেরার ভার ছিল এই মানুষটির উপরেই। পরে রায়কাকার সঙ্গে টেলিভিশনের জন্য একটি সিরিয়াল এবং সিরিজেও কাজ করি। প্রথম প্রথম মনে হত, এতবছর বাবার সঙ্গে কাজ করেছেন যে রায়কাকা, সেই রায়কাকার সঙ্গে আমার কাজের অভিজ্ঞতাটা ঠিক কেমন হবে! না সেই ভয় আমার ভঞ্জন হয়েছিল শুটিংয়ের প্রথম এক-দু'দিনেই।

আরও পড়ুন: আগাম প্রস্তুতি ছাড়া হঠাৎই প্রফেসার শঙ্কুকে নির্মাণ করেন সত্যজিৎ রায়

আসলে দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র পড়িয়েছেন মানুষটি। ফলে সিনেমার জগতে নতুন প্রজন্মের যাঁরা কাজ করতে এসেছেন, রায়কাকার কাছে আশ্চর্য এক প্রশ্রয় ও স্নেহ পেয়েছেন তাঁরা। ভরসাও করেছেন তাঁদের তিনি। আমিও তাঁদেরই একজন। তাই বয়সের পার্থক্যটা ছবিকরিয়ে আর চিত্রপরিচালকের রসায়নের মধ্যে বাধা হয়ে উঠতে পারেনি কোনওদিনই। তবে এটা আমার ভেবে খারাপ লাগে, যে রায়কাকাকে এতবছর দেখেছি আমরা। ফিটনেস যার জীবনের অন্যতম মন্ত্র ছিল, সেই রায়কাকার শেষ বয়সটা কেটেছে বিছানালগ্ন হয়ে। শেষের দিকে বাক্যশক্তি হারান। বেশ কয়েকটি অ্যাওয়ার্ড ফাংশনে ওঁকে হুইল চেয়ারে করে আসতে দেখেছি। আর তা বড্ড পীড়া দিয়েছে আমাকে।

'রায়কাকা', 'রায়দাদা' ডাক শুনতে শুনতে কবে যেন ভুলেই গিয়েছিলাম সৌমেন্দু নামটা। ওই পদবিই যেন কীভাবে ওঁর নাম হয়ে গিয়েছিল। শুটিং ফ্লোরে কোনওদিনও কাউকে সৌমেন্দুদা বলে ডাকতে শুনিনি ওঁকে। গত ২৭ সেপ্টেম্বর, বুধবার যিনি আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছেন তিনি সৌমেন্দু রায়। রায়কাকা থেকেই গেলেন তাঁর সমস্ত সিনেমা জুড়ে আর আমাদের হৃদয়ে।

More Articles