হুইলচেয়ার চলবে রোগীর মস্তিষ্কের জোরে! আশ্চর্য আবিষ্কারে তোলপাড় বিশ্ব
Electrical Wheel Chair: প্যারালাইজ়ড রোগী চালাবেন নিজের হুইলচেয়ার! কীভাবে?
বিমানে ওঠার ঠিক আগে যখন বিমানবন্দর থেকে বেরনোর গেটে যখন সবাই ভিড় করেছে, চোখ চলে যায় চশমাপরা, কমবয়সি যুবতীর দিকে। ছোট করে ছাঁটা চুল, পরনে সাদা-গোলাপি জামা। এয়ারলাইন্সের দেওয়া হুইলচেয়ারে ঠায় বসে। শরীরটা একদিকে সামান্য কাত হয়ে গেলে যুবতীর স্বামী পরম যত্নে আবার সোজা করে বসিয়ে দিচ্ছেন হুইলচেয়ারে। প্যারালাইসিসে আক্রান্ত এই যুবতীর জীবন বর্তমানে হুইলচেয়ারেই সীমাবদ্ধ। নিজের বাড়ির একটি ঘর থেকে আরেকটি ঘরে যেতেও তাঁকে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় এখন। অথচ মাত্র কয়েক বছর আগেই কী চনমনে জীবন কাটিয়েছেন তিনি!
তবে হয়তো আবার সুদিন দেখতে পারেন এই যুবতীর মতো একাধিক প্যারালাইসিসে আক্রান্ত রোগী। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসের গবেষকরা এমন এক হুইলচেয়ার বানিয়েছেন, যা সম্পূর্ণভাবে প্যারালাইজ়ড রোগীও এক ঘর থেকে আরেক ঘরে কারও সাহায্য ছাড়া চালাতে পারবেন। প্যারালাইজ়ড রোগী চালাবেন নিজের হুইলচেয়ার! কীভাবে? এখানেই অবাক করেছে বিজ্ঞানীদের গবেষণা। সেই হুইলচেয়ার চলবে।রোগীদের চিন্তাভাবনার মাধ্যমে। রোগী যদি মনে করেন, তিনি বাঁয়ে যাবেন, হুইলচেয়ারটি তাঁকে বাঁয়ে নিয়ে যাবে। তিনি যদি বলেন ডাঁয়ে যাবেন, হুইলচেয়ার নিয়ে যাবে ডাঁয়ে। আর সোজা যেতে চাইলে, সেইমতো সোজা চলবে হুইলচেয়ার। কেবল রোগীকে ভাবতে হবে, তিনি কোনদিকে যেতে চান।
এখানেও গবেষকরা সাহায্য নিয়েছেন ব্রেন-কম্পিউটার সিগনালের। তবে হুইলচেয়ারটিও যে-সে নয়। এটি একটি ইলেকট্রিক্যাল হুইলচেয়ার। আমাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নড়াচড়া নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্কের যে অংশ, অর্থাৎ, মস্তিষ্কের সেন্সরিমোটর কর্টেক্স থেকে সংকেত সংগ্রহ করবে একত্রিশটি ইলেক্ট্রোড। যারা আবার একটি স্কাল ক্যাপের সঙ্গে রোগীর মস্তিষ্কে আগেভাগেই যুক্ত করে রেখেছিলেন গবেষকরা। সেই ইলেক্ট্রোড মস্তিষ্কের সেন্সরিমোটর কর্টেক্স থেকে সংকেত সংগ্রহ করে, তা সরাসরি পাঠাবে একটি ছোট্ট ল্যাপটপে। সেই ল্যাপটপ যোগ করা রয়েছে রোগীর হুইলচেয়ারের পিছনেই। ইলেক্ট্রোডের পাঠানো সংকেতকে পড়ে ফেলবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। তখনই নির্ধারণ হয়ে যাবে রোগীটি তাঁর ইলেকট্রিক্যাল হুইলচেয়ারটি কোনদিকে নিয়ে যেতে চাইছেন।
আরও পড়ুন: ফুসফুসের ক্যানসার নির্মূল করবে রোবট! যুগান্তকারী আবিষ্কারের পথে বিজ্ঞানীরা
ধরা যাক, কোনও রোগী এই হুইলচেয়ারে বসে ডানদিকে যেতে চাইছেন, তাঁকে কল্পনা করতে হবে তিনি দুই হাতই নাড়াচ্ছেন। যদি মনে করেন, তিনি বামে যাবেন, তাহলে তাঁকে কল্পনা করতে হবে তিনি তাঁর দু'টি পা-ই নাড়াচ্ছেন। তাছাড়া হুইলচেয়ারটি এমনিতে সামনের দিকে এগোবে। একটি ঘর থেকে আরেকটি ঘরেই আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স-চালিত হুইলচেয়ারটি কাজ করবে। যদি চূড়ান্ত অগোছালো ঘরও হয়, দেখা যাচ্ছে, হুইলচেয়ারটি প্রায় সঠিক অভিমুখেই এগোচ্ছে। তবে ব্যস্ত রাস্তায় চলার মতো উপযুক্ত হুইলচেয়ার এটি নয়, জানাচ্ছেন গবেষকরা নিজেই।
তবে একটি ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে বা অগোছালো ঘরের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে যাওয়ার মতো উপযুক্ত করে হুইলচেয়ারটিকে গড়ে তুলতে, গবেষকদের কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। সম্পূর্ণ বা প্রায় প্যারালাইজ়ড রোগীদেরও টানা কয়েকমাস প্রশিক্ষণ দিতে হয়েছে, যাতে তাঁরা হুইলচেয়ারটিকে নিজের ভাবনা দিয়ে (বা বলা ভালো মস্তিষ্ক থেকে) নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, রোগীরা যাতে একদম স্পষ্ট এবং নির্ভুল ব্রেন সিগন্যাল দিতে পারেন, তার জন্য দুই থেকে পাঁচ মাস তাঁদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সপ্তাহে তিনদিন করে প্রশিক্ষণের ক্লাসও চলেছে। অংশ নিয়েছিলেন তিন জন রোগী।
প্রতিটি ক্লাসে রোগীদের বলা হয়, নিজেদের হুইলচেয়ারটিকে ডান কিংবা বাম দিকে ষাটবার করে ঘোরাতে। প্রথম ব্যক্তি প্রথম দশটি ট্রেনিং-এর ক্লাসে সাঁয়ত্রিশ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্ভুল সংকেত দিতে পেরেছিলেন। পরের দশটি ক্লাসে দেখা যায় সেই সংখ্যাটা বেড়ে সাতাশি শতাংশে পৌঁছেছে। অন্যদিকে দ্বিতীয় ব্যক্তি এই সম্পূর্ণ প্রশিক্ষণটি চলাকালীন আটষট্টি শতাংশ ক্ষেত্রেই হুইলচেয়ারটিকে নির্ভুল সংকেত পাঠাতে পেরেছিলেন। আবার দ্বিতীয় ব্যক্তি প্রথম দশটি ক্লাসে সাতাশি শতাংশ ক্ষেত্রে নির্ভুল সিগনাল পাঠালেও, পরের দশটি ক্লাসে বেশ খানিকটা উন্নতি করেন। দেখা যায়, পরের দশটি ক্লাসে তিনি একানব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে নির্ভুল সিগনাল পাঠিয়েছেন।
গবেষকদের মতে, কিছু কিছু রোগীর প্রশিক্ষণ নিতে একটু বেশি সময় লাগতে পারে। ঠিক যেটা দেখা গেছে দ্বিতীয় ব্যক্তির ক্ষেত্রে। তবে তাঁদের বিশ্বাস, সময় লাগলেও, যে কোনও রোগীই ধীরে ধীরে শিখতে পারবেন, কীভাবে নির্ভুল ব্রেন সিগন্যাল পাঠাতে হয়।
নির্ভুল ব্রেন সিগন্যাল পাঠাতে শেখার পরের ধাপ ছিল, হুইলচেয়ারটিকে একটি ঘরের একদিক থেকে অন্যদিকে নিযে যেতে শেখা। দেখা গেছে, ব্রেন সিগন্যাল পাঠিয়ে প্রথম ব্যক্তি উনত্রিশবারের মধ্যে আশি শতাংশ ক্ষেত্রেই নির্ভুলভাবে হুইলচেয়ারটিকে একদিক থেকে আরেক দিকে নিয়ে যেতে পেরেছেন।
অন্যদিকে তৃতীয় ব্যক্তি কুড়ি শতাংশ ক্ষেত্রে নির্ভুলভাবে ব্রেন সিগন্যাল পাঠিয়ে হুইলচেয়ারটি একদিক থেকে অন্যদিকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। তবে দ্বিতীয় ব্যক্তি পঁয়ত্রিশ শতাংশ ক্ষেত্রে কাজটি সঠিকভাবে করতে পারলেও, তিনি কোর্সটি সম্পূর্ণ করতে পারেননি।
তবে দেখা যাচ্ছে, স্কালক্যাপটি মাথায় সংযুক্ত করার জন্য যে জেলটি ব্যবহার করা হয়, সেটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই শুকিয়ে যাচ্ছে পুরোপুরি। জেলটি ছাড়া যেহেতু ইলেক্ট্রোড কাজ করবে না, তাই এটি শুকিয়ে গেলে সমস্যা তো বটেই। জেলটি ছাড়া বেশিক্ষণ হুইলচেয়ার চালানোও সম্ভব না, কারণ ইলেক্ট্রোড থেকে ব্রেইন সিগন্যাল কম্পিউটার অবধি পৌঁছবে না। এই সমস্যার কথা মাথায় রেখেই, ইউনিভার্সিটি অফ কেন্টের গবেষক পালানিপ্পন রামাস্বামী জানাচ্ছেন, জেলের সাহায্যে ইলেক্ট্রোড যুক্ত করার বদলে শুষ্ক এবং ত্বকের ওপর প্রিন্ট করা ইলেক্ট্রোডই ব্যবহার করা যেতে পারে।