আরজি করের তরুণীকে হত্যার পর ধর্ষণের অভিযোগ! কী এই বিরল অসুখ 'নেক্রোফেলিয়া'?

RG Kar Necrophilia: 'বাধা দেবে না' এমন যৌন সঙ্গী পাওয়ার আশায় মৃত দেহের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করে থাকা ব্যক্তিদের 'নেক্রাফাইল' বলা হয়।

আরজি করের খুনের ঘটনায় শিয়ালদা আদালত অবশেষে একক দোষী সাব্যস্ত করেছে সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয় রায়কে। একেবারে শুরুর দিকে বলা হয়েছিল, মহিলা চিকিৎসক আত্মহত্যা করেছেন। তারপর, ঘটনার একদিন পরেই সিভিক ভলান্টিয়ারকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর প্রাথমিক তদন্ত কমিটিতে মনস্তত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের রেখে পুরোটাই মনস্তাত্ত্বিক ঘটনা বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। প্রথম থেকেই নানাভাবে জল ঘোলা করার চেষ্টা করেছিল কর্তৃপক্ষ। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট দেখে চিকিৎসক মহল আশঙ্কা করেছিল, এই ধর্ষণ কাণ্ডে যুক্ত থাকতে পারে একাধিক ব্যক্তি। খুনের পরে ধর্ষণ করা হয়ে থাকতে পারে বলেও দাবি করছিলেন একাংশের চিকিৎসক। বলা হয়েছিল, সঞ্জয় রায় বিশেষ মানসিক অসুখে আক্রান্ত। মনোরোগ বিশেষজ্ঞর কথায়, এটি এক ধরনের যৌন ব্যাধি। এই অসুখকে বলে 'নেক্রোফেলিয়া'। সঞ্জয় কি সত্যিই এই অসুখে আক্রান্ত ছিল? নেক্রোফেলিয়া আসলে কী?

১৯৮৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন এই অসুখের তথ্য পর্যালোচনা করে একটি গবেষণাধর্মী রিপোর্ট সামনে এনেছিল। রিপোর্ট অনুযায়ী, 'বাধা দেবে না' এমন যৌন সঙ্গী পাওয়ার আশায় মৃত দেহের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করে থাকা ব্যক্তিদের 'নেক্রাফাইল' বলা হয়। এই মানসিক যৌন অসুখের নাম 'নেক্রোফেলিয়া'। ১২২ জন নেক্রাফাইল ব্যক্তির তথ্যের ভিত্তিতে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদন বলা হয়, এই ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা মূলত মরদেহের আশেপাশে থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু ওই গবেষণাতেই দেখা গেছে ১২২ জন নেক্রাফাইল ব্যক্তির মধ্যে কিছুজন মরদেহের কাছাকাছি থাকার সুযোগ পেলেও তাঁরা নিজে হত্যা করেই যৌন সংসর্গ করেছিলেন।

আরও পড়ুন- আন্দোলনের জের না উপরমহলের চাপ? কেন পদত্যাগ আরজি করের অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষের?

এমন কিছু ঘটনার নজির রয়েছে ভারতেও। ২১ বছর বয়সি এক মহিলাকে হত্যা এবং ধর্ষণের অভিযোগে নেক্রাফাইল এক ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করেছিল দায়রা আদালত। অভিযুক্ত আবার নিম্ন আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে কর্নাটক হাইকোর্টে আবেদন করেছিল। আবেদনকারী জানিয়েছিল, এই ঘটনায় ভারতীয় দণ্ডবিধি ৩৭৬ প্রয়োগ করা যাবে না। তার যুক্তি ছিল, এই ঘটনা নেক্রোফেলিয়া। ভারতীয় দণ্ডবিধিতে নেক্রোফেলিয়া বিষয়ে কোনও বিধান নেই। ফলত এক্ষেত্রে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না। তাই তাঁর দাবি ছিল, তাঁকে বেকসুর খালাস দেওয়া উচিত। পরে কর্নাটক হাইকোর্ট রায় দিয়েছিল, এই ঘটনায় আবেদনকারীকে শুধুমাত্র হত্যার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে।

এছাড়াও ২০১৯ সালে কালনার এক সিরিয়াল কিলারের বিরুদ্ধে মৃতের সঙ্গে সহবাসের অভিযোগ উঠেছিল। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে ইন্দোরে মায়ের মৃতদেহের সঙ্গে যৌন সম্পর্কের ঘটনা ঘটেছিল। যুবকের বয়স ছিল ২২ বছর।

১৯৯০ সালের ৫ মার্চ ১৮ বছরের এক ছাত্রীকে খুন ও ধর্ষণে অভিযুক্ত ধনঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়ের ফাঁসি হয়েছিল। পদ্মপুকুর এলাকার একটি ফ্ল্যাটে ২১টি গুরুতর আঘাতের চিহ্ন-সহ উদ্ধার করা হয়েছিল ছাত্রীর দেহ। বহু সমাজকর্মীর মতে, বিস্তর নাটকীয় ঘটনার পর ২০০৪-এর ১৪ অগস্ট আলিপুর জেলে ফাঁসি হয় 'নিরপরাধ' ধনঞ্জয়ের। এই দণ্ডাদেশ ঘিরে বিতর্ক এখনও তুমুল। ধনঞ্জয়ের ক্ষেত্রে অভিযোগ ছিল, আগে খুন করে তারপর ধর্ষণ করা হয়েছে। রক্তে ভেসে গিয়েছিল ছাত্রীর দেহ। অথচ এই ঘটনার কোনও সাক্ষীই দাবি করতে পারেনি যে, ধনঞ্জয়ের পোশাকে কোনও রক্তের দাগ ছিল। অন্যদিকে ছাত্রীর গোপনাঙ্গে শুক্রাণুর নমুনা পাওয়া গেলেও, ডিএনএ পরীক্ষায় মিলিয়ে দেখা হয়নি তা ধনঞ্জয়ের কিনা। এই ঘটনায় ক্ষমতাসীনরা নিজেদের মতো যুক্তি সাজিয়ে ছিলেন বলেই সমাজকর্মীদের মত। পুলিশের দাবি ছিল, ছাত্রীর মায়ের অনুপস্থিতিতে আধ ঘণ্টায় ধর্ষণ-চুরি-খুনের ঘটনা ঘটে কিন্তু আইএসআই-এর গবেষকরা বলেছিলেন, ময়নাতদন্তে উল্লেখিত ২১টি আঘাত ৩০ মিনিটে করা সম্ভব নয়। অর্থের অভাবে নিম্ন আদালতে খুব ভালো আইনজীবীও দিতে পারেনি ধনঞ্জয়ের পরিবার। শেষে মঞ্জুর হয়ে গেল মৃত্যুদণ্ড।

আরও পড়ুন- চিকিৎসক-মৃত্যু নিয়ে উত্তাল আরজি কর! তদন্ত কমিটির স্বচ্ছতা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠছে

ভারতীয় দণ্ডবিধিতে এখনও নেক্রোফেলিয়া বিষয়ে কোনও বিধান নেই। অর্থাৎ মৃতদেহের সঙ্গে যৌন সংসর্গকে অপরাধ আওতায় আনা হয়নি। তবে, ইংল্যান্ড, কানাডা, নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় নেক্রোফেলিয়া একটি অপরাধ। ২০২৩ সালে কর্নাটক হাইকোর্ট কেন্দ্রীয় সরকারকে ভারতীয় দণ্ডবিধির সংশোধনের জন্য সুপারিশ করেছিল।

আরজি কর ধর্ষণ কাণ্ডে পুলিশ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সঞ্জয়কে গ্রেফতার করে। পুলিশ জানিয়েছিল, জেরায় নাকি ধৃত সঞ্জয় রায় খুনের কথা স্বীকারও করেছেন। যদিও, শনিবার, ১৮ জানুয়ারি তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করার সময়ও সঞ্জয় নিজেকে নির্দোষ বলেই দাবি করে। ধনঞ্জয়ের ক্ষেত্রে যেভাবে একের পর এক গল্প সাজানো হয়েছিল তা ক্ষমতাসীনদের প্রতিদিনের যুক্তির খেলা। সঞ্জয়কে এই ঘটনায় একা দোষী সাব্যস্ত করার পিছনেও সেই আশঙ্কাই রয়ে গেল, সঞ্জয়কে বলির পাঁঠা করে বৃহৎ কাউকে আড়াল করার ষড়যন্ত্র উড়িয়ে দিতে পারছেন না অনেকেই!

More Articles