‘টাকার কথা বলিনি!’ প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ উড়িয়ে কুৎসা-তত্ত্বেই জোর মমতার
Mamata Banerjee: আরজি কর নিয়ে বারবার তথ্যলোপাটের অভিযোগ উঠেছে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। এ দিন সেই প্রসঙ্গেও মুখ খোলেন মুখ্যমন্ত্রী।
আরজি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের তরুণী চিকিৎসকের মৃত্যুর এক মাস কেটে গেলেও এখনও অধরা সুবিচার। যদিও সুবিচারের দাবিতে প্রায় প্রতিদিনই রাস্তায় নামছে গোটা রাজ্য। পুজো আসতে আর বেশি দেরি নেই। কিন্তু আরজি করের ঘটনা সেই পুজোর প্রস্তুতিকে কার্যত ম্লান করে দিয়েছে। আরজি করের ঘটনার পর বারবার প্রশ্ন উঠেছে রাজ্য সরকারের ভূমিকা নিয়ে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ চাওয়া হয়েছে বহু বিক্ষোভমিছিল থেকেই। এই পরিস্থিতিতে সোমবার নবান্নে প্রশাসনিক বৈঠক করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখান থেকে রাজ্যবাসী তো বটেই, আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্যেও একগুচ্ছ বার্তা দিলেন মমতা। আরজি করের নির্যাতিতার পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া নিয়েও যথেষ্ট বিতর্কের মুখে পড়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। সে নিয়েও এদিন স্পষ্ট বার্তা দিলেন মমতা।
নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এদিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “অনেকে বলছেন আমি টাকার কথা বলেছি। আমি মোটেই বলিনি। আমাকে প্রমাণ দেখাক, কোথায় আমি টাকার কথা বলেছি। মিথ্যা কথা বলা হচ্ছে। এগুলি অপপ্রচার, চক্রান্ত।” মুখ্যমন্ত্রী এ-ও জানান, তিনি পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগেই চিকিৎসক সংগঠনের থেকে ক্ষতিপূরণের দাবি তোলা হয়েছিল। তিনি বলেন, “আমি বাবা-মাকে যা বলেছিলাম তা হল, দেখুন, মৃত্যুর বিকল্প টাকা হয় না। আপনারা খুব মর্মাহত। আমরাও মর্মাহত। কিন্তু যদি কোনও দিন মনে করেন, আপনার মেয়ের স্মৃতিতে কোনও ভাল কাজ করবেন, আমাদের বলবেন। সরকার পাশে আছে।”
আরও পড়ুন: অনুদান ফেরানো নিয়ে স্পষ্ট বার্তা! পুজোর হাওয়ায় মাতিয়ে আন্দোলন দমানোর চেষ্টা মমতার?
আরজি কর নিয়ে বারবার তথ্যলোপাটের অভিযোগ উঠেছে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। এ দিন সেই প্রসঙ্গেও মুখ খোলেন মুখ্যমন্ত্রী। আরজি কর কাণ্ডের দু'দিনের মাথায় সেমিনার রুম লাগোয়া ঘরে মেরামতির কাজ নিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছে প্রশাসন। মমতা সেই প্রসঙ্গে এদিন বলেন, “আমি মনে করি সব হাসপাতালেই পুলিশের যতটা সম্ভব নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়াও নারায়ণস্বরূপ নিগমকে, আলো ও অন্যান্য কাজের জন্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা দিতে বলেছি। কেউ কেউ বলছেন, ওখানে (আরজি করে) কেন বিশ্রামের ঘর করতে গেল? এর জন্য আমাদের অন্য কোনও অভিপ্রায় ছিল না। যে হেতু মেয়েটিকে বিশ্রাম ঘরের অভাবে সেমিনার হলে থাকতে হল, তাই আমরা অভিপ্রায় ছিল যাতে ডাক্তারদের সেমিনার হলে না থাকতে হয়। তাই একটি বিশ্রাম ঘর ও সংলগ্ন শৌচালয় বানিয়ে দেওয়ার কথা হয়েছিল। কিন্তু কাজটি করতে দেওয়া হয়নি।”
তিনি আরও বলেন, “এটি নিয়ে নানান রকম তথ্য প্রমাণ লোপাটের কথা বলা হচ্ছে। আরে, আমরা প্রমাণ লোপাট করতে যাব কেন? কাকে বাঁচানোর জন্য? কেউ আমাদের বন্ধু নয়, কেউ আমাদের শত্রু নয়। অনেকে অনেক উল্টোপাল্টা কথা বলছেন। কিন্তু জেনে রাখুন, আমার সঙ্গে কারও কোনও যোগ নেই। আমিও কারও সঙ্গে জড়িত নই। আমি যখন কোনও পদে বসি, সেই পদকে সম্মান করতে আমি জানি। অনেক অসম্মান-অপমান করছেন মিথ্যা কথা বলে, কুৎসা রটিয়ে। আর করবেন না। সত্যিটা জেনে নিন।” মুখ্যমন্ত্রী জানান, তিনি দশ দিন আগেই স্বাস্থ্যসচিবকে নির্দেশ দিয়েছেন যেখানে যেখানে ঘাটতি আছে, তা পূরণ করতে। তালিকায় রয়েছে, আলো, সিস্টারদের পৃথক বিশ্রাম ঘরের ব্যবস্থা, পুরুষ-মহিলা পৃথক শৌচালয়ের ব্যবস্থা-সহ একাধিক প্রসঙ্গ।
ইতিমধ্যেই রাজ্যপুলিশের হাত থেকে আরজি কর মামলার তদন্তভার সিবিআইয়ের হাতে গিয়েছে। সোমবার সুপ্রিম কোর্টে ছিল সেই মামলার দ্বিতীয় শুনানি। তবে সেই শুনানিতে খুব আশাজনক কিছু শুনতে পেলেন না রাজ্যবাসী। বরং আন্দোলনরত চিকিৎসকদের তড়িঘড়ি কাজে ফেরার নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট। সোমবার সাংবাদিক বৈঠক থেকে আন্দোলনরত চিকিৎসকদের আরও একবার কাজে ফেরার অনুরোধ করেন মমতা। একই সঙ্গে রাজ্যবাসীর কাছেও মমতা উৎসবে ফেরার আবেদন করেন। পুজো আসতে আর এক মাস বাকি। আরজি করে চিকিৎসক খুনের এক মাস পূর্ণ হল সোমবার। এই আবহে চিকিৎসকদের কাজে ফেরার বার্তা দিয়ে মমতা বলেন, “যত আন্দোলন হয়েছে অনুমতি ছাড়া। অনুমতি পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। সুপ্রিম কোর্টও ডাক্তারদের অনুরোধ করেছে কাজে যোগ দেওয়ার জন্য। আমিও ডাক্তারদের কাছে অনুরোধ করব কাজে ফেরার জন্য।” মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “দয়া করে আপনারা কাজে যোগদান করুন। যদি আপনাদের কিছু বলার থাকে, সবসময় স্বাগত। আপনারা ৫-১০ জনের একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে আসুন, আমরা কথা বলতে পারি।”
একই সঙ্গে জুনিয়র ডাক্তারদের সমস্ত দাবিই স্বাস্থ্যভবন মেনেছে বলেই এদিন দাবি করেছেন মমতা। মুখ্যমন্ত্রী জানান, “আমাদের কাছে অভিযোগ সরাসরি আসেনি। তার পরেও আমরা দু’জনকে নিলম্বিত করেছি।” মুখ্যমন্ত্রী জানালেন, ময়নাতদন্তের সময় ভিডিয়োগ্রাফি করা হয়েছে। জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকেও ডাকা হয়েছিল। শুধু চিকিৎসকদের নয়, আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে এদিন মমতার বার্তা, “ প্রতিদিন রাতে আপনারা যদি রাস্তায় থাকেন, অনেক মানুষের তো সমস্যা হয়। অনেক এলাকায় অনেক বয়স্ক মানুষ আছেন। আলো লাগালে, তাঁদের ঘুমের সমস্যা হয়। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের নিয়মও রয়েছে রাত ১০টার পর মাইক বাজানো নিয়ে। তা সত্ত্বেও তো আমরা সব ছেড়ে দিয়েছি। এক মাস তো হয়ে গেল। আমি অনুরোধ করব, পুজোতে ফিরে আসুন, উৎসবে ফিরে আসুন। সিবিআইকে অনুরোধ করব, তাড়াতাড়ি বিচারের ব্যবস্থা করুন।”
আরও পড়ুন: নৈহাটিতে মিছিলে ঢুকে মেয়েদের পোশাক ছেঁড়া, স্লোগানে বাধা! নেপথ্যে তৃণমূল?
যাঁরা মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছেন বারবার আন্দোলন মঞ্চ থেকে, তাঁদের উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্রীর এদিন সাফ বার্তা, বাংলাদেশের মতো পরিস্থিতি বাংলায় তৈরি করা যাবে না। মমতা জানান, “সারা পৃথিবীতে বাংলার নামে বদনাম করা হচ্ছে। একটি হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপ জুটেছে। যাঁরা এখান থেকে পড়াশোনা করে, খেয়েদেয়ে, মানুষ হয়ে বাইরে গিয়েছেন— তাঁরা একতরফা কথা শুনে বাংলার বদনাম করছেন। তাঁরা তো দু’পক্ষকে শুনতে পারছেন না। তাঁদের বোঝা উচিত, বাংলাদেশ আলাদা রাষ্ট্র। ভারত আলাদা রাষ্ট্র। এটি আপনারা মাথায় রাখতে ভুলে গিয়েছেন। বাংলাদেশ একটি অন্য রাষ্ট্র, তাদের আমরা সম্মান করি। তাদের ভাষাকে সম্মান করি। এখানে বাংলাদেশ হবে না।” একই সঙ্গে স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মমতা এদিন জানান, “বাংলায় একটি ঘটনা ঘটলেও, তা দুর্ভাগ্যজনক। আমরা কেউ তা সমর্থন করি না। চুপচাপ আছি। নীরবে বেদনা সহ্য করছি। পুলিশকে অ্যাকশন নিতে বারণ করেছি। কিন্তু দয়া করে পরিষেবা দিন।”
তবে মুখ্যমন্ত্রীর উৎসবে ফেরার আবেদনকে ঘিরে ফের নতুন করে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। যেখানে বারংবার আন্দোলনকারীরা নির্যাতিতার সুবিচারের আশায় পথে নেমেছেন, সেখানে পুজো-উৎসবের আনন্দে ফেরার জন্য সাধারণ মানুষের প্রতি মমতার বার্তাকে ভালো ভাবে নেননি অনেকেই। ইতিমধ্যেই সোশ্যাল মিডিয়ায় এ বিষয়টি ঘিরে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।